• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

স্টিফেন কিং-এর গল্প অবলম্বনে

জাহান্নামের খুনি বিড়াল

প্রকাশ:  ২৩ এপ্রিল ২০২২, ০৩:১৪ | আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২২, ০৩:২৮
রূপান্তর: বিপুল হাসান

... ওরে ওরে, হুইলচেয়ারে বসা বুড়োটা তো দেখছি বসে বসে মৃত্যুর প্রহর গুনছে।

প্রথম নজের লোকটাকে দেখে এটাই মনে হলো হেলস্টোনের। মৃত্যু যে তার তার খুব চেনা। কারণ সে একজন পেশাদার খুনি সে। মৃত্যু নিয়েই সব কাজ কারবার। আঠারোজন পুরুষ আর ছয়জন নারী খুন করার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তার ক্যারিয়ার। থমথমে বাড়িটির ঠাণ্ডা বাতাসে ভাসা মৃত্যুর ঘ্রাণ তার নাক ঠিকই টের পেয়েছে।

আলিশান এ অট্টালিকার মালিক মিস্টার দ্রোগান। তিনি এ তল্লাটের খানদানি লোক।

বুড়ো লোকটা পরনে পরিপাটি দামি পোশাক। তাতে কী? তার গা থেকে বের হচ্ছে পঁচা কাঠালের গন্ধ। ঘাটের মরাটা যে এখনও বেঁচে আছে তা প্রমাণ করতেই বুঝি একটু নড়ে ওঠলো। ফায়ারপ্লেসের কাঠ পোড়ার চড়চড় শব্দকে চাপা দিয়ে খনখনে গলায় বললো, ‘তুমিই তো সেই হেলস্টোন। শোনো, তোমাকে একটা খুন করতে হবে। ওটাই তো তোমার কাজ, তাই না?’

‘আপনি কার কাছ থেকে জানলেন?’

সাবধানী কন্ঠে হেলস্টোন জানতে চায়। খুনি হিসেবে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে সে সবসময়ই সচেতন।

বুড়ো দ্রোগানের মুখে এক চিলতে অবজ্ঞার হাসি ফুটে ওঠে নিমিষেই মিলিয়ে যায়। হেলস্টোনের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমি সব খবরই পাই। আসলে আমার বিশ্বস্ত লোকেরা সব খবরই রাখে। সোল লজিয়াকে নিশ্চয়ই চেনো, তার সঙ্গে তোমারও ঘণিষ্ঠতা আছে। সে আমার লোক ধরে নিতে পারো। তার কাছে শুনেছ, খুনি হিসেবে তোমার উপর আস্থা রাখা যায়।’

হেলস্টোনের নাক থেকে ঘোত করে একটা শব্দ বের হলো। সে ভাবছে, তার বেশ কয়েকটা কাজের উৎস সোল লজিয়া। লোকটা নিজে খুন না করলেও বহু খুনের মধ্যস্ততা করেছে। তাই রেফারেন্স হিসেবে যে কোনো পেশাদার খুনির কাছে লজিয়ার গ্রহণযোগ্যতা আছে। বুড়োটার কাজের প্রস্তাব এখন ভেবে দেখা যায়।

‘ঠিক আছে। আপনি বলেন, কাকে দুনিয়া থেকে সরাতে হবে? আর কোথায় কাজটা করতে হবে?’

হাতলের বোতামে চাপ দিতেই দ্রোগানের হুইলচেয়ারটা মৃদু শব্দে সামনের দিকে এগিয়ে এলো। কাছাকাছি আসতেই বুড়োর গা থেকে বের হওয়া পচাঁ কাঠালের গন্ধটা পেশাবের দুর্গন্ধে পরিণত হলো। বড় অস্বস্তি লাগছে হেলস্টোনের, অশুভ একটা অনুভূতি। তবে চেহারায় এর ছাপ পড়তে দিলো না। নির্বিকার তাকিয়ে লোলচর্ম বুড়োর অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করছে সে।

আচমকা কেঁপে ওঠে দ্রোগানের ঠোঁট। ফিসফিস করে বললো, ‘এসে গেছে। এসে গেছে। ভিকটিম এসে গেছে। তোমার পেছনেই ভিকটিম এসে দাঁড়িয়েছে।’

বিদ্যুৎগতিতে নড়ে ওঠে হেলস্টোনের দেহ। মুহূর্তেই ডান হাত ঢুকে গেল কোটের ভেতরে। গোপন পকেট থেকে হাতে ওঠে এলো পয়েন্ট ফোর ফোর হাইব্রিড রিভলবার। ট্রিগারে আঙুল চেপে সাই করে পেছনে ঘুরলো সে। রিভলবারের নলটা যার দিকে তাক করেছে, সেটি কোনো মানুষ না! একটা জানোয়ার, একটা বিড়াল।

কিংকর্তব্যবিমুঢ় হেলস্টোন। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলো বিড়ালটার দিকে। আরে, এটাকে তো চেনা চেনা লাগছে। আগে কোথায় যেন দেখেছে। এমন বিশাল দেহের বিড়াল একবার দেখলে ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ওটার গায়ের রঙ কুচকুচে কালো, তবে পেটের দিকে হালকা সাদা। অন্ধকারে বিড়ালটার চোখ দুটি জ্বলছে আগুনের গোলার মতো, পান্নার মতো সবুজাভ চোখের তারা থেকে ঝরছে ঘৃণা। চাপা গড়গড় গর্জন করছে ওটা। যেন বলছে, ওরে তুই আর আমি পরিচিত। চিনতে পারছিস রে?

