• রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

এডগার এলেন পো’র হরর গল্প

হানাবাড়ির আতঙ্ক

প্রকাশ:  ১৫ এপ্রিল ২০২২, ২৩:১০ | আপডেট : ১৫ এপ্রিল ২০২২, ২৩:১৮
রূপান্তর: বিপুল হাসান

বছরের শেষ মাসের ওই দিনটি ছিল গাঢ় কুয়াশাচ্ছন্ন। সূর্যের মুখ দিনভর দেখা যায়নি। শীতে কুকড়ে যাওয়া লোকগুলো ঘরে বন্দি, চারপাশ নিস্তব্ধ। ঘোড়ায় চড়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ ইউশার বাড়ির সামনে এসে থামলাম। বাড়িটির দিকে চোখ পড়তেই এর দূর্দশায় মনটা আমার ভেঙে গেল। কাটালতা আর মরাগাছ ঘিরে রেখেছে বাড়ির চারপাশ। ঠিক যেন একটা হানাবাড়ি। কোথাও নেই প্রাণের চিহ্ন। ভেতরে শীতল অনুভূতি নাড়া দেয় আমাকে। প্রশ্ন জাগে মনে, ভয়াল কিছু কি আছে ওই বাড়িতে?

ছমছমে এই বাড়ির মালিকের নাম রডেরিক ইউশার। সে আমার ছেলেবেলার বন্ধু। বহুদিন ধরে আমাদের আর দেখা সাক্ষাত হয়নি। সম্প্রতি সে আমাকে একটা চিঠি লিখে জানিয়েছে যে, আমি যেন তার সঙ্গে অচিরেই দেখা করি। চিঠিতে এমন এক হৃদয়ের স্পর্শ ছিল যে, আমার পক্ষে তা উপেক্ষা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু বাড়ির সামনে এসে মনটাই ভেঙ্গে গেল, মনে হলো এ যেন এক মৃত হানাবাড়ি।

বাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে গেছে সরু একটি লেক। সেই লেকের পানি কালচে, এতটুকু ঢেউ পর্যন্ত নেই। ওই নিঝুম কালো লেকের পাড়ে এসে আমার ঘোড়া থামালাম। লেকের কালো পানিতে বাড়ির প্রতিবিম্ব দেখে চমকে ওঠলাম, ওটা অপার্থিব।

লেকের উপর লোহার ছোট্ট ব্রিজ পেরিয়ে সদর ফটকে ঢুকলাম। ফের চমকে ওঠলাম, বাড়ির চারপাশে ঘিরে যাওয়া হাওয়াটা চেনা জগতের নয়। হাওয়ায় ভাসছে বিষন্নতার ঘ্রাণ। একবার ভাবলাম ফিরে যাই। দুই ভৃত্য এগিয়ে আসায় তা সম্ভব হলো না। একজন এগিয়ে এসে আমার ঘোড়াটাকে ধরলো। আর একজন ভৃত্য পথ দেখিয়ে অনেকগুলো অন্ধকার বাঁক পেরিয়ে আমাকে তার প্রভুর ঘরে নিয়ে গেল।

