• শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪, ১৫ আষাঢ় ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

এটা তো একার যুদ্ধ হওয়ার কথা নয়!

প্রকাশ:  ২৯ মে ২০২৪, ২১:৪০
নিজস্ব প্রতিবেদক

জীবনের অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসে আজ কেন জানি মনে হচ্ছে ছোট্ট একটা জীবনে ক্রমাগত ভুল করতে করতেই কী নিজেকে নিঃশেষ করে দিচ্ছি? নিজেকে কি আমি নিজেই বারবার নিক্ষিপ্ত করে ফেলছি এক অনিশ্চিত ভবিতব্যের দিকে? সম্মুখপানে তাকিয়ে তাই কী শুধু দেখি প্রান্তহীন ধু ধু মরুর পথ, যে পথে কোনভাবেই শান্তির বিন্দুমাত্র ছায়াবীথি নেই!

কি অদ্ভুত তোষামোদিতে ঠাসা এক সংস্কৃতি ভর করেছে চারপাশ জুড়ে। যেখানে একদল লোক শুধু প্রশংসায় ভাসতে চায়, আবার আরেক দল নিজের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে অন্যদেরকে প্রশংসায় ভাসিয়ে রাখতে চায়। এদের মধ্যে যারা পদ, পদবী, সামাজিক মর্যাদা তথা ক্ষমতার দিক থেকে যত বেশি উপরে থাকে, প্রকৃত যোগ্যতা যতখানিই থাকুক প্রশংসা শুনতে শুনতে তাদের শুধু মনে হয় - চারদিকে কেবল তাদের বিজয় ধ্বনি বেজে উঠুক, তাদের মর্যাদার স্তর হয়ে ওঠুক আকাশচুম্বী।

একইসাথে কিছু সুবিধাবাদি, স্বার্থান্বেষী ও লোভি মানুষ তাদেরকে সর্বোচ্চ সম্মানিত ও প্রশংসিত ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত করে ফেলায় এসব ব্যক্তিরা তাদের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। অভিনন্দন-অভ্যর্থনা, বাহবা ইত্যাদি শুনতে শুনতে এসকল ব্যক্তিরা যে বিষয়ে সাধারণ জ্ঞানতো দূরের কথা কোন ধারণাই নেই, সে বিষয়ে নিজেদেরকে মহাপন্ডিত মনে করে অন্যদেরকে জ্ঞান দেয়া শুরু করে! অনেক সময় এরা অংশগ্রহণের নিমিত্তে প্রশ্ন আহবান করে আবার জ্ঞানগ্রহণকারীদের মতামতকে ক্রমাগতভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে থাকে, জনসম্মুখে তাদেরকে অপমান-অপদস্থ করে নির্মম আনন্দও অনুভব করে!

এ রকম একটা সমাজব্যবস্থায় স্পষ্টবাদি মানুষের অবস্থা কি হতে পারে সহজেই অনুমেয়। এদের উচিত কথায় মুরশিদরা হয় মারাত্মকভাবে বেজার, আর সেই বেজার দেখে তোষামোদকারিদের একটা বড় অংশ হয়ে ওঠে আরও বেশি বেজার। কোন কোন ক্ষেত্রে যাদের জন্য স্পষ্ট কথা উচ্চারণ করতে গিয়ে ক্ষমতাধরদের রুদ্র রোষানলের শিকার হতে হয়, নিজের স্বার্থ ও নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে এদের মধ্যে উচ্চাভিলাষী তথাকথিত শোষিতরাও মুরশিদদের সাথে হাত মিলিয়ে কখনো কখনো স্পষ্টবাদি লোকটা বা তার পক্ষে অবস্থানকারী প্রতিবাদি ব্যক্তির বিরুদ্ধে আবার নানারকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে ওঠে। হায়রে ধূর্ত ও স্বার্থপর বাঙালি!

সত্যি কথা বলতে কি উচিত কথা মুখের ওপর বলার দুঃসাহস দেখানোটা আমার মত কারো কারো জন্মগত বৈশিষ্ট্য। নিজের মধ্যে চর্চিত এমন অনমনীয় দৃঢ়তা বাস্তব জীবনে যে ইতিবাচক নয়, বরং জীবনকে চরম এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেয় তার প্রমাণ আমি এক জনমে বহুবার পেয়েছি। এমন লোকদের পছন্দ করলেও সান্নিধ্যে থাকা মানে জীবনকে উচ্চপদস্থ ও ক্ষমতাশালীদের কাছে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে অনেকেই আমাদেরকে নানাভাবে এড়িয়ে চলে। ফলে আমার মত অনেকেরই তথাকথিত মিত্রের সংখ্যা যে ক্রমাগতভাবে কমে যাবে সেটাও অজানা নয়। কিন্তু নিজেকে আমি পরিবর্তন করতে পারিনা, সেটা সম্ভবও নয়। আমার একসময় কাছে থাকা আর এখন দূরে সরে যাওয়া বন্ধুরাও এই ব্যাপারটা বেশ ভালো করেই জানে। এক জনমে আমার এই যুদ্ধ হয়ত শেষ নিঃশ্বাস অবধি চলবে।