আচমকা বিড়ালটা চোখের আড়ালে উধাও হয়ে গেল। মেজাজটা আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলো না হেলস্টোন। এই ঘাটের মড়াটা কি রসিকতা করছে? কোটের গোপন পকেটে পিস্তলটা রেখে ঘুরে দাঁড়ায় সে। চিবিয়ে চিবিয়ে নিষ্ঠুর কণ্ঠে বলে-

‘মিস্টার দ্রোগান ইয়ার্কি মারার জন্য আমাকে কি ডেকে এনেছেন? রেফারেন্সে বন্ধু সল লজিয়ার নাম বলেছেন। নয়তো এতক্ষণে লাশ হয়ে যেতেন। ইয়ার্কি-ফাতরামি সহ্য হয় না আমার।’

‘ধুরু মিয়া’, বুড়োটা পাত্তাই দিল না তাকে।

‘ইয়ার্কি মারার বয়স আমার নেই। তোমার সঙ্গে ইয়ার্কি করার ইচ্ছেও নেই।’

পা ঢেকে রাখা চাদরের নিচ থেকে মোটা হলুদ একটা খাম বের করে আনে বুড়োটা।

‘শান্ত হও ইয়ংম্যান। আর এই খামটা রাখো।’

খামের ভেতর কি আছে, তা বলে দিতে হলো না হেলস্টোনকে। টাকার জন্যই তো দুনিয়াদারি, যতো কেলেংকারি আর রক্তপাত। খামটা হাতে নিয়ে সে সোফায় গিয়ে বসে। বিড়ালটার ফের আবির্ভাব হলো। বেরিয়ে এলো সোফার নিচ থেকে। গরর গরর মুখ থেকে বের হচ্ছে আদুরে শব্দ। মৃদু লাফে ওঠে পড়ে হেলস্টোনের কোলের উপর। কোলের ওপর আরাম করে বসে পিট পিট চোখে ওটা তাকালো তার দিকে। হেলস্টোন দেখলো, জন্তুটার কালো চোখের মণি দুটো ঘিরে রেখেছে সবুজ-সোনালি রঙের বলয়। বিড়ালের এমন চোখ লাখে একটা মিলে। অবাক হয়ে বিড়ালটাকে দেখছে সে, কেমন একটা ঘোরলাগা অনুভূতি। দ্রোগানের ডাকে ঘোর কাটলো খুনির।

‘ওহে, বিড়ালটার প্রেমে পড়ে গেলে নাকি! ওটাকে ভীষণ শান্ত আর মিশুক মনে হচ্ছে, তাই না? প্রথম প্রথম এমন মনে হতেই পারে। তোমাকে বলি শুনো মিয়া। এই চমৎকার বিড়ালটা এ বাড়ির তিনজন মানুষকে হত্যা করেছে।’

বাড়ির মালিকের কথা শুনে চমকে ওঠলো হেলস্টোন। চোখ গেল বিড়ালটার দিকে। রোমশ লেজটা প্রায় খাড়া, মৃদু নড়ছে। গলা থেকে বের হচ্ছে আরামের গরর গরর শব্দ।

কাঁপা কণ্ঠে বুড়ো বলে, ‘এখন কেবল আমিই বাকি আছি।’

দ্রোগানের ঘোলা চোখে শূন্য দৃষ্টি। নিজের সঙ্গেই যেন কথা বলছে সে।

‘মরতে তো হবেই। তবে অপঘাতে মরতে চাই না আমি। চোখের সামনে অপঘাতে মরা এত মানুষ দেখেছি যে অপঘাতে মরতে ঘেন্না হয়। আমার সময় হলে স্বাভাবিকভাবেই মরতে চাই। বিড়ালের মতো একটা সামান্য জন্তুর হাতে প্রাণ হারানোর জ্বালা পরকালে বহন করতে চাই না।’

‘আসলে সবকিছু আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে।’ বললো হেলস্টোন। ‘আপনি কি সত্যিই আমাকে একটা বিড়াল মারার জন্য ডেকেছেন?’

‘আগে খামটা খুলে দেখো, খামটা খুললেই বিশ্বাস হবে।’

হলুদ খামটা খুলে একশ ডলারের নোটের একটা বান্ডিল বের করলো হেলস্টোন। জানতে চাইলো, ‘এখানে কত আছে?’

