• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

নায়িকা এবং একটা মাকড়সার গল্প

প্রকাশ:  ২২ আগস্ট ২০২২, ০৫:১৮
সোহেল অটল

মাকড়সার গল্পটা পরে বলি। আগে নায়িকা সংবাদ পরিবেশন করি।

বছর কয়েক আগের কথা। একটা চলচ্চিত্রের শুটিং করতে ইউনিট গিয়েছে উত্তরবঙ্গে। যাওয়ার আগে পরিচালককে পই পই করে নায়িকা বলে দিয়েছেন, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দিতে না পারলে তিনি শুটিং করবেন না। প্যাক-আপ করে চলে আসবেন।

গাও-গেরামে শুটিং। শহুরে সুযোগ-সুবিধা সেখানে অপ্রতুল। কিন্তু গল্পের প্রয়োজনে শুটিং সেখানেই করতে হবে।

বিরাট ঝক্কি-ঝামেলা করে পরিচালক নায়িকার জন্য সব আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করলেন। নায়িকা হাই কমোড ছাড়া শৌচাগার ব্যবহার করতে পারেন না। পরিচালক ঢাকা থেকে পোর্টএবল হাই কমোড কিনে নিয়ে গেলেন। এয়ার কন্ডিশনার-এর ব্যবস্থা করতে শক্তিশালী জেনারেটর ভাড়া নিলেন। আরো যা যা না থাকলে নায়িকা নাখোশ হতে পারেন, তার ব্যবস্থাও করলেন।

বলা বাহুল্য, এই নায়িকা-ই ‘নায়িকা‘ হওয়ার আগে যে জীবনটা কাটিয়েছেন, সেখানে হাই কমোড কিংবা এয়ার কন্ডিশনারের অস্তিত্ব ছিল না।

যাহোক, ঢাকা থেকে রওনা হওয়ার আগে নায়িকা টেক্সট করলেন পরিচালককে। কোন বেলায় কী খেতে তার পছন্দ, তার একটা লিস্ট পাঠালেন।

পরিচালক সে লিস্ট দেখে ঢাকা থেকে স্পেশাল শেফ তুলে নিয়ে গেলেন উত্তরবঙ্গে।

শুটিং স্পটে পৌঁছে নায়িকা ঘুরে ঘুরে সব দেখলেন। তারপর সবুজ সংকেত দেয়ার পর শুরু হলো শুটিং। পরিচালক বেচারা ভাবলেন-- এ যাত্রায় তিনি রক্ষা পেয়েছেন।

কিন্তু না। গোল বাঁধল নায়িকার গোসল করার সময়।

নায়িকা দেখলেন, গোসলের জন্য পরিচালক ডিপ টিউবওয়েলের পানির ব্যবস্থা করেছেন। মুহূর্তে নায়িকার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। হওয়ারই কথা। নায়িকা বলে কথা। ডিপ টিউবওয়েলের পানি দিয়ে তিনি গোসল করবেন, এটা আবার হয় নাকি? তাও কোনো বাথটাব নেই।

রাগে-ক্ষোভে-অপমানে নায়িকার শরীর কেঁপে উঠল। ওই কাঁপা কাঁপা শরীরে তিনি চিৎকার দিয়ে উঠলেন-- প্যাক আপ!

পরিচালকের অবস্থা হলো এবার দেখার মতো। পড়িমরি করে ছুটে এলেন নায়িকার কাছে। কী হয়েছে? কোথায় খামতি পেয়েছেন? হুকুম করুন জনাবা, এখনি সব ঠিক করে দিচ্ছি!

