• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

এখন অপেক্ষা করুন পাঁচ বছর

প্রকাশ:  ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ০২:২২
নঈম নিজাম

১৯৮৫ সালের কথা। রাতের ট্রেন ধরতে আমরা কয়েক বন্ধু গিয়েছিলাম কমলাপুর স্টেশন। স্টেশনে প্রবেশ করে দেখি চোখের সামনে দিয়ে চট্টগ্রাম মেইল চলে যাচ্ছে। দৌড়ালাম ট্রেন ধরতে।

পারলাম না। স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। জানতে চাইলাম পরের ট্রেন কটায়। ঘুমচোখে মাস্টার বললেন, সকাল ৮টায়।

সে রাতে কেউ বাড়ি ফিরলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম স্টেশনে থেকে যাব। সকালে ট্রেন ধরতে সমস্যা হবে না। রাতের কমলাপুরে অনেক ছিন্নমূল মানুষ ঘুমিয়ে থাকে।

কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। চা খেলাম। সময় কাটছিল না। বেঞ্চে হেলান দিয়ে ঘুমানোর চিন্তা বাদ দিতে হলো। আমাদের একজন বলল, রাতের কমলাপুর ভয়ংকর।ঘুমানো যাবে না। একবার ঘুমিয়ে পড়লে পকেট সাফ হয়ে যাবে। চারপাশে সব চোর-বাটপাড় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের কাজ মানুষের পকেট সাফ করা। টাকাপয়সা হারালে গন্তব্যস্থলে যাওয়া হবে না। অতএব জেগে জেগে অপেক্ষা করো পরের ট্রেন ধরার জন্য।

জীবনের সেই কঠিন অভিজ্ঞতা এখন রাজনীতির নানামুখী হিসাবনিকাশে দেখছি। নির্বাচনি ট্রেন চলে গেছে। এখন অপেক্ষা করো। সেদিন একজন বললেন, আচ্ছা ভাই, মধ্যবর্তী নির্বাচন হবে নাকি দেশে? জানতে চাইলাম মধ্যবর্তী নির্বাচন কেন হবে? পাঁচ বছর আগে কে নির্বাচন দেবে? কেন দেবে? দেশে এমন কোনো জটিল অবস্থা নেই যার কারণে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে সরকারকে। নির্বাচনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবে সামনের দিকে যাচ্ছে। সরকার ধারাবাহিকভাবে নিজস্ব কাজগুলো করে চলেছে। গ্রামগঞ্জের মানুষ ব্যস্ত হচ্ছে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে। বিএনপি নির্বাচনের বিপক্ষে তাদের অবস্থান বহাল রেখেছে। উপজেলা নির্বাচনে না যেতে দলের নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দিচ্ছে। কিন্তু কেন্দ্রের নির্দেশ মাঠের কেউ মানছে না। মাঠের নেতারা অনেক এলাকায় নীরবে ভোটে অংশ নিচ্ছেন। বহিষ্কারের ভয়ও তাঁরা করছেন না। ভাবখানা এমন, তোমার নির্দেশ অনেক শুনেছি। আর না। অন্যদিকে মাঠে আওয়ামী লীগের রয়েছেন একাধিক প্রার্থী। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সাধারণ মানুষ আরেকটি ভোট নিয়ে ব্যস্ত হয়েছে।

এ দেশের মানুষ সব সময় ভোটমুখী। বিএনপি ভোটের ট্রেন প্রথম মিস করেছিল ২০১৪ সালে। চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তখন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। সারা দেশে রাজনৈতিক মাঠে শক্ত একটা অবস্থান ছিল দলটির। আন্দোলনের নামে বিভিন্ন জেলায় একক অবস্থান তৈরি করেছিল। আওয়ামী লীগ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে টেনশনে ছিল। সে নির্বাচন বর্জন ছিল বিএনপির প্রথম ভুল। ভোটের দিন সারা দেশে অরাজকতা তৈরি করেছিলেন দলটির নেতা-কর্মীরা। ভোটের পর পরিবেশ আরও ঘোলাটে করে তোলেন। বিএনপি ভেবেছিল তাদের আন্দোলনের মুখে সরকার বিদায় হবে। তারা নিজেদের মতো করে ক্ষমতায় আসবে। বিএনপির বুদ্ধিজীবী ও নেতাদের অনেকে বেগম জিয়াকে তখন পরামর্শ দিয়েছিলেন ভোটে না যেতে। তাঁদের যুক্তি ছিল, ভোটে গেলে বেগম জিয়ার আপসহীন ইমেজ থাকবে না। তিনি হয়ে উঠবেন আপসকামী। ভোটের বাক্স পুড়িয়ে আপসহীন হলো বিএনপি। জ্বালাও-পোড়াও, আগুনসন্ত্রাসের মামলা খেয়ে নেতারা গেলেন কারাগারে। কর্মীরা ভেঙে পড়লেন। তাঁরা মিছিল করে নেত্রীকে জেলগেট পর্যন্ত দিয়ে এলেন। সারা দুনিয়ায় এ ঘটনা নজিরবিহীন হিসেবে চিহ্নিত হলো। কারণ এভাবে কোনো নেতানেত্রীকে মিছিল করে কারাগারে দিয়ে আসার ঘটনা আর নেই।