‘দশ হাজার ডলার। অবশ্যই তুমি আরও দশ হাজার পাবে। ওটা পেতে হলে কাজটা শেষ করে তার প্রমাণ দেখাতে হবে। তোমার বন্ধু লজিয়ার কাছ থেকে শুনেছি, হত্যা পিছু দশ হাজার ডলার নাকি তোমার রেট। আমি ডাবল দিচ্ছি।’

পেশাদার খুনি হেলস্টোনের ঠোঁটে একচিলতে হাসি। মাথা নাড়লো সে। মনে মনে বললো, একটা বিড়াল মারার জন্য বিশ হাজার ডলার। লোভনীয় প্রস্তাব।

হেলস্টোন কোলের উপর ঘুমিয়ে পড়া প্রাণীটার গায়ে হাত বুলাচ্ছে। বিড়াল হলো গতিশীল আর স্বনির্ভর। ঈশ্বর এদের নিখুঁত শিকারী হিসেবে তৈরি করেছে। তাই বিড়ালকে পছন্দ করে সে।

‘তোমাকে আর কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবে একটা মনে রাখবে, সতর্করাই দুনিয়ায় সবচেয়ে সফল। আমার কাজটা হালকাভাবে নিলে ভুল করবে।’

বুড়োটার কথা শুনছে আর ভাবছে হেলস্টোন। লোকটা টাকার কুমির। বড়লোকদের নানারকম বাতিক থাকে। বিড়ালটাকে মারার জন্য লোক ভাড়া করাকে বাতিক ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারছে না সে। তার দরকার টাকা। ইঁদুর বা বিড়াল মারার মতো হাস্যকার কাজে যদি মানুষ খুনের টাকা পাওয়া যায়, ক্ষতি কি!

‘আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে? তুমি নিশ্চয়ই ভাবছো, আমি কোনো ছিটগ্রস্ত মানুষ।’

দ্রোগান বোধহয় মনের ভাবনা পড়তে জানে। নয়তো হেলস্টোে কি ভাবছে বুঝলো কি করে!

‘মোটেও আমি তা না। আমি যে মস্তিষ্ক বিকৃত কেউ নই, এটা তোমার কাছে পরিস্কার করা দরকার।’

কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না হেলস্টোন। লোকটা উদ্ভট, এটা ঠিক। আর তার কাজটাও অন্যরকম। এধরনের খুচরো কাজ সে কখনো করেনি আগে। এতে মানুষ হত্যার মতো ঝুঁকি একদম নেই। এজন্যই কাজটা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে দ্রোগানের কথায় কেমন যেন একটা রহস্য আছে। তাই শুনতে চায়, আসলে কি বলতে চায় বুড়োটা।

‘শুনো হেলস্টোন, আমাকে কতোটা চেনো জানি না। এই যে আমার প্রাসাদের মতো বাড়ি, বিলাসি জীবনযাপন। এতো অর্থ আর বিত্ত। তুমি কি জানো, এসবের উৎস কি?’

‘কেউ কোনো এসাইনমেন্টে ডাকলে আগে তার সম্পর্কে জেনে নেয়াটা আমার কাজের অংশ। আপনি হলেন দ্রোগান ফার্মাসিউটিক্যালসের স্বত্তাধিকারী।’

‘গুড, এটা ভালো। ঠিকঠাক জেনেই এসেছো তুমি। নিজের নামেই আমার প্রতিষ্ঠানটির নাম দ্রোগান ফার্মাসিউটিক্যালস। এটি বিশ্বের বড় ওষুধ কোম্পানিগুলোর একটা। রোগব্যাধির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই। মানুষের আয়ু বাড়াতে অনেক রকম ওষুধই তৈরি করে আমার কোম্পানি। তবে আমাদের আর্থিকভাবে সাফল্য এনে দিয়েছে এই ট্যাবলেটগুলো।’

পকেট হাতড়ে একটা ছোট্ট কাঁচের বোতল বের করে আনে ফার্মাসিউটিক্যালসের মালিক। বোতলটার ভেতর ছোট ছোট ট্যাবলেট। হাতের মোচড়ে বেশ কসরত করে বোতলটার মুখ খুলতে হলো তাকে। ঝাঁকি দিতেই হাতের তালুতে কয়েকটা ট্যাবলেট বেরিয়ে এলো। ওগুলো হেলস্টোনের হাতে দিল দ্রোগান।

‘তোমাকে এগুলোর কথাই বলছিলাম। এই ট্যাবলেটের নাম ডরমাল-ফিনোবার্বিন, কম্পাউন্ড জি। এটা উদ্দীপক হিসেবে রোগীদের জন্য ব্যবহার করা হয়। নিজের কোম্পানির উৎপাদন বলেই বলছি না, এটি সত্যিই দারুণ কার্যকর অষুধ। একই সঙ্গে পেইন-কিলার, ট্রাংকুলাইজার এবং মাইল্ড হ্যালুসিনেশনের ওপর কাজ করে। এই ট্যাবলেট যে কোনো রোগে আক্রান্ত রোগীর সবধরনের শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার উপশম করে।’

হাতের মুঠো খুলে ট্যাবলেটগুলো দেখে হেলস্টোন। হালকা গোলাপি রঙের সাধরণ ট্যাবলেট-ই তো, খোদাই করে লেখা ডিএফ। এই এক অষুধে কিনা সব যন্ত্রণার উপশম! সে জানতে চাইলো, ‘আপনি নিজে কি কখনো এটা খেয়েছেন?’

