• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

ভোটের আগে নামাবলী বদলে কংগ্রেসের লোকজন হঠাৎ বিজেপি

প্রকাশ:  ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২০:২৫
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

বারবার ঘুঘু ধান খেয়ে যায় এবার আর তা হতে দেবে না বলে কিরে কেটেছিলো বিজেপি। কিন্তু বিজেপির যাবতীয় স্বপ্ন ও যতেক রকম আয়োজন সবকিছু চুরমার করে, বলতে গেলে ড্যাং ড্যাং করেই জয়ের পথে বামফ্রন্ট।চারবার পার করে পঞ্চমবার। ইভিএম কেলেঙ্কারির দৌলতে গতকাল গভীর রাত পর্যন্ত চলে ভোটগ্র্রহণ। ভোট পড়ার হার গতবারের চেয়ে সামান্য কম।

গণনা আগামী তেসরা মার্চ। কারণ, অপেক্ষা নাগাল্যান্ড ও মেঘালয়ের ভোট পর্বের জন্য। কিন্তু বামফ্রন্টের অন্দরমহলের হিসেব-নিকেশের কথা নয়, আগরতলায় উপস্থিত স্থানীয় ও বহিরাগত যাবতীয় মিডিয়ার লোকজনদের সকলেরই মূল্যায়ন, হীরে নয়, ফের মানিক বেছে নিলো উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজনীতিগতভাবে অত্যন্ত স্ট্র্যাটেজিক এই রাজ্য।

সম্পর্কিত খবর

    বামফ্রন্টের নিজস্ব হিসাবের সঙ্গে মিলে যচ্ছে মিডিয়ার হিসাবও। তাতে দেখা যাচ্ছে ভোট হওয়া ৫৯টি আসনের মধ্যে ( চারিলামকেন্দ্রের বামপ্রার্থী রামেরন্দ্র নারায়ণ দেববর্মার মৃত্যুতে একটি আসনে ভোট স্থগিত রাখা হয়েছে) বামফ্রন্টের জয়লাভ সুনিশ্চিত অন্তত ৪৬টি কেন্দ্রে। গত ২০১৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ৬০টি আসনের মধ্যে বামফ্রন্ট পেয়েছিলো ৫০টি আসন। পরে উপনির্বাচনে বড়জলা আসনটি সিপিআই(এম) কংগ্রেসের কাছে থেকে ছিনিয়ে নেয়ায় তাদের আসন গিয়ে দাঁড়ায় ৫১টি। এবার তার চেয়ে যে গোটা পাঁচেক আসন সম্ভাব্য প্রাপ্তির তালিকা থেকে বাদ রাখা হচ্ছে তার সবকটিই হলো উপজাতি অধ্যুষিত উত্তর ত্রিপুরায়। এই এলাকায় বিজেপির জোটসঙ্গী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আইপিএফটির কিছুটা প্রভাব রয়েছে। সেখানে একদিকে সন্ত্রাস অন্যদিকে বিজেপির মরণপণ চেষ্টায় গোটা পাঁচেক আসন বামফ্রন্ট্রের হাতছাড়া হতে পারে।

    একটা জিনিস এই নির্বাচনে অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছে তা হলো বামফ্রন্টের এবারের লড়াইটা ছিলো মূলত বিজেপির সঙ্গে। অর্থাৎ বামফ্রন্টের জয়ের অর্থ নিশ্চিতভাবেই বিজেপির পরাজয়। কিন্তু তাদের পরাজয়ের দেয়ালের লিখন এখন থেকেই পড়ে ফেলা সম্ভব হচ্ছে কেন? আসলে ত্রিপুরাবাসীদের বেশিরভাগই বিজেপিকে দিল্লী থেকে উড়ে এস জুড়ে বসা একটি দল হিসাবে মনে করেছেন। এই দলের স্থনীয় স্তরে কোনদিনই তেমন কোন প্রভাব ছিলো না। ভোটের ঠিক আগে নামাবলী বদলে কংগ্রেসের লোকজন হঠাৎই বিজেপি হয়ে বসে।