যে ঘরে গিয়ে ঢুকলাম, সেটা বেশ বড় আর উঁচু। জানালাগুলো এত উঁচুতে যে মেঝে থেকে নাগাল পাওয়া যায় না। শুধু একটা সূক্ষ্ম আলো সেই জানালাগুলোর ভেতর থেকে ঘরে প্রবেশ করছিল। কিন্তু আমি অনেক চেষ্টা করেও ঘরের দূরের উঁচু কোণগুলো দেখতে পেলাম না। ঘরের দেয়ালগুলোতে কালো পর্দা ঝুলছিল। বহু চেয়ার-টেবিল বহুদিন ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে মনে হলো। প্রত্যেকটা জিনিসের ওপর কেমন যেন একটা দুঃখভার চেপে বসে আছে বলে মনে হলো। সেই গভীর বিষাদাময় জগত থেকে বুঝি কখনও মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। ঘরে ঢুকতেই ইউশার এগিয়ে এসে উষ্ণতার আলিঙ্গনে আমাকে জড়িয়ে ধরলো, বুঝলাম যে সে চিঠিতে আমাকে যা লিখেছিল সবই সত্য। আমি অবাক চোখে বন্ধু রডেরিকইউশার দিকে চেয়ে থাকলাম। এ কি পরিবর্তন! তার দেহের ত্বক ছিল দেহের ত্বক ছিল ধূসর সাদা বর্ণের, চোখ জোড়া ছিল বড় বড় উজ্জ্বল, ঠোঁটে আকৃতি ছিল আকর্ষণীয়, লম্বাটে নাক, আর মাথার চুলগুলো ছিল খুব কোমল এবং পাতলা। সব মিলিয়ে চেহারায় ব্যক্তিত্ব আর আভিজাত্য প্রকাশ পেত। আর এখন তাকে তো প্রথম দেখায় চিনতেই পারিনি। তার চেহারা আজ মলিন হয়ে গেছে, স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে বিষন্নতা। জীবনের প্রতি আস্থা হারানো দিশেহারা এক মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে আমার বন্ধু ইউশা।

কুশল বিনিময়ের পর বন্ধু আমাকে তার অদ্ভুত অসুস্থতার কথা জানালো। এই অসুস্থতা পারিবারিক এবং বংশগত। এটা এমন এক অসুস্থতা যে, এ থেকে মুক্তি পাওয়ার আশা সে করে না। কিন্তু পরক্ষণেই আবার জানালো, এটা আসলে তার একধরনের মানসিক দুর্বলতা এবং অচিরেই ভালো হয়ে যাবে। এটা থেকে তার মনের ভিন্নধর্মী চিন্তাধারা প্রকাশ পেলো।

কিছুক্ষণ পর সে আবার বললো, আমি মারা যাবো নিশ্চয়ই এই নির্বোধের মতো অসুখে মারা যাবো। আমি বুঝতে পারছি, আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমার জীবন আমার মন, আমার আশা-আকাঙ্খা আমি সবই হারাবো। আমার সেই ভয়ঙ্কর শত্রুর অপর নাম হলো ভয়। সেই ভয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করক সব হারাবো। উফ সে এক মহা আতঙ্ক।

ইউশার বহুকাল ধরে এ বাড়ির বাইরে যায়নি। সে মনে করে, বাড়িটার ধূসর দেয়ালগুলো এবং বাড়িটার চারপাশের নিঝুম লেকটা তার আত্মাকে অলৌকি মায়াজালে বেঁধে রেখেছে। সে জানালো, তার একমাত্র সঙ্গী প্রিয় বোন লেডি ম্যাডেলিনেরও বহুদিন ধরে অসুস্থ, নিশ্চিতভাবে মৃত্যু পথযাত্রী। চিকিৎসকরা বহু আগেই তার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। ধীরে ধীরে তার শরীর ক্ষীণ এবং দুর্বল হয়ে পড়ছে। প্রায়ই সে এমন ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে পড়ে যে, মনে হয় সে সত্যি সত্যি মারা গেছে। ওই বোন যখন মারা যাবে তখন ইউশাই একমাত্র বিশাল এই বাড়ির শেষ বংশধর হিসেবে বেঁচে থাকবে।

ইউশারের বোন লেডি ম্যাডেলিনের ছবি আঁকার হাত আছে। গত কয়েকবছর সে তার প্রিয় ভাইটির বেশ কিছু পোট্রেট এঁকেছে। প্রতিটি ছবিতে ইউশার চেহারায় ফুটিয়ে তুলেছে অদ্ভুত ধরনের অভিব্যক্তি, যার মধ্যে মিশে আছে একই সঙ্গে বিস্ময় আর আতঙ্ক।