২০১৮ সালে বিএনপি নেতা-কর্মীরা পলাতক জীবন থেকে ভোটে অংশ নিলেন। তাঁরা রাতের ভোটের অভিযোগ আনলেন। অল্প কয়েকজন বিজয়ী হলেন। বিএনপির নীতিনির্ধারক মহল নির্দেশ দিলেন শপথ না করতে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া বিএনপির নির্বাচিত এমপিরা সর্বোচ্চ মহলের কথা শুনলেন না। তাঁরা শপথ নিয়ে সংসদে গেলেন। দলের নির্দেশ মেনে বাইরে থাকলেন শুধু মির্জা ফখরুল।

২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন আবারও বর্জন করল বিএনপি। ভোটের আগেই তারা হুমকি দিয়েছিল ঢাকার রাজপথ দখলে নেবে। সরকারি দলকে কোনো ছাড় দেবে না। রাজপথে রক্ত ঝরলে সমস্যা নেই। মাঠ তারা নেবেই। পল্টনের সমাবেশ তারা নিয়ে গেল কাকরাইল মসজিদের দিকে। হামলা করল প্রধান বিচারপতির বাসভবনে। একজন পুলিশকে পিটিয়ে মারলেন বিএনপি কর্মীরা। এরপর তাঁরা হামলা করলেন সাংবাদিকদের ওপর। চারদিকে জটিল অবস্থা তৈরি হলো। পুলিশ হত্যার মামলায় বিএনপি নেতারা আটক হলেন। কারাগারে গেলেন। আবারও ভোট বর্জন করল বিএনপি। সরকারের দেখানো পথেই হাঁটল দলটি। নির্বাচন করলে বিএনপি ভালো করত। ৭০ থেকে ৮০টি আসন নিয়ে সংসদে থাকত। বেশিও পেতে পারত। এতে তাদের আবার ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ ছিল। এ নিয়ে বিএনপি ঘরানার একজন বললেন, মির্জা ফখরুল বিরোধী দলের নেতা হবেন, তাঁর গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়বে দলের মালিকরা তা মানবেন কেন? ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে।

দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অবশ্যই দরকার আছে। সব দলের অংশগ্রহণের একটি ভোট দরকার ছিল। বিএনপি ভোটে না গিয়ে ভুল করেছে। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল সরকারের একটা অংশ। সংসদ কার্যকর থাকলে রাষ্ট্রের এগিয়ে চলার পথ গতি পায়। ১৯৭৯ সালে কঠিন পরিস্থিতিতেও আওয়ামী লীগ ভোটে অংশ নিয়েছিল। ৩৯ আসনে বিজয়ী হয়েছিল। অন্যদিকে মিজান চৌধুরীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের আরেকটি অংশ পেয়েছিল দুটি আসন। জিয়াউর রহমানের আমলে সুষ্ঠু ভোট হবে না মাথায় রেখেই ভোটমুখী হয়েছিল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ ভোটের দল। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে ভোটে গিয়ে দেশটি স্বাধীন করার ম্যান্ডেট পেয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন আওয়ামী লীগকে ভোটবিমুখ করেনি। এরশাদের সামরিক শাসনের অবসানে আওয়ামী লীগ ১৯৮৬ সালেও ভোটে অংশ নিয়েছিল। ৭৬ আসন পেয়েছিল সে নির্বাচনে। ১৯৯১ ও ২০০১ সালের শত প্রতিকূলতার ভোট মেনে নিয়ে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের আসনে বসেছিল। আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে ভোটের মাধ্যমেই একমাত্র ক্ষমতার পরিবর্তন আসতে পারে। অন্য কোনোভাবে নয়।

কঠিন বাস্তবতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। রাজনীতি গতিশীল প্রক্রিয়া। একবার থমকে দাঁড়ালে অপেক্ষা করতে হয়। নির্বাচনি ট্রেন বিএনপির চোখের সামনে দিয়ে স্টেশন ছেড়ে চলে গেছে। এখন রেললাইন ধরে ট্রেনের পেছনে দৌড়ালে ক্লান্ত হওয়া ছাড়া কোনো ফল আসবে না। বিএনপিকে এখন অপেক্ষা করতে হবে। সে অপেক্ষার অবসান হবে আরও সাড়ে চার বছর পর। তখন আরেকটি ভোটের তোড়জোড় শুরু হবে। সে ভোট হয়তো অনেক প্রবীণ আর দেখে যেতে পারবেন না। বাংলাদেশের রাজনীতি তখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আমরা বলতে পারব না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন। তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বৈশ্বিক কঠিন সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ বিশ্বে নতুন উচ্চতা পেয়েছে। হোয়াইট হাউসের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ নিয়ে প্রশ্ন আসে। তার জবাবও দেওয়া হয়। বিবিসি, সিএনএনসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়া বাংলাদেশ নিয়ে খবর প্রকাশ করে। বাংলাদেশ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষের আলোচনা নেতিবাচকভাবে দেখি না। একটি দেশকে অনেক কাঠিন্য ভেদ করে উঠে দাঁড়াতে হয়। বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সমৃদ্ধ অর্থনীতির এ জনপদ নতুন পরিচয় বহন করছে বিশ্বমোড়লদের কাছে। এখন আর কেউ বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বলে না। বরং প্রশংসা করে বাংলাদেশের উন্নতি-সমৃদ্ধির।

