• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

উপজেলা নির্বাচনে ডিসি-এসপিদের নিরপেক্ষ রাখুন

প্রকাশ:  ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ২৩:৩৭
পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে গত ২৫ এপ্রিল ঢাকায় ডিসি-এসপিদের নিয়ে সিইসি বৈঠক করেছেন। বৈঠকের আগে তিনি মিডিয়ায় কথা বলেছেন। সংবাদপত্রে তার বক্তব্য এসেছে। উপজেলা নির্বাচন নিয়ে তার বক্তব্যে এক ধরনের আকুতি ঝরেছে।

সম্পর্কিত খবর

    তিনি বলেছেন, মানুষ যেন নির্বিঘ্নে এসে ভোট দিয়ে নিরাপদে চলে যেতে পারে। উপজেলা নির্বাচন ব্যর্থ হলে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ক্ষুণ্ণ হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে তার আকুতি জানিয়েছেন সবার কাছে।

    উপজেলা নির্বাচন একতরফা হতে যাচ্ছে।

    আওয়ামী লীগের নৌকা না থাকলেও আওয়ামী লীগের নেতারাই প্রার্থী হচ্ছেন। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। জামায়াত নির্বাচনি প্রস্তুতি শুরু করে নির্বাচন থেকে সরে গেছে। জাতীয় পার্টি ছাড়া অন্যান্য দলও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না।

    জাতীয় পার্টি অংশ নিলেও হাতেগোনা কয়েকজন প্রার্থী দিতে পারবে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে দল বিপর্যস্ত হয়েছে। জাতীয় পার্টির তৃণমূলের নেতারা উপজেলায় প্রার্থী হতে রাজি নন। সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে তারা প্রার্থী হওয়া থেকে দূরে রয়েছেন। কেন্দ্র চাইলেও তৃণমূল নেতারা প্রার্থী হচ্ছেন না।যে কারণে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতারাই প্রার্থী। দল নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য মানুষ, যাদের পেশিশক্তি নেই, বিপুল অর্থ নেই, তারাও প্রার্থী হচ্ছেন না। তাই নির্বাচনি লড়াই হবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের। একতরফা নির্বাচন। ভোটাররা দ্বিধায়। কার পক্ষে যাবেন? স্থানীয় রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দলের সবাই ক্ষমতাশালী নন। সেখানেও বিভাজন আছে। ক্ষমতার প্রভাব মুষ্টিমেয়র কাছে। দল ক্ষমতায় থাকলেও দলের সবাই ক্ষমতাবান নয়। কেউ আদর্শিক স্থান থেকে দলের জন্য নিবেদিত। এরা বঙ্গবন্ধু এবং দলের নেত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা থেকে দল করেন। দলের দুঃসময়ে এরা সাহসী হন। দলের এবং তাদের নেত্রীর জন্য মাঠে নেমে আসেন। ক্ষমতার সময় এরা দূরে থাকেন অথবা দূরে ঠেলে রাখা হয়। দীর্ঘদিন দল ক্ষমতায় থাকায় দলের ভিতর ক্ষমতাশালী শ্রেণি তৈরি হয়েছে। তারাই এখন দলের, এলাকার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। দুঃসময়ের আদর্শিক লোকেরা এখন আড়ালে। দলের সংকট দেখা দিলে এ অভিমানীরা অভিমান ভুলে আবার মাঠে নামবেন। অতীত তাই বলে। নির্বাচনেও স্থানীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা যেমন প্রার্থী হবেন, ক্ষমতার বাইরে থাকা লোকও প্রার্থী হবেন। ভোটাররা এখনো চিন্তায় আছেন। সাধারণ ভোটারদের ভাবনায় অনেক কিছু আছে। তারা মনে করেন স্থানীয়ভাবে দলে যার ক্ষমতা বেশি, স্থানীয় ক্ষমতার আশীর্বাদ যার বেশি তিনি পাস হয়ে যাবেন। শক্তির বিপক্ষে গেলে নিজের ক্ষতি। শক্তিশালী প্রার্থী বেশি অপছন্দের হলে ভোটে না হয় না-ই গেলেন। একটি মাত্র দলের ভিতর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে ভোটারদের ভাবনা বেশি। ভোটে আগ্রহ কম তৈরি হচ্ছে। মানুষের ভোটের মাঠের অভিজ্ঞতা অনেক। তারা বিভিন্ন কার্যকলাপ দেখে অনেক কিছু বুঝে যান। অভিজ্ঞতা থেকে যা বলেন দেখা যায় তাই হয়। বিগত সংসদ নির্বাচনে আমার এলাকার অনেক মানুষ আমাদের আসন নিয়ে শুরু থেকে আমাকে একটি কথা বলে আসছিলেন। আমি তাদের উল্টো আশ্বস্ত করেছিলাম। পরে তাদের কথাই সত্যি হয়। অভিজ্ঞ মানুষেরা লক্ষণ দেখে বুঝতে পারেন। সত্যটাই তারা আগে বুঝে যান। অভিজ্ঞতা খুব মূল্যবান।