ইউশার শ্রবণশক্তি ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। গ্রামফোনে ক্ষীণ শব্দে দেশ-বিদেশের জনপ্রিয় শিল্পীদের গান শুনতে তার খুব কষ্ট হতো। কিন্তু সে গান ভালোবাসে, তাই চড়া সুরে তীক্ষ্ন কণ্ঠের গানই সে বার বার বাজাতো। অথচ গ্রামোফোনে ওইসব গান বাজানো পর তার মধ্যে যে ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য দেখেছি তা বর্ণনাতীত। ইউশার প্রিয় গানের মধ্যে একটার শিরোনাম হলো ‘হানাবাড়ি’।

গানের একটা কথা ছিল হানাবাড়ি। এই গানের মধ্যে সবুজ উপত্যকা, একটা বিরাট প্রাসাদের কথা বলা হয়। যে প্রাসাদে এক রাজা বাস করে। সেখানে সবকিছু রঙিন আলোতে উজ্জ¦ল, বাতাস বইতো সুরভিত। সেই প্রাসাদে আছে বিশাল খোলা জানালা। সবুজ উপত্যাকা দেখতে রাজা যখন জানালায় দাঁড়াতেন, জনগণ দল বেঁধে হাত নেড়ে তাকে অভিনন্দন জানাতো। রাজার চারপাশে উৎফুল্ল প্রেতাত্মা আর অশরীরীদের ঘুরতে দেখা যেতো। রাজার বশ্যতা মেনে প্রেতগুলো কেবল সুললিত কণ্ঠে স্তুতিগান গেয়ে যেত।

আমার বন্ধু রডেরিক ইউশারের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু বিশ^াস ছিল। সে মনে করতো গাছপালা, পাথর, এমনকি পানিরও অনুভূতি আছে। তারা চিন্তা করতে পারে। কিন্তু আমরা তাদের গোনায় ধরি না। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করায় জড় জগতের সবকিছু মনুষ্য জাতির ক্ষিপ্ত হয়েছে আছে। ইউশার বিশ্বাস করতো, বৃক্ষ-লতা-গুল্ম অসীম শক্তির অধিকারী। ওরা মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। তার বাড়ির পাথরের মধ্যে যে গাছপালা জন্মাচ্ছেÑ সেগুলো তার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। এজন্যই তার এই অবস্থা।

রডেরিক ইউশার বইয়ের সংগ্রহ ঘেটে দেখি, বেশিরভাগই অতিপ্রাকৃত বিষয়ের উপর। মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে বিভিন্ন মতবাদের বইও আছে। তবে একটা পুরনো বই সে পড়তে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতো। বইটা ছিল কোন ভুলে যাওয়া চার্চের জন্য লেখা মৃতের ওপর লক্ষ্য রাখা সম্পর্কে।

এক বিষন্ন সকালে আমার ঘরের কড়া নাড়লো ইউশা। জানালো যে, তার বোন লেডি ম্যাডেলিন আর বেঁচে নেই। সে আরও জানালো, চার্চে নিয়ে শেষকৃত্য করার আেেগ েেস ম্যাডেলিনের মরদেহটা তাদের বাড়ির নিচের ভোল্টে কিছুদিনের জন্য রেখে দিতে চায়। আমি তাকে এই চিন্তা থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলাম। বন্ধু জানালো, এটা তার বোনের শেষ ইচ্ছে। অসুস্থ্য অবস্থায় বার বার সে বলে গেছে, কবরে শোয়ানোর আগে কিছুদিন যেন তাকে এ বাড়িতে রাখা হয়।