শেখ হাসিনা গত পাঁচ বছর কঠিনতম অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন। কভিডকালে আমরা কীভাবে ঘুরে দাঁড়াব তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। টিকা নিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে অনেক মেরুকরণ ছিল। মানুষের খাওয়াপরা নিয়ে জটিলতা ছিল। বাংলাদেশ কভিডকালীন জটিল অর্থনীতি কাটিয়ে উঠেছে। মোকাবিলা করছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ঝামেলাও। সব কিছু এত সহজ ছিল না। শেখ হাসিনা সব সামলে উঠতে পারেন। তিনি সব সামাল দেন। এখন অর্থনীতি নিয়ে থাকা উৎকণ্ঠাও তিনি সামলে উঠবেন বলে বিশ্বাস করি। বিশ্বে এ মুহূর্তে তিনি সবচেয়ে প্রবীণ রাজনীতিবিদ। তিনি সবচেয়ে বেশি সময় একটি দলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিয়েছেন। সফলতার সঙ্গে দল পরিচালনা করেছেন। ক্ষমতার রাজনীতিতে প্রবেশ ১৯৮৬ সালে সংসদে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে। ১৯৯১ ও ২০০১ সালেও বিরোধী দলের নেতার পতাকা উড়িয়েছেন। এরশাদ-খালেদার কঠোরতম শাসন মোকাবিলা করেছেন। দল গুছিয়েছেন। চারবারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার নজিরবিহীন গৌরব অর্জন করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘরে জন্ম নিয়ে ছোটবেলায়ই রাজনীতি শিখেছেন। বাবার কারাবরণ দেখেছেন। জেলগেটে যখন তখন যেতে হতো। আবার মিন্টো রোডের মন্ত্রীর বাড়ি থেকে চলে গেছেন পুরান ঢাকার সাধারণ ভাড়া বাড়িতে।

ক্ষমতার ভিতর-বাইর দুটোই জন্মগতভাবে দেখেছেন শেখ হাসিনা। ক্ষমতার মসনদে বসে ইতিহাসের পাতায় বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতা দিয়েছেন। সারা দুনিয়ার ক্ষমতাবানদের চোখে তিনি এখন আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর বক্তব্য-বিবৃতি বিশ্বরাজনীতিবিদরা গুরুত্বের সঙ্গে নেন। তাঁকে বাদ দিয়ে এখন অনেক কিছু অসম্ভব। উন্নত বিশ্ব বাংলাদেশের তাক লাগানো উন্নতির প্রশংসা করছে। তার পরও কিছু মানুষ ভালোটা খুঁজে পায় না। চারদিকে শুধুই খারাপ দেখে। সুযোগ পেলেই সমালোচনার ঝড় বইয়ে দেয়। কঠিন বাস্তবতা পাশ কাটিয়ে শুধু সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিলে চলবে না। শুধু সমাজমাধ্যমের কুৎসা ও রাজনৈতিক সমালোচনায় সরতে হলে আওয়ামী লীগ এত বছর ক্ষমতায় থাকতে পারত না। এখনকার স্বাভাবিক পরিবেশ অস্বাভাবিক করা যাবে না। শেখ হাসিনা জানেন সব সামলে নেন। তাঁর সামনে এখন অর্থনীতির গতি বাড়ানো। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে সেদিকে জোর দিয়েছেন। আগামী সাড়ে চার বছর নিজের অসমাপ্ত উন্নয়ন কাজগুলো শেষ করার পর এ দেশ আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে। থেমে থাকার সুযোগ নেই। ছোটখাটো ষড়যন্ত্র সব সময় ছিল। এখনো আছে। মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা আছে, থাকবে। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার প্রভাব আমাদের আঘাত করে যাবে আরও। ঝামেলা থাকলেও এসব সামলানো কঠিন কিছু নয়। আগামী সাড়ে চার বছর সরকারের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ সব সামলিয়ে এগিয়ে যাওয়া। উন্নয়ন ধারাবাহিকতা ধরে রাখা। অন্য কিছু নয়।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

নঈম নিজাম
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close