হেলস্টোনের প্রশ্ন যেন শুনতেই পায়নি বুড়োটা। সে নিজের মতোই ট্যাবলেটটির গুণাগুণ বলে চললো।

‘আমাদের এই ট্যাবলেটটি এখন বিশ্বের সব দেশেই প্রেসক্রাইবড হচ্ছে। তিন দশক আগে এটার মূল উপাদান নিয়ে প্রায় চার বছর গবেষণা করতে হয়েছে। আমাদের নিউ জার্সির ল্যাবরেটরিতে ডজনখানেক গবেষক রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এই ট্যাবলেট প্রক্রিয়াজাত করা হয়। মানুষের নার্ভ সিস্টেম এটি কাজ করে। তাই প্রতিটি ধাপের ট্রায়ালে, মানে গবেষণার সাফল্য পরীক্ষা করা হতো বিড়ালের ওপর। কারণ এই প্রাণীটার নার্ভ সিস্টেম অসাধারণ।’

চট করে বাতিকগ্রস্ত বুড়োর বিড়াল ভীতির কারণ বুঝে ফেলে হেলস্টোন। প্রশ্ন করে, ‘ওষুধের ট্রায়াল চালাতে গিয়ে আপনাদের কতোগুলো বিড়াল মারতে হয়েছে?’

এ প্রশ্নটি এড়াতে পারলো না দ্রোগান। আসলে একটা খুনির কাছ থেকে সরাসরি এ ধরনের কথা আশা করেনি। লম্বা করে নিঃশ্বাস নিলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ওষুধ কোম্পানির মালিক।

‘এভাবে বিষয়টা দেখা আসলে ঠিক হচ্ছে না। মানুষের কল্যাণেই এসব গবেষণা আর পরীক্ষানিরিক্ষা হয়েছে। ডরমাল-ফিনোবার্বিন অষুধ মানুষকে কতোটা ব্যাথা-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছে, তা হয়তো তোমার জানা নেই।’

‘আমি জানতে চাচ্ছি, এ গবেষণায় কতোগুলো বিড়াল মারতে হয়েছে?’

‘এই ধরো চার বছরে আমাদের গবেষকদের পনেরো হাজারের মতো বিড়াল লেগেছে।’

‘এর মানে বছরে গড়ে প্রায় চার হাজার বিড়াল মারতে হয়েছে। আমার কাছে এখন পুরো বিষয়টা পানির মতোই পরিস্কার।’

হেলস্টোনের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি, কণ্ঠে খানিকটা ব্যঙ্গ নিয়ে বললো , ‘আপনার এখন নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে, ওইসব মৃত বেড়ালের প্রতিনিধি হয়ে জাহান্নাম থেকে ওঠে আসা একটা প্রেত-বিড়াল প্রতিশোধ নিতে ফিরে এসেছে?’

‘তুমি পুরো বিষয়টা যেরকম হালকাভাবে দেখছো, এটা মোটেও সেরকম না।’

খুনিটার কথায় প্রথমে খানিকটা বিচলিত বোধ করলেও পরক্ষণেই সামলে নেয় দ্রোগান। কণ্ঠে ফুটে ওঠে দৃঢ়তা।

‘কয়েক হাজার বিড়ালের মৃত্যু নিয়ে কোনো ধরনের কুসংস্কার বা অপরাধবোধ নেই আমার। বিশ্বের লাখো মানুষের মঙ্গলের জন্য হাজার পনেরো বিড়াল মারা যাওয়া গোনায় ধরার মত কিছু নয়। যুগে যুগে বহুবার এমনটা হয়েছে, মানুষের প্রয়োজনে ভবিষ্যতেও হবে।’

‘বাদ দেন, এ বিষয়টা নিয়ে কথা বাড়াতে চাই না।’

আসলে অস্বস্তি লাগছে হেলস্টোনের। নিজে যেমন কৈফিয়ত দিতে পছন্দ করে না, তেমনি কারও কৈফিয়ত শুনতেও একদম ভালো লাগে না তার। কিন্তু যেভাবে বুড়োটা কথা বলা শুরু করেছে, মনে হচ্ছে সবকিছু চুলচেরা বলবেই। ধনকুবেরটার কথাগুলো শুনতে মন্দ লাগছে না।

‘বিড়াল মোটেও পছন্দ করি না আমি। এগুলো সব জায়গায় ঘুরে বেড়ায়, ময়লা-আবর্জনা ঘাটাঘাটি করে। কখনো ডাস্টবিনে, কখনো নর্দমায় গিয়ে গড়াগড়ি করে। আবার খিদে পেলে নোংরা প্রাণীগুলো হানা দেয় রান্নাঘরে বা খাওয়ার টেবিলে। এগুলো লোমের ভেতর বহন করে ভয়ংকর সব রোগজীবানু। তাই বিড়াল দেখলেই দূর দূর করে তাড়াতে বলি আমি। মাত্র মাস ছয়েক আগে এ বিড়ালটি এসে জুটেছে আমাদের বাড়িতে। কোথা থেকে এলো জানি না। এটাকেও তাড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার ছোটবোনের বিড়ালটাকে প্রশ্রয় দেয়। আমার নিষেধ না-শুনে এটাকে পুষতে শুরু করে, আদরে যত্নে মাখামাখি। আমার বোনটা সেই প্রতিদান পেয়েছে।’