এখন দিন দিন বয়স বাড়ছে। বেঈমান, মিথ্যাবাদী, ভন্ড ও মুখোশধারী ব্যক্তিদের সাথে একা যুদ্ধ করতে করতে কখনো কখনো ক্লান্ত অনুভব করি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াকু মানুষের সংখ্যা কমতে কমতে তোষামোদি লোকের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়ে যাওয়া দেখে কখনো কখনো বিষন্নতাও ভর করে। মাঝে মাঝে মনে হয় নিজের ভেতর আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসি। নিজের আবেগ, অনুভূতি, কষ্ট, হাসি, কান্না, মায়া, সহানুভূতি সব কিছুকে গলা টিপে হত্যা করে ফেলি। যে দেশে তথাকথিত সচেতন সমাজ বা গোষ্ঠী নিজেরাই স্বার্থান্বেষী মহলের চাটুকারি ভূমিকায় প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়, যারা কোনভাবেই উপলব্ধি করতে রাজি নয় যে, স্পষ্টবাদি কিংবা অন্যায়ের বিরুদ্ধাচারণকারী মানুষের সংখ্যা কমে যেতে শুরু করলে সেটা সেই দেশ ও সমাজের ভবিষ্যতের জন্য বড় শংকার কারণ, সেখানে সামগ্রিক অর্থে কিভাবে পরিবর্তন আনা সম্ভব?

পরিবার, সমাজ, কর্মজীবনে এসব ঘটনার বাইরে যে দেশের রাজনৈতিক জীবনে সরকারের কাজের কোন সমালোচনা করলে রাষ্ট্রদ্রোহী বা বিরোধী দলের দোসর অথবা দেশবিরোধীদের অনুসারী হিসেবে তকমা লাগানো হয়, আবার সরকারের কোন ভাল পদক্ষেপ গ্রহণকে সাধুবাদ জানালে যখন বিরোধী চিন্তাধারার নেতা-কর্মী-অনুসারীরা সরকারের দালাল বলে অভিহিত করে, এমন অসুস্থ মানসিকতার জাতির একটা বড় অংশকে এমন চরম রক্ষণশীল ধারণা থেকে কে, কখন, কিভাবে মুক্ত করবে এটাও একটা বড় প্রশ্ন।

কোনকিছুতেই সূরাহার কোন লক্ষণ দেখিনা। যে যুব সমাজের সবার আগে জেগে ওঠার কথা, তাদের যেন ঝিমুনি রোগ হয়েছে। যাদেরকে দেশপ্রেমিক, দেশচিন্তক আখ্যায়িত করা হয়, তারা আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে চ-তে চামচা, চামচামিতে শ্রেষ্ঠ যারা/কলিকালের কেষ্ট তারা। পাঠ্যবইয়ে এ রকম একটা বর্ণপাঠ যোগ করা যেতেই পারে। কারণ চামচা ও চামচামি, চামবাজ ও চামবাজি অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আরও যুক্ত হয়েছে তেলবাজ ও তেলবাজি। অভিধান না পড়েও এই শব্দগুলোর মানে বুঝতে সামাজিক অভিধানের অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট।

হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হওয়ার এমন সময়ে সবসময়ই আমার কাছে অনুপ্রেরক হয়ে হাজির হয় স্বনামধন্য নরওয়েজীয় নাট্যকার যিনি আধুনিক বাস্তবতাবাদী নাটকের সূত্রপাত করেছেন সেই হেনরিক ইবসেন। ১৮৮২ সনে প্রকাশিত তাঁর অসাধারণ নাটক 'অ্যানিমি অফ দ্য পিপল' (জনতার শত্রু) এর কেন্দ্রীয় চরিত্র ডঃ স্টকম্যান এর চরিত্রের কথা মনে করে এমন তোষামোদি সমাজের বিরুদ্ধে একাই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে জাগে। যে চিকিৎসক রোগাক্রান্ত জল এবং সামাজিক দুর্নীতির কার্যকরণ উন্মোচন করতে গিয়ে সমাজের সুবিধাবাদি ও লোভি প্রভাবশালী মহলের প্রচন্ড ক্ষুব্ধ রোষানলের মধ্যে পড়ে মারাত্মক নিন্দিত হয়ে একা হয়ে যাওয়ার পরও সত্য প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে একাই লড়ে যেতে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। যত প্রতিবন্ধকতাই আসুক, যত অনাকাঙ্ক্ষিত দোষই চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলুক না কেন - যতদিন বেঁচে আছি বুকের পাটা সটান করে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে যাবোই, না হয় হলাম একা!

মনজুর রশীদ লেখক, সমাজ বিশ্লেষক

মনজুর রশীদ
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close