    যে কারণে বিজেপির নিজস্ব প্র্রার্থী তালিকায় ৬১ জনের মধ্যে ৪৫ জনই প্রাক্তন কংগ্রেসি বাকি ৯টি আসনে তারা ছেড়েছিলো জোটসঙ্গী (আইপিএফটিকে)। এই দলবদলু নেতাদের এবারে ত্রিপুরার মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছেন। আসলে বিজেপির এবারের লক্ষ্য ছিলো যে কোনাভাবে রাজ্য দখল করা। আর তাই যেভাবে তারা নির্বাচনের প্রচার পর্ব থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তা এ রাজ্যে আগে কখনো হয়নি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই ছোট্টরাজ্যটির জন্য দু-দুবার সফর করেছেন। শুধু তাই নয়, চল্লিশ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বিভিন্ন পর্যায়ে রাজ্যে এসে সভা করে গিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথসহ ছ-ছজন মুখ্যমন্ত্রী এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। কিন্তু তা সত্তেও মানুষের বিন্দুমাত্র সহানুভূতি বিজেপির সঙ্গে ছিলো না তার একটা বড় কারণ হলো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আইপিএফটির সঙ্গে বিজেপির জোট গঠন । একসময় যারা ত্রিপুরায় রক্তগঙ্গা বইতে দিতে চেয়েছিলো সেই সংগঠনের নেতা নরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মঞ্চে কোলাকুলি করছেন এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায়নি।

    ফলাফল নিয়ে কোনো সংশয় না থাকলেও রাজ্যের বামশিবির, মিডিয়া মহল তো বটেই এমনকি সাধারণ মানুষের মধ্যেও দুটি প্রশ্ন খুবই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। একটি হলো নজিরবিহীন ইভিএম বিভ্রাট। এর পিছনে এক সুগভীর ষড়যন্ত্র থাকার আঁচ করছেন অনেকেই । কিন্তু মুখ ফুটে সে কথা বলতে পারছেনা প্রমানের অভাবে।সাড়ে তিন হাজার পোলিং স্টেশনের মধ্যে প্রায় ৫১৯টি বুথে গতকাল ইভিএম খারাপ হওয়ার খবর মিলেছে। নির্বাচন কমিশনের দপ্তর থেকে দেয়া এই তথ্য কিন্তু বামফ্রন্ট মানতে চায়নি। তাদের বক্তব্য, আরো অনেক বেশি সংখ্যক বুথে ইভিএম খারাপ হয়েছে। কিন্তু কমিশন সেই তথ্য চেপে দিতে চেয়েছে। গতকাল রাজ্য সিপিআই(এম) সম্পাদক বিজন ধর সহ অন্যান্য বামফ্রন্ট নেতারা উপ নির্বাচন কমিশনার সুদীপ জৈনের সঙ্গে দেখা করে অবিলম্বে বেশ কয়েকটি পুননির্বাচনের দাবি তুলেছেন। কমিশন অবশ্য গতকাল রাত পর্যন্ত মাত্র একটি বুথে পুননির্বাচনের আদেশ দিয়েছেন। রাতে বামফ্রন্ট অবশ্য অবাধ, শান্তিপূর্ণ ভোটের জন্য জনগণকে অভিনন্দন জানায়।