কথাগুলো বলতে বলতে হেলস্টোনের কোলের উপর ঘুমিয়ে থাকা বিড়ালটার দিকে বুড়োটা ক্রোধ আর ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাল। হেলস্টোন বললো, ‘মি. দ্রোগান, আপনি বলছিলেন এই বিড়ালটা তিনজনকে খুন করেছে। আমাকে যদি বিষয়টা খুলে বলতেন।’

শীতের এখন মাত্র শুরু, কিন্তু প্রাসাদের মতো বাড়িটিতে শীতের তীব্রতা বেশি। কানেকটিকাটের শহরতলির বিশাল এ পাথুরে ভবন ঘিরে শোঁ শোঁ হাওয়া বইছে। ফায়ারপ্লেসের আগুনে শন শন জ্বলছে পাইনের ডাল। হেলস্টোনের কোলের ওমে ঘুমিয়ে আছে ভিকটিম বিড়ালটা। ঘুমের মধ্যেই প্রাণীটার গলা থেকে মৃদু গরগর আওয়াজ বের হচ্ছে। সব কিছু ছাপিয়ে বুড়ো ধনকুবের খনখনে গলায় বলে যায় দুঃস্বপ্নের গল্প।

মাত্র সাত মাস আগে এ বাড়ির বাসিন্দা ছিল চারজন। দুই বছরের বড় বোন এমান্ডা নিঃসঙ্গ দ্রোগানের সঙ্গী হয়েছিল। এমান্ডার এক অনাথ বান্ধবী ক্যারোলিন ব্রডমুর তার সঙ্গে থাকতো। ক্যারোলিনের ছিলো বিশ্রি ধরনের হাঁপানি রোগ, মাঝে মধ্যেই শ্বাসকষ্ট হতো। আরও থাকতো দ্রোগানের বিশ বছরের পুরনো বিশ্বস্ত কর্মচারি ডিক গেজ। ষাট বছর বয়সী এই লোকটা দ্রোগানের অতিকায় মার্ক ফাইভ গাড়িটা চালাতো, পাশাপাশি রান্নাবান্নার কাজও করতো। এছাড়াও সন্ধ্যার পর মদ পরিবেশনের কাজটাও ডিক করতো। অবশ্য ঘরের অন্যসব কাজের জন্য একজন ঠিকা কাজের মেয়েও ছিল। প্রতিদিন সকালে সে আসতো, আর কাজ শেষে চলে যেত রাতে। এভাবেই প্রায় দুই বছর ধরে আলিশান বাড়িতে চারজন মানুষের দিন কাটছিল। এ যেন একটা বৃদ্ধাশ্রম, একঘেয়ে ও ক্লান্তিকর জীবন। ওদের জীবনের বিনোদন ছিল একটাই, বসে বসে রগেরগে টিভি শো দেখা।

‘ওই অলক্ষুণে বিড়ালকে গেজই প্রথম দেখে। ওটা বোধহয় জাহান্নাম থেকে এসেছে! ঘরের ভেতর ঢুকে ঘুরঘুর করছিল। গেজ জানতো বিড়াল আমি পছন্দ করি না। তাই সে লাঠি নিয়ে তাড়া করে। বিড়ালটা পালিয়ে গেলেও কিছু সময় পরে ফের ফিরে আসে। বেশ কয়েকবার তাড়ানোর পরও এটি আবার ফিরে এসেছে। হাড্ডিসার বিড়ালটি বোধহয় খাবারের লোভেই বার বার ফিরে আসতো। গরমের শেষে এ তল্লাটে বিড়ালের উপদ্রপ বেড়ে গেলে লোকজন এগুলোকে বস্তায় ভরে রাস্তার পাশে মরার জন্য ফেলে রেখে আসে। যদিও কাজটা ভয়ানক অমানবিক।’

‘ল্যাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যন্ত্রণা দিয়ে মারার চেয়ে এটা তুলনামূলক ভালো।’ ফোড়ন কাটলো হেলস্টোন।

খোঁচাটা গায়ে মাখলো না দ্রোগান, নিজের কথাতেই থাকলো সে। নোংরা বিড়াল দেখলে বরাবরই তার গা রি রি করে ওঠতো। বেশ কয়েকবার তাড়িয়ে দেওয়ার পরও বিড়ালটি ফিরে আসায় একদিন গেজকে ডাকলো সে। বিড়ালটিকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলতে বললো। গেজ লোভনীয় ক্যাটফুড ফ্রিস্কির উপর কড়া ট্রাই-ডরমাল-জি ছিটিয়ে ওটাকে খেতে দেয়। কিন্তু ওই খাবারে ভুলেও বিড়ালটি মুখ দিতো না। বার বার বিষ মেশানো খাবার দিয়ে কোনো লাভ হয়নি, স্রেফ এড়িয়ে যেত ওটা। এসময়ই ব্যাপারটা এমান্ডার চোখে পড়ে। বিড়াল মারার এই আয়োজন তার কাছে অমানবিক মনে হওয়ায় গেজকে ভৎসনা করতে থাকে। বিড়ালটিকে পুষবে বলে জেদ ধরে। দ্রোগান মোটেও রাজি ছিল না। কিন্তু ছোটবেলা থেকে একরোখা এমান্ডা তাকে পরোয়া করলে তো। সে যা চাইত, আদায় করে ছাড়তো। ‘এমান্ডা বিড়ালটাকে কোলে তুলে নেয়। তার বুকের উষ্ণ আদর পেয়ে ওটা আহ্লাদে গরগর করতে থাকে। অলুক্ষণে বিড়ালটি কিন্তু কখনোই আমার পাশে ঘেষেনি, এমনকি এখন পর্যন্ত।’

