• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

কুকি-চিন সশস্ত্র গোষ্ঠীর তান্ডব বন্ধে পাহাড়ে অভিযান প্রয়োজন

প্রকাশ:  ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ১১:১৭
পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ

ভয়ংকর কুকি-চিন সন্ত্রাসীরা দুই দিনে তিনটি সরকারি ব্যাংক লুটের পর থানায় আক্রমণ করেছে। বেপরোয়া সন্ত্রাসীরা ব্যাংক লুটের পর থানচি থানা ঘেরাও করে গুলিবর্ষণ করে। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে গড়ে ওঠা এই সন্ত্রাসী সংগঠন বেপরোয়া কর্মকান্ড শুরু করেছে। পাহাড়ের শান্তির জীবন অশান্ত করে তুলেছে।

সম্পর্কিত খবর

    নবগঠিত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সশস্ত্র অংশ কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি দুই দিনে বেপরোয়া কর্মকান্ড করেছে। ২ এপ্রিল পার্বত্য জেলা বান্দরবানের রুমায় সোনালী ব্যাংকে লুট করে এবং ম্যানেজারকে অপহরণ করে। ৩ এপ্রিল দিনদুপুরে থানচি উপজেলার দুটি ব্যাংকে সন্ত্রাসী হামলা চালায়। ব্যাংক কর্মীদের জিম্মি করে নগদ টাকা লুটে নেয়।

    দিনে কৃষি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক লুটের পর বেপরোয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী রাতে থানচি থানায় আক্রমণ করে। দুপুরে ব্যাংক ডাকাতির আগে থানচি বাজারে গুলি ছুড়তে ছুড়তে দোকান এবং ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে লুটপাট করে। বিভিন্ন দোকান থেকে মোবাইল সেট আর টাকা কেড়ে নেয়।

    পাহাড়ে এর আগে জঙ্গি সংগঠনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে এই কেএনএফ।

    আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গেও বিভিন্ন সময় সংঘর্ষ হয়েছে। নবগঠিত এ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রাঙামাটির সাজেকের বাঘাইছড়ি, বরকল, জুড়াছড়ি, বিলাইছড়ি, বান্দরবানের উপকণ্ঠ থেকে চিম্বুক পাহাড়ের ম্রো অঞ্চল হয়ে রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচি, লামা ও আলীকদম-এ ৯টি উপজেলা নিয়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত একটি পৃথক রাজ্য সৃষ্টি তাদের উদ্দেশ্য। তাদের দাবি, পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের উত্থানের পেছনে রয়েছে সেখানকার বম সম্প্রদায়। আর সেই ঘাইছড়ি, বরকল, জুড়াছড়ি, বিলাইছড়ি, বান্দরবানের রুমা, রংছড়ি, লামা ও আলীকদম উপজেলা নিয়ে পৃথক রাজ্যের কথা বলে আলোচনায় আসে এ সংগঠনটি।যদিও পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় তারা বলে সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের প্রতিপক্ষ নয়। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক অভিযানের পর শান্তি আলোচনায় আসে এ সংগঠনটি। অনেক দিন নীরব থাকার পর হঠাৎ করে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এই সন্ত্রাসী সংগঠন।

    বাংলাদেশে কুকি-চিন জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা কম। তবে ভাবনার বিষয় হলো- আমাদের প্রতিবেশী ভারতের মিজোরাম ও মিয়ানমারে এদের বড় ধরনের জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। ভারতের মিজোরাম, মনিপুর এবং মিয়ানমারের চিন রাজ্যে কুকি জনগোষ্ঠীর শক্তিশালী অবস্থান। কুকি জনগোষ্ঠী ভারত ও মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র তৎপরতা চালাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এখানকার কুকি-চিনরা ভারত এবং মিয়ানমারে তাদের জাতিগোষ্ঠীর কাছে আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশে গত দুই দিনে এদের ভয়াবহ তান্ডবের ঘটনায় মনে হচ্ছে ভারত মিয়ানমারের সশস্ত্র জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের কুকি-চিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা রয়েছে। কারণ তারা সশস্ত্র অবস্থায় বেশ বড় দল নিয়ে এই বেপরোয়া লুটে অংশ নেয়।

