• মঙ্গলবার, ২৫ জুন ২০২৪, ১১ আষাঢ় ১৪৩১
  • ||

সেন্টমার্টিনের উপকূলে জেটি ঘাট নির্মাণের পরামর্শ

প্রকাশ:  ১৫ জুন ২০২৪, ১৮:৫৫
নিজস্ব প্রতিবেদক

মিয়ানমারে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সে দেশের সরকারি বাহিনীর সংঘাতের মধ্যে গত কিছু দিন ধরে বাংলাদেশ সীমান্তে নাফ নদীতে চলাচলরত নৌযান লক্ষ্য করে গোলা ও গুলিবর্ষণ করা হয়েছে ও-পাড় থেকে। এ কারণে গত সাতদিন সেন্টমার্টিনে নৌযান চলাচল বন্ধ থাকায় দ্বীপবাসী খাবারসহ নানামুখি সংকটে পড়েছেন। এমনকি তাদের যাওয়া-আসাও বন্ধ হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে আপৎকালীন সমস্যা সমাধানে উপকূলে জেটি ঘাট নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য মতে, আনুমানিক প্রায় এক দশক পূর্বে সেন্টমার্টিন দ্বীপসংলগ্ন স্থানে বঙ্গোপসাগরের মাঝে দুটি স্থানে বালুচর জেগে ওঠে। এই দুটি বালুচরের কারণে ভাটার সময় সেন্টমার্টিনে চলাচলকারী যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযানগুলো সাগরের ভেতর মিয়ানমারের একটি অংশ দীর্ঘদিন ব্যবহার করে আসছে। মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সঙ্গে বাংলাদেশের বিজিবির সমন্বয়ের কারণে এই চলাচলে ইতিপূর্বে কখনো বাধার সৃষ্টি হয়নি। তবে সাম্প্রতিক অতীতে আরাকান আর্মি মিয়ানমারের এই অঞ্চল দখল করে নেয়ার কারণে সৃষ্ট সমন্বয়হীনতার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের সেন্টমার্টিনগামী ট্রলার ও নৌযানগুলো লক্ষ্য করে আরাকান আর্মি গুলি ছুড়ছে। ফলে কর্তৃপক্ষ ওই রুটে বাণিজ্যিক ট্রলার ও স্পিডবোট চলাচল সাময়িক স্থগিত করে। এ কারণে সেন্টমার্টিনে বসবাসকারীদের খাদ্যসংকট তৈরি হয়। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা সমালোচনা চলছে।

জানা যায়, কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় নাফ নদী এবং বঙ্গোপসাগরের মোহনায় গোলারচর নামক এলাকায় আনুমানিক ২ কিলোমিটারজুড়ে বড় বালুর চর এবং গোলারচর থেকে আনুমানিক ৫-৭ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের মধ্যবর্তী স্থানে নাইক্ষ্যংদিয়ায় ১ কিলোমিটারের মধ্যে আরো একটি বালুর চর ভাটার সময় জেগে ওঠে। ফলে টেকনাফ দমদমিয়া কেয়ারী জেটিঘাট থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে যাত্রা করা যাত্রী ও পণ্যবাহী জাহাজ, মাছ ধরার ট্রলার, সার্ভিস বোট এবং স্পিডবোটসহ সব ধরনের নৌযানগুলোকে গমনাগমনের সময় জেগে ওঠা বালুর চরের কারণে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম বাউন্ডারি লাইনের (আইএমবিএল) মিয়ানমার অংশের নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকা ব্যবহার করতে হয়। উল্লিখিত চর দুটি ড্রেজিং করা হলে মিয়ানমারের জলসীমা ব্যবহারের প্রয়োজন হবে না।

সেন্টমার্টিনে চলাচল নিয়ে সাম্প্রতিক অতীতে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা:

গত ১ জুন বিকাল সাড়ে ৩টায় টেকনাফ পৌরসভার নৌকা ঘাট থেকে ১টি ট্রলার সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে মুদি মালামাল ও ১০ জন যাত্রী নিয়ে ছেড়ে যায়। আনুমানিক বিকাল সাড়ে ৪টার সময় নাইক্ষ্যদিয়া খাল এলাকা অতিক্রমের সময় আরাকান আর্মি ট্রলার লক্ষ্য করে ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে ৬-৭ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ট্রলারটি বিকাল ৫টা ৫৫ মিনিটে সেন্টমার্টিন দ্বীপে নিরাপদে পৌঁছে।

গত ৫ জুন সেন্টমার্টিনের জিনজিরায় স্থগিতকৃত একটি কেন্দ্রে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদের ফলাফল নির্ধারণের জন্য ভোট গ্রহণ করা হয়। অনুষ্ঠান শেষে বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিটের দিকে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট শাফকাত আলীর নেতৃত্বে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মোট ২৭ জন সেন্টমার্টিন থেকে টেকনাফের উদ্দেশে মেটাল শার্ক ও কাঠের বোটযোগে টেকনাফে ফিরছিলেন। পথে নাফ নদী এবং বঙ্গোপসাগরের মোহনায় নাইক্ষ্যংদিয়া চর এলাকা অতিক্রম করার সময় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের মেগিচং এলাকা থেকে মেটাল শার্ক ও বোট লক্ষ্য করে আরাকান আর্মি গুলিবর্ষণ করলে মেটাল শার্কে ২ রাউন্ড এবং বোটে ৪ রাউন্ড গুলি লাগে। এতে কেউ হতাহত না হলেও পরে বোট এবং মেটাল শার্ক দুটি নিরাপদে টেকনাফ কোস্টগার্ডের বোটপুলে ফিরে আসে।