    বিভিন্ন স্থানে অনেক নমুনা দেখাও যাচ্ছে। নাটোরে এক প্রতিমন্ত্রীর আত্মীয়ের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়ে অপহরণের শিকার হতে হয়েছে। যদিও প্রতিমন্ত্রী নির্যাতিত সেই প্রার্থীর কাছে ছুটে গেছেন। তার শ্যালককেই পরে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে হয়েছে। জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে এক প্রার্থীর সভায় সরকারি দলের এক নেতা গরম বক্তৃতা দিয়েছেন। বলেছেন, এই এলাকায় অন্য প্রার্থী আসলে হাত-পা ভেঙে দেবেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই বক্তৃতা ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। একই স্থানের আরেক প্রার্থী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে গেছেন। অভিযোগ সমঝোতার কথা বলে তার কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। সেটার মাধ্যমে তার প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আবেদন দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ তিনি নির্বাচন করতে চান। সিইসি আবেদন-নিবেদন করে নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পারবেন না। ডিসি-এসপিদের স্থানীয় ক্ষমতাসীনদের থেকে আলাদা করতে হবে। তারা যদি নিরপেক্ষ হন নির্বাচন সুষ্ঠু হতে বাধ্য।

    নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব থাকে দুই ধরনের। একটি হচ্ছে- দল এবং ভোটারদের ওপর তাদের প্রভাব। আরেকটি হলো- প্রশাসনের ওপর প্রভাব। দলের এবং ভোটারের ওপর তাদের প্রভাব সিইসি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। দলের লোকজন এবং অনেক ভোটারের মন্ত্রী-এমপির কাছে অনেক প্রয়োজন থাকে। আরেক শ্রেণি এমনিতেই মন্ত্রী-এমপির প্রিয়ভাজন থাকতে চায়। তাদের পক্ষের নেতা-কর্মী থাকেন। থাকাটাই স্বাভাবিক। তারা রাজনীতি করেই মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন। মন্ত্রী-এমপিদের এ প্রভাব বন্ধে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক-মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কাজ করছেন। তিনি দলীয় সভানেত্রীর নির্দেশ পৌঁছে দিয়ে সবাইকে সাবধান করছেন। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় তিনি সাংগঠনিক পথে হাঁটছেন। তার প্রতিদিনের বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচনে তিনি আন্তরিক। এ কাজটি তাকেই করতে হবে। কারণ নির্বাচন কমিশন মন্ত্রী-এমপিদের এলাকার বাইরে রাখলেও তাদের দ্বারা দল এবং ভোটারদের প্রভাবিত করার সুযোগ আছে, করতে পারবেন। আরেকদিকে ভোটার হিসেবে মন্ত্রী-এমপিরাও ভোট দেবেন। কেন্দ্রে যাবেন। এখানে নির্বাচন কমিশনের বাধা দেওয়ার কিছু নেই। বিষয়টা রাজনৈতিকভাবেই শুধু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যদি করা যায়।