কি আর করা! বোনের শেষ ইচ্ছে পূরণ নিয়ে কথা। ইউশাকে সহযোগিতা করতে রাজি হয়ে গেলাম। আমরা লেডি ম্যাডেলিনের দেহটা বহন করে যে ভোল্টে নামালাম, সেটা ভীষণ ছোট। বাড়ির নিচে খুব গভীরে ছিল সেটি, তাই অন্ধকারচ্ছন্ন। ম্যাডেলিনের দেহটা ভোল্টে নামিয়ে রাখার সময় হঠাৎ করে এবং প্রথমবার ভাইবোনের চেহারার সাদৃশ্য চোখে পড়লো। ইউশা চট করে আমার মনোভাব বুঝে নিয়ে জানালো, তারা যমজ ভাইবোন ছিল। লেডি ম্যাডেলিনের মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। কেমন যেন একটা অনুভূতি আমার মনে আতঙ্কের ছায়া ফেলেছিল। কারণ তখনও তার মুখে সামান্য রঙ লেগে ছিল আর ঠোঁটে ছিল মৃদু হাসি। পার্থিব সবকিছুকে যেন ব্যঙ্গ করছিল ওই হাসি।

ভোল্টের ইস্পাতে তৈরি দরোজাটা বন্ধ করে উপরে ওঠে এলাম। দেখতে পেলাম ইউশারের ভেতর অদ্ভুত একটা পরিবর্তন। সে দ্রুত পায়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে পায়চারি করতে থাকলো। মনে হলো কোনো কারণে সে খুব ভয় পেয়েছে। এরপর হঠাৎ পায়চারি বন্ধ করে অনেকক্ষণ এমন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো যে, সে যেন কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছে যা আমি শুনতে পাচ্ছি না। একসময় আমিও অনুভব করলাম যে তার অদ্ভুত চিন্তাধারা ধীরে ধীরে আমার উপরও প্রভাব বিস্তার করছে।

লেডি ম্যাডেলিনকে ভোল্টে রেখে আসার সপ্তম রাতে সেই অদ্ভুত প্রভাবটা আমার নিজের ভেতর আরও গভীরভাবে অনুভব করতে লাগলাম। একটা অহেতুক ভয় আমার অস্তিত্বের ভেতর গেড়ে বসলো। রাতে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। এমনিতে বিছানায় শুয়ে অল্পসময়েই ঘুমিয়ে পড়াটাই অভ্যাস। সেই রাতে ঘুম আসছিল না। অন্ধকারের মধ্যে কেমন যেন একটানা মৃদু শব্দ শুনতে পেলাম। অনেকটা ঝড়ের মতো, অথচ সেই রাদে বাতাে ঝড়ের কোন বেগ ছিল না। খুবই বিচলিত হয়ে পড়লাম। বিছানা থেকে ওঠে অজানা আতঙ্কে ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করলাম।

অল্পক্ষণ পরেই শুনলাম, একটা মৃদু পায়ের শব্দ আমার ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে। আমি জানতাম পদশব্দটা রডেরিক ইউশারের। সে দরোজার সামনে এসে দাঁড়ালো। তাকে দরোজা খুলে রুমের ভেতরে নিয়ে এলাম। চাপা অন্ধকারে দূর থেকে এক চিলতে আলো পড়লো তার চোখে মুখে। দেখলাম ফ্যাকাশে মুখে চাপা একধরনের বন্য হাসি ফুটে ওঠেছে।

চাপা কণ্ঠে ইউশার বলে ওঠলো, তুমি কি এখনও দেখোনি?

আমার জবাব শোনার অপেক্ষা না করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে জানালার দিকে। খিল সড়িয়ে খুলে দিল জানালার পাল্লা, সঙ্গে সঙ্গেই একটা দমকা ঝড় ঘরে এসে ঢুকলো। ঝড়টা এতোটাই প্রবল যে, মনে হচ্ছিল আমাদের বুঝি উড়িয়ে নিয়ে যাবে। আমি ইউশারকে ধরে জানালা থেকে সরিয়ে এনে একটা চেয়ারে বসালাম।

বললাম, তুমি ওদিকে দেখো না। তোমার ওদিকে দেখা উচিত নয়। এ ধরনের দৃশ্য যা দেখে তুমি অবাক হচ্ছো, সেটা এর আগেও অন্য জায়গায় ঘটেছে। হয়তো তোমার এখানে এই প্রথম। লেকের পানি জ¦লীয় বাস্প হয়ে উড়ে যাওয়ায় অন্য জায়গা থেকে হাওয়া এসে জায়গা ভরাট করছে।

ইউশা চোখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, তাই কি?