বুড়ো একটানা বলে চললো।

‘আমাদের দামি পাথরবাটিগুলোর একটায় নোংরা বিড়ালটিকে দুধ ঢেলে ওকে খেতে দিত এমান্ডা। আর মেতে ওঠতো ন্যাকামিপনায়। বলতো, দেখ দেখ কী সুন্দর চুক চুক করে দুধ খাচ্ছে। আহা কতোদিন যেন না খেয়ে আছে বেচারা। এমান্ডার সঙ্গে ক্যারোলিনও সুর মেলাতো। দুই বান্ধবী এ জঘন্য কাজটা করতো সম্ভবত আমাকে রাগানোর জন্য। কারণ বিড়াল সম্পর্কে আমার মনোভাব ওরা ভালো করেই জানতো। বিড়াঠটির প্রতি এই অতি দরদের ভয়ঙ্কর খেসারত ওদের দিতে হয়েছিল।’

একটু থেমে দম নিল দ্রোগান। হেলস্টোন দেখলো বুড়োর হিং¯্র অভিব্যক্তি। রাগে তার চোখমুখ লাল হয়ে ওঠেছে।

মে মাসের ঝরঝরে এক ভোরে নাস্তা করতে ওঠে গেজ দেখে সিড়ির নিচে পড়ে আছে এমান্ডার নিথর দেহটা, তার চারপাশে ছড়িয়ে আছে চিনেমাটির পাত্রের ভাঙা টুকরো আর ক্যাটফুড। চোখদুটো তার খোলা ছিল, কোটোর ঠেলে বেরিয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। নাক-মুখে জমাট বাঁধা থকথকে কালচে রক্ত। মেরুদ-ের হাড় ভেঙেছিল এমান্ডার, পা দুটিও ভাঙে। আর ঘাড়টা ছিল দুমড়ানো, কাঁচের মতো টুকরো টুকরো।

‘এমান্ডার বেডরুমেই ঘুমাতো বিড়ালটি।’ নির্লিপ্ত কণ্ঠে বুড়ো দ্রোগান বলে।

‘বাচ্চা মেয়েদের মতোই দিনভর মেতে থাকতো সে বিশ্রি এই প্রাণিটি নিয়ে। বিড়ালটার নাম দিয়েছিল স্যাম। বলতো, ওলে আমার সোনাবাবু স্যাম, খিদে পেয়েছে খুব? উহু, ঘরে কিন্তু হিসি করা যাবে। চলো সোনা বাগান থেকে তোমাকে হিসি করিয়ে আনি। সেকি আহ্লাদ। বুড়ি বোনটার এইসব কা-কারখানা অসহ্য লাগতো আমার। কিন্তু তাতে তার কি! আমার ধারণা, খিদে পাওয়ায় বিড়ালটাই ভোরের দিকে মিউ মিউ করে এমান্ডার ঘুম ভাঙায়। ওটা নিয়ে ন্যাকামিপনা ছিল তার। সব বিড়াল ক্যাটফুড ফ্রিস্কি পেলে গপগপ করে গিলতে থাকে। কিন্ত এমান্ডা ওটাকে দুধ মিশিয়ে ফ্রিস্কি খাওয়াতো। বলতো, ফ্রিস্কির সঙ্গে একটু দুধ মিশিয়ে না দিলে আমার স্যামটা খেতে পারে না। মনে হয়, দুধ নেওয়ার জন্যই বেডরুমে থেকে নিচে নামছিল সে। আর বিড়ালের যা স্বভাব, নিশ্চয়ই ওটা এমান্ডার পায়ে পায়ে গা ঘষছিল। আমার বোনটার বয়স হয়েছিল, শক্ত পায়ে হাঁটতে পারতো না। তাছাড়া ছিল ঘুমের ঘোরে। সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে বিড়ালটার গায়ে পা লেগে হয়তো পা পিছলে যায়.. সে নিচে গড়িয়ে পড়ে..।’

