• মঙ্গলবার, ২৫ জুন ২০২৪, ১১ আষাঢ় ১৪৩১
  • ||

চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি, তবু গরুর দাম কেন চড়া?

প্রকাশ:  ১৫ জুন ২০২৪, ২০:০৬
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

পাঁচ বছর ধরে গবাদি পশু উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বলে জানিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। গবাদি পশুর সঙ্গে দুগ্ধ ও মাংস উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে দেশ। কিন্তু তবুও কোরবানির হাটে পশুর দাম বেশ চড়া।

২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর গরু রপ্তানি নিষিদ্ধ করে। এরপরই মূলত বাংলাদেশে গরুর খামারের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এখন দেশে ছোট-বড় মিলয়ে ২০ লাখের মতো খামার আছে রয়েছে।

২০১৯ সালে গবাদি পশুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে বাংলাদেশ। সেই থেকে আর কখনোই কোরবানির সময় গরুর সংকট হয়নি। ভারত বা মিয়ানমার থেকে গরু আনতে হয়নি। তবে গত কয়েক বছর ধরে দেখা গেছে, ঈদের আগের দিনগুলোতে গরুর দাম স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায়।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক ডয়চে ভেলেকে জানান, এবার কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা এক কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭টি। যা চাহিদার চেয়ে প্রায় ২৩ লাখ বেশি। এ সংখ্যা গত বছরের চেয়েও চার লাখ ৪৪ হাজার ৩৪টি বেশি। ফলে এবার কোরবানির পশুর কোনো সংকট নেই।

তারপরও গরুর দাম কেন বেশি?

হাটে পশুর দাম বেশি হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও স্বপ্নসাজ এগ্রোর স্বত্বাধিকারী শাহ ইমরান বলেন, “গত তিন থেকে চার বছরে গো খাদ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। বছরজুড়ে একটা গরু পালতে যে খরচ হয়, সেই তুলনায় এখন বাংলাদেশে গরুর দাম কম। গরু বিক্রি করে খামারিদের খুব বেশি লাভ করার সুযোগ নেই।”

তিনি আরও বলেন, “সাধারণ সময়ে আপনি যে দামে মাংস কেনেন, কোরবানির সময়ও গরুর দাম একই থাকে। বরং কখনো কখনো আমাদের লোকসান গুণতে হয়। শেষ মুহূর্তে দাম না পেলেও গরু বিক্রি করে দিতে হয়। কারণ, গরুটা কোরবানিতে বিক্রি করতে না পারলে আবারও তার পেছনে খরচ করতে হবে।”

গরু বিক্রি করে যদি লোকসান হয় তাহলে এত খামার কেন গড়ে উঠেছে-এমন প্রশ্নের জবাবে শাহ ইমরান বলেন, “একটা খামারে তো শুধু কোরবানির জন্য গরু পালা হয় না। সেখানে দুধ উৎপাদন হয়। এর সঙ্গে দুধের নানা জিনিস তৈরি হয়। এগুলো থেকেই মূলত খরচ ওঠে আসে। শুধু গরু পালন করে খামার বাঁচানো সম্ভব না।”

প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ডা. এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, “আমরা গরুর কিছু জাত নিজেদের মতো তৈরি করেছি। যে গরুগুলো পালতে খরচ অনেক কম হয়৷।এই গরুগুলো কম খায়। তাদের গ্রোথ ভালো। এগুলো আমরা সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার চিন্তা করছি। এই জাতের গরু পালন বাড়লে খরচ অনেক কমে আসবে।”

এ বছর রাজধানীতে ২০টি গরুর হাটের অনুমোদন দিয়েছে দুই সিটি কর্পোরেশন। ইতোমধ্যে এসব হাটে বিক্রি শুরু হয়েছে। পল্লবীর ইস্টার্ন হাউজিংয়ে গরুর হাটের ইজারা পেয়েছেন তাজু উদ্দিন।

তিনি বলেন, “এবার দাম খুব বেশি না। এখন পর্যন্ত সেভাবে বিক্রি শুরু হয়নি। তবে বিক্রেতারা যে দাম চাচ্ছেন সেটা খুব বেশি বলে মনে হচ্ছে না। আমাদের হাটে ইতোমধ্যে এক হাজারেরও বেশি গরু এসেছে। তবে ছোট গরুতেই মানুষের আগ্রহ বেশি বলে মনে হচ্ছে।”

গত কয়েক বছর ধরে কোরবানি ঈদের আগে সীমান্তে কড়াকড়ি থাকায় চোরাইপথে কোনো পশু আসেনি। তবে এ বছর সীমান্ত অনেকটাই ঢিলেঢালা থাকার অভিযোগ রয়েছে। এই সুযোগে কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া, রামু, চকরিয়া; বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি; সিলেট, কুমিল্লা, লালমনিরহাটসহ ছয় জেলার ৩৮ সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ভারত ও মিয়ানমার থেকে সবচেয়ে বেশি পশু ঢুকেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। একদিকে পশুখাদ্যের উচ্চমূল্য, তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়তি যত্নের জন্য বেশি উৎপাদন খরচ এবং ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে খামারিরা অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারওপর চোরাইপথে গরু আসতে থাকলে খামারিরা আরও ক্ষতির মুখে পড়বেন বলে শঙ্কা রয়েছে।

ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইমরান হোসেন বলেন, “২০১৪ সালে যখন ভারত গরু রপ্তানি বন্ধ করে দিল, তখন তো আমাদের ভয়াবহ সংকট হয়েছিল। এরপর সরকারের সহযোগিতায় ডেইরি ফার্মগুলো গড়ে উঠেছে। ২০১৪ সালে আমাদের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ছিল ৩৫%। আর ৬৫% ভারত ও মিয়ানমার থেকে আসত।”

২০১৯ সালে থেকে দেশে গরু আমদানির প্রয়োজন হয় না জানিয়ে তিনি বলেন,“‘আমাদের এখন সাড়ে ৩ লাখের মতো ডেইরি ফার্ম আছে। তারা দুধ উৎপাদন করে। আর আড়াই লাখের মতো ফার্ম আছে যারা মাংস নিয়ে কাজ করে। দেশে ফার্মগুলো গড়ে উঠায় যে উপকারটা হয়েছে, সেটা হলো আমাদের বছরে এক কোটি ৫৫ লাখ মেট্রিকটন দুধের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে ১ কোটি ৪০ লাখ মেট্রিকটন দুধ আমরা উৎপাদন করতে সক্ষম। আমাদের ঘাটতি আছে মাত্র ১৬%।”

দেশে এখন ৮৪ লাখ মেট্রিক টন মাংসের প্রয়োজন হয় জানান ইমরান হোসেন। তিনি বলেন, “কিন্তু আমরা ৮৯ লাখ মেট্রিকটন মাংস উৎপাদন করছি। এরপরও যদি চোরাই পথে গরু আসে তাহলে খামারিরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। শুধু খামারিরা না, প্রান্তিক কৃষকও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।”

তবে চোরাইপথে গরু আসার কথা মানতে রাজি নন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক। তিনি বলেন, “যেখানে আমরাই স্বয়ংসম্পূর্ণ সেখানে এগুলো এনে কোথায় বিক্রি করবে? এটা তো আর স্বর্ণ না যে বিক্রি না হলে ঘরে রেখে দিলাম। গরু বিক্রি না হলে তাকে তো খাওয়াতে হবে, পালতে হবে। ফলে আমার মনে হয় না খুব বেশি গরু সীমান্ত দিয়ে আসছে৷ তবে টুকটাক যে আসছে না, সেটাও আমি বলব না।”

করোনাভাইরাস মহামারির পর সরকারের আইসিটি বিভাগ ও ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে ডিজিটাল গরুর হাটের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথম বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে নানা অভিযোগের পরও অনলাইনে ৪৫ হাজার কোরবানির পশু বিক্রি হয়েছিল। ২০২১ সালে অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি হয় ৩ লাখ ৮৭ হাজারের মতো। এরপর থেকে আবার কমতে শুরু করে। ২০২২ সালে তা কমে হয় ৬৬ হাজার। পরের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে ৪৮ হাজারেরও কম পশু অনলাইনে বিক্রি হয়েছে।

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নাসিমা আক্তার নিশা বলেন, ‘‘করোনার সময় তো মানুষ দূরত্ব মেনে চলেছেন, এ কারণে বেশি বিক্রি হয়েছে। আসলে কোরবানি তো আমাদের আবেগের সঙ্গে জড়িত। কোরবানির পশু কিনতে অনেকে ছেলে-মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যান। ১০টা গরু দেখে একটা কেনেন। এ কারণে আসলে অনলাইনে গরু কেনাবেচায় আগ্রহ কমে যাচ্ছে। তারপরও বড় বড় ফার্মগুলো নিজেরাই অনলাইনে বিক্রি করছে। এজন্য আমরা এবার আর ডিজিটাল হাট করিনি।”

সাভার ডেইরি ফার্মের স্বত্বাধিকারী মো. খালেদ বলেন, “এখানে আস্থার একটা সংকট আছে। কেউ অনলাইনে একটা গরু দেখে কিনল, সেই গরু পরিবহনের সময় অনেক ক্ষেত্রে ওজন ৫-৭ কেজি কমে যায়। কিন্তু ক্রেতা মনে করলেন তাকে ঠকানো হয়েছে। এছাড়াও ঈদের আগে সড়কে চাঁদাবাজি এবং মহাসড়কে যানজট এই কাজকে আরও কঠিন করে তুলেছে। সবকিছু মিলিয়ে অনলাইনে মানুষের আগ্রহ কমে যাচ্ছে।”

তিনি বলেন, “গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে অনলাইনে আমরা ১৭৪টি পশু বিক্রি করেছি। ২০২২ সালে বিক্রি হয়েছিল ১৫০টি। তবে ২০২১ সালে প্রায় এক হাজারের কাছাকাছি পশু অনলাইনে বিক্রি হয়েছিল। তবে অনলাইনে মানুষের আগ্রহ কমে যাচ্ছে।”

মাংস,ঈদ-উল-আজহা,গরু
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close