আমি প্রসঙ্গ পাল্টালাম, আমার অনেক দিনের ইচ্ছে তোমাকে তোমার প্রিয় বইটা পড়ে শোনাবো। আজকে সুযোগ পেলাম। বইটা পড়তে পড়তেই রাত কেটে যাবে। হাতের কাছে যে বইটা পেলাম সেটাই তুলে নিলাম। দূরের আলোতে পড়তে কষ্ট হলেও পড়া শুরু করলাম। ইউশার খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো। আমি পড়তে থাকলাম, একজন বলিষ্ঠ লোক পুরোপুরি মাতাল অবস্থায় তার ঘরের দরোজা ভাঙতে শুরু করে আর সেই দরজা ভাঙার শব্দ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে...।

এটুকু পড়েই আমাকে থামতে হলো। কারণ আমার মনে হলো, বাড়ির দূরের কোন অংশ থেকে বইয়ে পড়া শব্দের মতো ক্ষীণ শব্দ আমার কানে এসে লাগলো। আমি আবার বইটা পড়তে শুরু করলাম। সেখানে লেখা ছিল, লোকটা অবশেষ দরোজাটা ভাঙলো। সেই ভাঙা দরোজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ভয়ঙ্কর এক জন্তুকে দেখতে পেলো। লোকটা বিচলিত না হয়ে জন্তুটাকে ভীষণভাবে আঘাত করলো। জন্তুটা আর্তচিৎকার দিয়ে উল্টে পড়ে গেল...।

এখানে আবার থামলাম আমি। কোনো সন্দেহ নেই যে, গল্পে পড়া জন্তুর মতো সত্যি সত্যি কোনো জন্তুর বিকট চিৎকার শুনতে পেয়েছি। ঠিক বুঝে ওঠতে পারছিলাম না যে, ইউশারও আমার মতো ওই চিৎকার শুনেছিল কিনা। স্পষ্ট দেখলাম যে সে চেয়ারটা একটু ঘুরিয়ে নিয়েছে যাতে আমি তাকে সোজাসুজি দেখতে না পাই। সে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তার দেহটা একটু একটু করে একপাশ থেকে আরেক পাশে দোলাচ্ছে। বুঝে ওঠতে পারছিলাম না আমার কি করার আছে! তাই আবার গল্পটা আমি আবার গল্পটা পড়তে লাগলাম, লোকটা কোনো কিছু তোয়াক্কা করছে না। সামনের ভারি লোহার আলমারিটা লাথি দিয়ে সে ফেলে দিল। লোহার ঝনঝন শব্দ করে মেঝের ওপর পড়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো...।

এবার আমি শুনতে পেলাম সত্যি সত্যিই যেন মেঝেতে ভারি কিছু পতনের শব্দ হলো। চেয়ার থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। ইউশার দিকে তাকিয়ে দেখি, তার দেহটাকে নিয়ে চেয়ারটা কাত হয়ে পড়ে গেছে। একলাফে তার কাছে গিয়ে চেয়ারটা সোজা করলাম। তার কাঁধে হাত রাখতেই বুঝলাম, সে থর থর করে কাঁপছে। খুবই নিচু কণ্ঠে দ্রুততার সঙ্গে বিড় বিড় করে সে কথা বলছিল। মনে হচ্ছি ইউশা বুঝি ভুলে গেছে যে, সেখানে আমিও আছি।

সে বিড় বিড় করে বলছিল, হ্যাঁ, আমি শুনেছি। প্রথম দিনেই আমি শুনেছি। বহু মিনিট, বহু ঘণ্টা আমি শুনেছি। কিন্তু বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না।