হেলস্টোন মনোযোগ দিয়ে বুড়োর কথা শুনছিল। দ্রোগানের সঙ্গে সে একমত, এভাবেই ঘটেছিল দুর্ঘটনাটি। মনের চোখে সে দেখতে পায়, সিঁড়ির উপর থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ছে বুড়ি এমান্ডা। সিড়ির একেকটি ধাপে দেহের একেকটি অংশে আঘাত পাচ্ছে সে। কট করে হাড় ভাঙছে, পায়ের-হাতের-কোমড়ের-ঘাড়ের...। চিৎকার দেওয়ার কোনো সুযোগই সে পেল না। হাতে থেকে চিনেমাটির পাত্রটা পড়ে আর ভেঙে হল খান খান। ফ্রিস্কির দানাগুলো ছড়িয়ে পড়লো মেঝেতে। সিড়ির শেষ ধাপে বাড়ি খেলো এমান্ডার মাথাটা। গুড়িয়ে গেল ঘাড়। হাড়গোড় সব চুরমার। সিড়ির নিচে গড়িয়ে পড়া দেহটা কয়েকবার ঝাঁকি দিয়ে নিঃসাড় হয়ে গেল। চোখদুটো বেরিয়ে এল কোটর থেকে। রক্তের ধারা বইছে তার নাক আর কান দিয়ে। রক্তে ভিজে গেলো কিছু ফ্রিস্কির দানা। কালচে রোমে ঢাকা ধাড়ি বিড়ালটা সিড়ি দিয়ে ধীর পায়ে নেমে এল। বুড়ির চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ফ্রিস্কিগুলো থেকে বেছে বেছে রক্তভেজা দানাগুলো চিবোতে শুরু করলো...।

বাস্তবে ফিরলো হেলস্টোন। জানতে চাইলো, ‘পোস্টমর্টেমে কি এসেছিল?’

‘যা ভেবেছি তাই’। বললো দ্রোগান। ‘দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, আমি তো জানতামই।’

‘এতবড় একটা দূর্ঘটনা। আপনার বোন এমান্ডার মৃত্যুর পরও কেন বিড়ালটাকে সরিয়ে দিলেন না’?

‘আসলে এটার জন্য দায়ি ক্যারোলিন ব্রডমুর। সে হুমকি দিয়েছিল যদি ওটাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় তাহলে সেও চিরদিনের জন্য এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। আমি নিঃসঙ্গ হয়ে যাবো, এই ভয়ে ওর দাবি মেনে নেই। আসলে কি বলবো, একধরনের আধ্যাত্মিক উন্মাদনা ছিল তার মাঝে।’

কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল ক্যারোলিন। বিশ্বাস করতো তন্ত্রে মন্ত্রে। হার্টফোর্ডের এক তান্ত্রিকের শিষ্য ছিল সে। ওই তান্ত্রিক তাকে বলেছিল, স্যাম নামের বিড়ালটির ভেতর কোন একভাবে এমান্ডার আত্মা ঢুকে গেছে। এর মানে হলো, স্যাম আর এমান্ডা এখন দুই আত্মার এক প্রাণী। কাজেই স্যামের জায়গা যদি এ বাড়িতে না হয় সেও এখানে আর থাকবে না। দ্রোগানকে জোর দিয়েই এটা জানিয়েছিল ক্যারোলিন।

পোড়খাওয়া জীবনে মানুষের চিন্তাভাবনা আর মনস্তত্ব বুঝে নেওয়ার একধরনের দক্ষতা তৈরি হয়েছে হেলস্টোনের মাঝে। তার বুঝে নিতে অসুবিধা হলো না যে, যৌবনে দ্রোগান আর ক্যারোলিনের মধ্যে হৃদয়ঘটিত সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্কের টানেই ক্যারোলিন আশ্রয় নেয় এই আলিশান বাড়িতে। এই শেষ বয়সে সামান্য একটা বেড়ালের কারণে বুড়িটা তাকে ছেড়ে চলে যাক, তা চায়নি দ্রোগান।

‘এটাকে আত্মহনন ছাড়া আর কী বলবো?’ বুড়ো বলে চলে। ‘ক্যারোলিন ছিল আসলে এক খানদানি পরিবারের শেষ সদস্য। ষাটের দশকে ওদের পারিবারিক ব্যবসায় ধস নামে। ফলে চাকরি নিতে হয় তাকে। চাকরি করে ব্যাংকে কিছু ডিপোজিট জমায়। তাই সে মনে করেছিল, বিড়ালটাকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন কিংবা মন্টে কারলোর একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকতে পারবে। ক্যারোলিনেরও বয়স হয়েছিল সত্তরের কাছাকাছি। আগে সে প্রচুর সিগারেট খেত, বিশ্রিরকম অ্যাাজমায় আক্রান্ত হওয়ার পর গত দুই বছরে ছুঁয়েও দেখেনি জিনিসটা। এ বাড়ির তিনতালায় বিশেষভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি ঘরে তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই শেষ বয়সে তার অন্য কোথাও চলে যাওয়াটা মন থেকে মানতে পারছিলাম না। তাই চেয়েছি বিড়ালটাকে যদি রাখতেও হয়, তবু সে থাকুক।’

যা বোঝার তা তো হেলস্টোন আগেই বুঝে নিয়েছে। এ নিয়ে আর বাড়তি কথা শুনে কি হবে? এটা বোঝাতেই নিজের রিস্টওয়াচের দিকে চোখ রাখলো।

পোড়খাওয়া বুড়ো লোকটা চট করে হেলস্টোনের ইঙ্গিত বুঝে নিলো। কাহিনীর লাগাম টেনে দ্রোগান বললো, ‘জুনের শেষ তারিখের রাতে ক্যারোলিন মারা যায়। তার মরদেহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার জানালো, এটা স্বাভাবিক মৃত্যুই। কিন্তু আমি জানি, এটা স্বাভাবিক না। কারণ গেজ আমাকে জানায়, ওই রাতে বিড়ালটা ক্যারোলিনের ঘরেই ছিল।’