আঙ্গুলের ইশারায় নায়িকা বুঝিয়ে দিলেন, বিএসটিআই সার্টিফায়েড জলাধারের ব্যবস্থা না করে পরিচালক তাকে অপমান করেছেন। এই অপমানের একমাত্র শাস্তি-- প্যাক-আপ। নায়িকা ফিরে যাবেন ঢাকা।

এই অভিযোগ মাথা পেতে নেওয়া ছাড়া পরিচালকের গতি ছিল না। নায়িকা শুটিং ছেড়ে চলে যাওয়া মানে লাখ লাখ টাকার ক্ষতি।

ব্যবস্থা হলো। কী ব্যবস্থা? আশে-পাশের দোকান থেকে বিএসটিআই অনুমোদিত সমস্ত মিনারেল ওয়াটারের বোতল কিনে আনা হলো। সেই বোতলের পানিতে গা ভেজালেন নায়িকা। তাতে কিছু তার মনও ভিজল। শুটিং চালিয়ে যেতে সদয় সম্মতি দিলেন। যতদিন ওখানে তারা শুটিং করেছিলেন, ততোদিন ওই বোতলজাত মেনারেল ওয়াটার দিয়েই তিনি গোসল সেরেছেন।

এবার আরেকজন নায়িকার গল্প শুনুন।

ইনি বলিউড অভিনেত্রী লারা দত্ত। সাবেক বিশ্ব সুন্দরী।

লারা দত্ত অভিনীত ‘বিল্লু বারবার‘ মুভির বেশিরভাগ শুটিং হয়েছিল তামিল নাড়–র পোল্লাচি নামের এক গ্রামে। পাহাড়তলী এক কৃষিভূমির গ্রাম পোল্লাচি। আধুনিক সুযোগ-সুবিধার অনেক কিছু সেখানেও ছিল না। তবে বলিউডের শুটিং ইউনিট শতভাগ পেশাদার। তাদের আয়োজনেও পেশাদারিত্ব থাকে।

‘বিল্লু বারবার‘ মুভি যারা দেখেছেন তারা জানেন, গ্রামের এক হতদরিদ্র নাপিতের বউ হিসেবে অভিনয় করেছেন লারা দত্ত। মুভিটিতে কাস্ট হওয়ার পর শুটিং শুরুর আগে একাধিকবার তিনি পোল্লাচি গ্রামে গিয়েছেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশেছেন। এমনকি, ওখানকার মানুষের জীবনাচার বোঝার জন্য কিছুদিন তাদের সঙ্গে, তাদের বাড়িতে কাটিয়েছেনও।

রেড চিলি প্রোডাকশনের এই মুভিটির প্রযোজক ছিলেন গৌরি খান। লারাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন গৌরি, শুটিং এর আগে পোল্লাচি গ্রামে অবস্থানের জন্য কোন কোন সুবিধা তার দরকার। লারা বলেছিলেন, সুবিধা নিয়ে অবস্থান করলে তো আমি নাপিতের বউ হতে পারব না। আমি ওখানকার মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামটা বুঝতে চাই। দেখতে চাই কিভাবে তাদের দিন কাটে, রাত কাটে।

লারা দত্ত সেটাই করেছিলেন। তার রেজাল্ট কী হয়েছিল, তাও আমরা জানি। মুভিতে ইরফান খানের পাশাপাশি তুমুল প্রসংশিত হয় লারার পারফর্মেন্সও।

বলিউডে এমন পেশাদারিত্বের গল্প অনেক আছে। প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর ক্যারিয়ারেই এমন গল্পের ছড়াছড়ি।

উল্টোদিকে মিনারেল ওয়াটার দিয়ে গোসল করার গল্পও অনেক আছে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে। নায়িকাদের খামখেয়ালিপনা, অপেশাদার রঙ-ঢঙে ত্যক্ত-বিরক্ত অনেক পরিচালকের মুখে পরিচালনা ছেড়ে দেয়ার মত হতাশার কথাও শুনেছি। হতাশা বেরিয়ে এসেছে অনেক প্রযোজকের মুখ থেকেও।

কিন্তু এবার যেটা হলো, হচ্ছে-- তাতে থলের বিড়াল তো বিরাট চিৎকার চেঁচামেচি করে বেরিয়ে আসছে।