ইউশা একটু থামলো, যেন সাহস ফিরে পেতে দম নিয়ে নিল।

সে বললো. আমরা লেডি ম্যাডেলিনকে জীবিত অবস্থায় ভোল্টে রেখে এসেছিলাম। ওই ভয়ঙ্কর শব্দ আর কারো নয় ওটা তারই। কারণ সে এখন মারা গেছে। ম্যাডেলিন আসছে। হায়, আমি এখন কই পালাই। সবকিছু ভেঙে সে আসছে। সে আমার কাছে জানতে চাইবে, কেনো তাকে মৃত্যুর আগেই ভোল্টে রেখে এসেছিলাম। সিঁড়িতে আমি তার পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি।

এই বলে ইউশা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। দুহাত বাড়িয়ে এমন ভঙ্গিতে সে চিৎকার করলো যেন তার আত্মাকে উৎসর্গ করছে। সে চিৎকার করে বললো, আমি জানি তুমি এসে পড়েছো এবং এই মুহূর্তে দরোজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছো। তুমি এসেছো। তুমি এসেছো।

ইউশা আঙুল তুললো দরোজার দিকে, আর দরোজাটাও ধীরে ধীরে খুলে গেল। দরোজার ওপাশে দাঁড়ানো অশরীরী আকৃতিটা আর কারও নয়, লেডি ম্যাডেলিনের। তার পরনের সাদা পোশাকে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। সে কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ দরোজায় দাঁড়িয়ে রইলো, আর তাকে দেখে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো আমার বন্ধু রডরিক ইউশার। লুটিয়ে পড়া ভঙ্গিমাতেই বুঝে গেলাম, সে মারা গেছে। আতঙ্কই তাকে হত্যা করেছে।

এইবার মৃত লেডি ম্যাডেলিন ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ভাইয়ের দেহের ওপর আছড়ে পড়লো। আমার আস্তিত্ব তার চোখে পড়লো না। ভাইয়ের দেহটা দুহাতে কোলে তুলে নিয়ে অশরীরী ম্যাডিলিন সিঁড়ির দিকে রওনা দিল। আমি সম্মোহিতের মতো তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম। ভোল্টের দিকে যাওয়া সিড়ির সামনে থমকে দাঁড়ালো সে। পেছন দিকে ঘুরে গেল ম্যাডেলিনের ঘাড়টি। তার চোখ থেকে দুটি আগুনের গোলা ছুটে আসতে দেখলাম আমার দিকে। এতোক্ষণে আমার হুশ ফিরলো। প্রাণ বাঁচানোর আদিম প্রবৃত্তি আমাকে বলে দিল, বাঁচতে চাইলে পালা।

আমি ঘুরে দৌড় দিলাম। বাঁচতে চাইলে আমাকে এই হানাবাড়ির চৌহদ্দির বাইরে যেতে হবে। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে দৌড়াচ্ছে। বুঝতে পারছি, আমার পেছনে ছুঁটে আসছে বন্য তুফান। আমাকে গ্রাস করতে বাড়ছে ঝড়ের গতি। ছোঁয়া লাগছে হওয়ার। আরেকটু আরেকটু...।

অবশেষে আমি দুর্দম গতিতে ব্রিজটি পেরিয়ে এলাম। ব্রিজের ওপাশে থমকে গেলো তুফান। জলোচ্ছাসের গর্জনে এবার পেছন ফিরে দেখি এক নারকীয় দৃশ্য। লেকের কালো পানি উপচে ওঠে ধেয়ে যাচ্ছে ওই বাড়ির দিকে। চাঁদের আলোয় দেখলাম, হুরমুর করে ধসে পড়লো ইউশার বাড়ি। ধংশাবশেষ ঢেকে দিলো লেকের কালো পানি।

হানাবাড়ির পতনের দৃশ্যটা শুধু আমি দেখেছি, ওই চাঁদ সাক্ষী।

[এডগার এলেন পোর ‘দ্য ফল অফ হাউজ অফ ইউসার’ এর ভাবানুবাদ]

হরর গল্প,বিপুল হাসান,এডগার এলেন পো
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close