    তাদের তান্ডবে পাহাড়ের মানুষ নিরাপত্তাহীন অবস্থায় রয়েছে। অশান্ত পাহাড়কে শান্ত করার জন্য এদের বিরুদ্ধে শক্ত অভিযান পরিচালনা করা দরকার। এরা আলোচনার কথা বলে আবার এ ধরনের বেপরোয়া লুটপাটের কর্মকান্ডে অংশ নেয়। যদিও এই কুকি-চিন গোষ্ঠীর কর্মকান্ডের প্রতি পাহাড়ের বৃহৎ জাতিগোষ্ঠীর সমর্থন নেই বলেই আপাত মনে হচ্ছে। তবু সরকারকে গভীর পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ’৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ’৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর পাহাড়ে শান্তির পথ গ্রহণ করেন। দুই দশক ধরে চলা পাহাড়ের সশস্ত্র সংঘাত বন্ধের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সেই উদ্যোগের ফলে পাহাড়ের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর ক্ষোভ, বেদনা প্রশমিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অবসান হয় দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের।

    চুক্তি স্বাক্ষরের পর ’৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জনসংহতি সমিতির প্রায় ২ হাজার সদস্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে। প্রধানমন্ত্রী এদের ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছিলেন। সরকার তাদের পুনর্বাসন করাসহ প্রায় ৭০০ জনকে পুলিশ-আনসার বাহিনীতে নিয়োগ দেন। পাহাড়ের জনপদে শান্তি ফিরে আসে। সরকার পাহাড়ের মানুষের উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। বিভিন্ন আইন পাসের মধ্য দিয়ে পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের স্বার্থরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

    শান্তির পাহাড় কুকি-চিনরা হঠাৎ করে অশান্ত করার পেছনের কারণ সরকারকে খুঁজে বের করতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের কুকি-চিনের সম্পর্ক রয়েছে। তাদের নতুন কোনো পরিকল্পনা আছে কি না দেখা দরকার। এদের জাতিগোষ্ঠীর কারণে ভারতের মিজোরাম অশান্ত হয়ে আছে। মিয়ানমারের একটি অংশে এই কুকি-চিনরা অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে। তিন দেশের কুকি-চিন অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে তাদের কোনো পরিকল্পনা থাকতে পারে। এই জাতিগোষ্ঠীর বাস তিন দেশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে। একই জাতিগোষ্ঠী হওয়াতে ঐতিহাসিকভাবে এদের সম্পর্ক রয়েছে। তিন দেশের সশস্ত্র এই জাতিগোষ্ঠীর পরস্পরের সঙ্গে রয়েছে বিশ্বাসের সম্পর্ক। একসঙ্গে লড়াইয়ের সম্পর্ক। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে এরা সীমান্ত অতিক্রম করেছিল। মিজোরামে তাদের জাতিগোষ্ঠীর কাছে যেমন আশ্রয় পায় মিয়ানমারের জাতিগোষ্ঠীর কাছেও আশ্রয় পায়। মিয়ানমারে কুকি-চিন সশস্ত্র গোষ্ঠী দেশের সেনা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।

    আমাদের ভাবতে হবে হঠাৎ করে আমাদের এখানে কুকি-চিনরা বেপরোয়া হওয়ার কারণ কী?

    এরা তো সর্বশেষ কয়েক মাস আগে শান্তি আলোচনা করেছিল। এরা যেসব জঙ্গিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের আটকও করেছে। যে পরিমাণ সশস্ত্র কুকি-চিন ব্যাংক ডাকাতিতে অংশ নিল তারা সংখ্যায় বেশ। তাহলে এদের সঙ্গে অন্য দেশের সশস্ত্র জাতিগোষ্ঠী অংশ নিল?

    পাহাড়ের শান্তি নিশ্চিতে এ বিষয়গুলো আমলে নিতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তাদের জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তা নিয়ে আমাদের পাহাড়ে কোনো অঘটনের পরিকল্পনা রয়েছে কি না জানা দরকার। গুরুত্বের সঙ্গেই কুকি-চিনের সাম্প্রতিক বেপরোয়া আচরণকে মূল্যায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে সামরিক বাহিনীর সহায়তা নিয়ে পাহাড়ের শান্তি নিশ্চিত করতে হবে।

    লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close