গত ৮ জুন আনুমানিক ১২টার দিকে নাইক্ষ্যংদিয়া খাল সীমান্তে নাফ নদীর মোহনায় ২টি কাঠের ট্রলার, টেকনাফ পৌরসভাস্থ কাউকখালী ঘাট থেকে সিমেন্ট, রড ও ৬ জন যাত্রী নিয়ে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে রওনা হয়। পথে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের মেগিচং ক্যাম্পের ওয়াচ টাওয়ার থেকে আরাকান আর্মি কর্তৃক তাদের ওপর আনুমানিক ১৫-২০ রাউন্ড গুলি করা হয়। পরে ট্রলার দুটি শাহপরীর দ্বীপ জেটিঘাটে ফিরে আসে। এ ঘটনায় ১টি ট্রলারে ৭ রাউন্ড গুলি আঘাত হানে। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

১১ জুন সকাল ১০টা ৩০ মিনিটের দিকে টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের গোলারচরের বিপরীতে মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া খাল সীমান্তে নাফ নদীর মোহনা হয়ে একটি স্পিডবোটযোগে সেন্টমার্টিনের ৫ জন স্থানীয় শাহপরীর দ্বীপ জেটি থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে রওনা হয়। পথে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের মেগিচং বিজিপি ক্যাম্পের ওয়াচ টাওয়ার এলাকা থেকে আরাকান আর্মি স্পিডবোট লক্ষ্য আনুমানিক ৪-৫ রাউন্ড গুলি করে। এতে স্পিডবোটে অবস্থানরতরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ১১টার দিকে স্পিডবোটটি সেন্টমার্টিনে পৌঁছায়।

উপরিউক্ত গুলিবর্ষণের ঘটনাসমূহের কারণে বিগত কয়েকদিন টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে নৌযান চলাচল বন্ধ থাকার কারণে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে।

উল্লেখ্য, সেন্টমার্টিন দ্বীপের লোকসংখ্যা ৮ হাজার ৪৯২ জন। জেলা ও উপজেলা পর্যায় থেকে খাদ্য/পণ্য সরবরাহ করা না গেলে এই দ্বীপের বাসিন্দারা খাদ্য সংকটে পড়েন। কারণ, সেন্টমার্টিনের সাধারণ জনগণ মূলত টেকনাফ থেকে খাদ্যপণ্য নিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপে জীবন-যাপন করেন। বিরাজমান পরিস্থিতিতে গত ১৩ জুন থেকে কক্সবাজার বিআইডব্লিউটিএ ঘাট থেকে বঙ্গোপসাগর হয়ে বড় বড় ট্রলারে সেন্টমার্টিনে পণ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখা হচ্ছে।

জানা যায়, নৌযান চলাচল স্থগিত এবং খাদ্য সংকটের পাশাপাশি মিয়ানমার নৌবাহিনীর টহল বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্বীপটির স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমতাবস্থায় প্রশাসন কর্তৃক দ্বীপের স্থানীয়দের আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

এর পাশাপাশি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত গুলিবর্ষণের ঘটনা রোধকল্পে আরাকান আর্মির সঙ্গে প্রয়োজনীয় সমন্বয়সাধনের উদ্যোগ নিতে পারেন।

এ ছাড়াও সমস্যাটির স্থায়ী সমাধানের জন্য টেকনাফের সাবরাং টুরিজ্যম ইকো পার্ক সংলগ্ন সাগর উপকূলে একটি জেটি ঘাট নির্মাণ করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, টেকনাফের সাবরাং ইকো পার্ক বিচ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের দূরত্ব আনুমানিক ২৪ কিলোমিটার। অপরদিকে বর্তমান জেটিঘাট (দমদমিয়া কেয়ারী জেটিঘাট) থেকে সেন্টমার্টিনের দূরত্ব আনুমানিক ৩৪ কিলোমিটার।

সংস্থাটির মতে, টেকনাফের সাবরাং টুরিজ্যম ইকো পার্ক সংলগ্ন সাগর উপকূলে জেটি ঘাট নির্মাণ করা হলে সেন্টমার্টিনের সঙ্গে টেকনাফের যোগাযোগ সহজ ও কম সময়ে সম্পন্ন হবে এবং স্থানীয় জেলে, পর্যটক ও সেন্টমার্টিনের স্থানীয় বাসিন্দাদের টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে গমনাগমন নিরাপদ হবে।

উপকূল,সেন্টমার্টিন,জেটি ঘাট
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close