সরাকারি অনুদানের টাকায় নির্মিত ‘আশীর্বাদ‘ চলচ্চিত্রের সহ-প্রযোজক জেনিফার ফেরদৌস এবং এই মুভির অভিনেত্রী মাহিয়া মাহির অভিযোগে বেশ রসালো হাওয়া লেগেছে। নায়িকার অপেশাদার আচরণ নিয়ে মুখ খুলেছেন প্রযোজক। শুটিং চলাকালে নানাভাবে তাকে ব্লাকমেইলের গল্প শোনা যাচ্ছে।

বাংলাদেশে নায়িকাদের পেশাদারিত্বের যে টলমলে অবস্থা, তাতে প্রযোজকের কথা অবিশ্বাসের কোনো কারণ নেই। এতদিন কোনো প্রযোজক মুখ ফুটে বলেননি তাই হয়তো এসব সমস্যা নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা হয়নি। কিন্তু জেনিফার ফেরদৌস প্রকাশ্যে তার মুভির অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। আর পুরো ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে ছবির পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান মানিক শুটিং চলাকালে প্রথম গল্পের পরিচালকের মতোই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। বেশিরভাগ পরিচালকের মতোই নায়িকা বশ করার সাধ্য তারও ছিল না।

মাকড়সার গল্পটা এবার বলি।

‘প্যাকেজ সংবাদ‘ নামের এক জনপ্রিয় নাটক বানিয়েছিলেন প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ। সেখানে নায়িকা নামক ‘বস্তু‘ কতটা বিরক্তিকর হতে পারে দেখা গিয়েছিল। নায়িকার অপেশাদার আচরণ পুরো শুটিং ইউনিটকে কতটা অতিষ্ঠ করে তুলতে পারে, তা এই নাটকে দেখা যায়।

‘প্যাকেজ সংবাদ‘ নাটকের গল্পে মামা-ভাগ্নে একটি প্যাকেজ নাটক বানানোর জন্য নায়িকা শমী ম্যাডামের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শমী ম্যাডামের মা সম্ভব-অসম্ভব নানান শর্ত দেন। তার মধ্যে একটা শর্ত ছিল-- শুটিং স্পটে মাকড়সা থাকা চলবে না। একটাও না। থাকলে শুটিং প্যাক-আপ করে শমী ম্যাডাম চলে যাবেন।

ঘটনাক্রমে শুটিং স্পটে মাকড়সা পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য, শমী ম্যাডাম তার মা, কাজের বুয়া এবং বিউটিশিয়ান নিয়ে শুটিং স্পট ত্যাগ করেন। এতগুলো মানুষের পরিশ্রম, একগাদা বিনিয়োগ-- কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেননি নাটকের শমী ম্যাডাম।

‘আশীর্বাদ‘ মুভির শুটিংয়ের গল্প শুনে ‘প্যাকেজ সংবাদ‘ নাটকের শমী ম্যাডামের কথাই বারবার মনে হয়েছে। মাহিয়া মাহির ‘চুলকানি‘ রোগের কারণে নাকি শুটিং প্যাক-আপ করতে হয়েছিল। আহা নায়িকা!

একটা বিশ্রী, অপেশাদার রীতি শিল্পীরা চর্চা করে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। এসব বন্ধ হওয়া উচিত। কারো মিষ্টি কথায় না ভুলে পরিচালক-প্রযোজকদের অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে শোনা উচিত। দেশের চলচ্চিত্র একটা নতুন যুগে প্রবেশের অপেক্ষায় আছে। এখনই সব মাকড়সা ঝেটিয়ে বিদায় না করলে শুটিং প্যাক-আপ হতেই থাকবে।

সোহেল অটল: সাংবাদিক ও লেখক

[email protected]

পূর্বপশ্চিম- এনই

সোহেল অটল,নায়িকা,নায়িকা সংবাদ
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close