    বামফ্রন্টের বক্তব্য, ইভিএমের জালিয়াতি হওয়ার সম্ভাবনা বহু আগে থেকেই তারা পেয়েছিলেন। ঠিক সেই ব্যাপারটিই ঘটলো গতকাল নির্বাচন পর্বের শুরু থেকে। উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে এক প্রকাশ্য জনসভায় বিজেপির রাজ্য সভাপতি বিপ্লব দেব বলেন, মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের ভোটও কোনদিকে পড়বে তা কেউ বলতে পারে না । সে কথা শুধু আমি জানি আর নরেন্দ্র মোদি জানেন। এই মন্তব্যকে ফের সামনে এসে গতকাল সিপিআই(এম) বলে, বোঝাই যাচ্ছে ত্রিপুরা দখল করার জন্য কীভাবে ইভিএম জালিয়াতির জাল বিস্তার করা হয়েছে। গতকাল ভোট শেষ হওয়ার কথা ছিলো বিকাল চারটায়। সেই সময় পর্যন্ত ভোট পড়ার হার ছিলো ৭৪ শতাংশ। কিন্তু তারপরও বহু ভোটার বুথের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কোথাও কোথাও ভোট শেষ হতে রাত গড়িয়ে গিয়েছে। মুলত ইভিএম সংক্রান্ত নানা অসুবিধার কারণেই ভোট শেষ হওয়ার সময় এতোটা বাড়াতে হয়েছে। শেষপযর্ন্ত যা খবর পাওয়া গিয়েছে তাতে ভোটের হার দাঁড়িয়েছে ৮৫ শতাংশ যা ২০১৩-র বিধানসভা নির্বাচনের চেয়ে কিছুটা কম। সেবার ভোট পড়েছিলো ৯৩.৪৯ শতাংশ। গতকাল আইপিএফটি প্রভাবিত অঞ্চল টাকারজলা কেন্দ্রে সিপিআই(এম) এজেন্টদের ওপর আক্রমণ নামানো হয়।সিপিআই(এম) মুখপাত্র গৌতম দাশ অভিযোগ করেছেন, এখানকার আটটি বুথে তাদের এজেন্টদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ভোটারদেরও বাড়ি গিয়ে ভয় দেখানো হয়। এর মধ্যে তিনটি বুথে তাঁরা পুননির্বাচন দাবি করেছেন।

    দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি নিয়ে মানুষের মধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে, তা হলো ছোট্ট একটি রাজ্য ত্রিপুরা যাতে ছোট ছোট পরিধির ৬০টি মাত্র আসন রয়েছে বেশিরভাগ অঞ্চলই শান্তিপূর্ন এলাকা বলে পরিচিত। সেখানে একটানা নির্বাচনী প্রচারপর্বে কখনো কোন রাজনৈতিক উত্তেজনা বা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। তা সত্ত্বেও ভোট গ্রহণকে কেন্দ্র করে এতো বিশাল বাহিনীর আয়োজন বা সর্বত্র সিসিটিভির নজরদারি কেন? সেখানে ৭০শতাংশ বুথে অনলাইনে সিসিটিভি চিত্রের লাইভ প্রচার করা হয়। দিল্লী থেকে সেই বুথগুলিতে নজরদারি চালানো হয়। এ ছাড়া বাকি ৩০শতাংশ বুথে ভোটপর্ব রেকর্ডিং করে রাখা হয়েছে। এইটুকু রাজ্যের জন্য ২৫০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানো হয়েছিলো। এর সঙ্গে ছিলো রাজ্যের ২০০ কোম্পানি বাহিনী। সশস্ত্র সীমাবলের অধিকারিক আর কে পচনন্দাকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে সে রাজ্যে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কেন? ভোট দেয়ার সময় মানুষ বারবার এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন।

    ত্রিপুরায় যে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসতে চলেছে তা গত কয়েকটি নির্বাচনের ধারাবাহিক ফলাফল থেকেও অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের ৫৯টি বিধানসভা কেন্দ্রেই বামফন্ট ৬৫শতাংশের ওপর ভোট পেয়েছিলো। তা ছাড়া উপজাতি এলাকার এটিসি নির্বাচনে তারা ২৮টির মধ্যে ২৮টি আসনেই জয়ী হয়। পঞ্চায়েত ও পুর নির্বাচনেই তারা অধিকাংশ আসনে ৫০শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলো। এর পর গত কয়েক বছর এমন কোন ঘটনা ঘটেনি যাতে এই বিপুল জনপ্রিয়তার আঘাত লাগতে পারে।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close