    মন্ত্রী-এমপিদের দ্বিতীয় যে প্রভাব- ডিসি-এসপি, প্রশাসনকে পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে প্রভাবিত করা। সেটা একমাত্র নির্বাচন কমিশন বন্ধ করতে পারে। তার জন্য সিইসিকে কঠোর হতে হবে। একটি জেলার ডিসি-এসপি যদি মনে করেন নির্বাচন নিরপেক্ষ করবেন, সেটা অবশ্যই সম্ভব। আর যদি তাদের অন্তর আর কথা এক না হয় তাহলে হবে না। মিডিয়ায় সুন্দর কথা বললেন আর ইউএনও সাহেবদের দিয়ে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের অন্য কথা জানিয়ে দিলেন, তাহলে শেষ। ওসিরা থানার সাব ইন্সপেক্টরদের দিয়ে বিভিন্নজনকে অন্য সুরে ফোন করা শুরু করলেন। তাহলেও সুষ্ঠু নির্বাচন শেষ। ডিসি সাহেব নিরপেক্ষ হলে নির্বাচনের দিন প্রার্থীদের ফোন রিসিভ করতে হবে। দুপুর ১২টার পরও যে কোনো প্রার্থীর ফোন রিসিভ করতে হবে। প্রার্থীদের কোনো অভিযোগ থাকলে সঙ্গে সঙ্গে সমাধান দিতে হবে। শুধু একজন প্রার্থীর ফোন রিসিভ করলে হবে না। তাহলে বোঝা যাবে তিনি প্রভাবশালীর দ্বারা প্রভাবিত। নির্বাচন তখন প্রভাবশালীদের পক্ষে চলে যাবে।

    সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সুদর্শন মানুষ। কথা বলেন সুন্দর উচ্চারণে। কঠোর কথা সরকারি কর্মকর্তাদের বলতে পারেন কি না জানি না। উপজেলা নির্বাচন নিয়ে তার আন্তরিকতা আছে বলে মনে হয়। অন্তত তার কথায় সেটা বোঝা যায়। তাকে জেলা প্রশাসকদের নিরপেক্ষ করতে হবে। এসপিদের নিরপেক্ষ করতে হবে। বোঝাতে হবে নির্বাচনের বিষয়ে তার কথা শুনতে হবে, ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের নয়। প্রয়োজনে দু-একটি নজির সৃষ্টি করতে হবে। নির্বাচন কমিশনাররা বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছেন। সভা করছেন। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে গরম কথা বলছেন। ভালো কথা। প্রার্থী এবং ভোটাররা তাদের বক্তব্যে ভরসা পাচ্ছেন কি না খোঁজ নেওয়া দরকার। শুধু কথায় মানুষ এখন আশ্বস্ত হয় না। কিছু উদাহরণ তৈরি করেন। মানুষ আশ্বস্ত হতেও পারে। সিইসি চাইলে নির্বাচন কমিশনারদের বিভাগ ভাগ করে দায়িত্ব দিতে পারেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিশনার সংশ্লিষ্ট বিভাগের সব প্রার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেন। প্রার্থীদের তার মোবাইল নম্বরসহ হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইমেইল ঠিকানা দেবেন যোগাযোগের জন্য। প্রার্থীরা স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা বঞ্চিত হলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। তাদের তাৎক্ষণিক নির্দেশে অনেক সমস্যারই সমাধান হবে। যেহেতু সারা দেশে চার ধাপে নির্বাচন হবে, কাজেই তারা এটি করতে পারেন। সুযোগ হয়েছে। সিইসি এবং নির্বাচনের মূল চ্যালেঞ্জ ডিসি-এসপিদের নির্বাচনে নিরপেক্ষ রাখা। যদি রাখতে পারেন নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। স্থানীয় প্রশাসন নিরপেক্ষ রাখতে পারলে সিইসি সফল হবেন। তবে শুধু আকুতি জানিয়ে হবে না। কঠোর হতে হবে।

    লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close