‘মৃত্যু আমরা কেউ এড়াতে পারবো না।’একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সহানুভূতি জানায় হেলস্টোন। ‘আমাদের সবাইকে একদিন না একদিন দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে।’

‘সেটাই স্বাভাবিক। ক্যারোলিনের মৃত্যুটাকে ডাক্তারও স্বাভাবিক বলেছিলো। কিন্তু আমি জানি, ঘুমন্ত শিশু আর বৃদ্ধদের উপর চড়াও হতে পছন্দ করে বিড়াল, ওদের নিঃশ্বাস চেটেপুটে খেয়ে নেয়।’

‘এসব হলো কুসংস্কার, গ্রাম্য কেচ্ছাকাহিনী ’।

‘কেচ্ছাকাহিনী এমনি এমনি তৈরি হয় না, এসবের কোনো না কোনো বাস্তব ভিত্তি থাকে।’

নিজের ধারনাকে জোড়ালো করতে হেলস্টোনের সামনে দ্রোগান যুক্তি মেলে ধরে। সে বলে, ‘বিড়ালের স্বভাব-চরিত্র তুমি কতটুকু জানো, জানি না। নোংরা হলেও এরা ভীষণ আরামপ্রিয়। এরা নরম জিনিসের উপর থাবা গেড়ে বসতে পছন্দ করে। তুলতুলে বিছানা, বালিশ কিংবা পশমি কম্বলের ওপর শুয়ে গড়াগড়ি করে। কোনো অসুস্থ মানুষ, যে কখনো কখনো ভালোভাবে শ্বাস নিতে পারে না... নিজের ভার বহনের সামর্থ্য যার পুরোপুরি নেই। এমন কারও বুকের উপর যদি ভারি কিছু রাখা হয়, কি অবস্থা হতে পারে তার!

দ্রোগানের কথায় প্রেমিকাকে হারানোর বেদনা টের পায় হেলস্টোন। ক্যারোলিন ব্রডমুরের মারা যাওয়ার ঘটনাটা নিয়ে সে ভাবতে থাকে। বুড়িটা বেডরুমে ঘুমিয়ে আছে। ক্রনিক অ্যাজমায় তার দুর্বল ফুসফুস গড়গড় শব্দে শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে। সেই শব্দে চাপা যাচ্ছে এয়ার কন্ডিশনের যান্ত্রিক গুঞ্জন। বিরাট আকৃতির কালো বিড়ালটা এগিয়ে এলো নিঃশব্দে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো বিছানার দিকে। সবুজ চোখে একবার তাকালো বলিরেখা ঘেরা ক্যারোলিনের ঘুমন্ত চেহারার দিকে। এক লাফে উঠে পড়লো ক্যারোলিনের শীর্ণ বুকের ওপর। এরপর দেহের ভার ছেড়ে দিয়ে আরাম করে শুয়ে পড়লো। উষ্ণ আরামে মৃদু গরগর শব্দ বের হতে শুরু করলো বিড়ালটার গলা থেকে... গরগরানি যত বাড়ছে, ওটার দেহের নিচে আস্তে আস্তে রুদ্ধ হতে শুরু করেছে দুর্বল বুড়িটার শ্বাস-প্রশ্বাস।

ওই দৃশ্যটা ভেবে কেঁপে ওঠে হেলস্টোন। ভাবাবেগ কখনোই প্রশ্রয় দেয় না সে। মন থেকে তা দূর করতেই কোলে শুয়ে থাকা বিড়ালটার নরম গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়।

‘আমি বুঝতে পারছি না মি দ্রোগান, এরপরও বিড়ালটার বিদায়ের ব্যবস্থা করলেন না। একজন পশু ডাক্তারকে ডেকে বিশ ডলার ধরিয়ে দিলেই তো কাজটা খতম হয়ে যেত।’

‘জুলাইয়ের এক তারিখে ক্যারোলিনের শেষকৃত্য হয়’, বললো দ্রোগান। ‘আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে ছোটবোন এমান্ডার পাশেই কবর দিলাম তাকে। এটাই ছিল তার চাওয়া। পরদিন একটা একটা বাঁশের ঝুড়ি যোগাড় করলাম। জুলাইয়ের তিন তারিখে গেজকে ডাকলাম। ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম ঝুড়িটা। আমি কী বলতে চাইছি, তুমি কি বুঝতে পারছ?

মাথা নেড়ে সায় দিল হেলস্টোন।

‘গেজকে বলেছিলাম, যে করেই হোক বিড়ালটাকে ঝুড়ির ভেতর আটকানোর ব্যবস্থা করবে। এরপর এটাকে নিয়ে যাবে মিলফোডের্র পশু ডাক্তারের কাছে। তাকে বলবে, এখনই ওটাকে মেরে ফেলতে। যেমন হুকুম তেমনই কাজ। বিড়ালটাকে ঝুড়িবন্দি করে রওনা হয়েছিল গেজ। সেই যে গেল, এরপর আর ওকে জীবিত দেখিনি। দুর্ঘটনাটা ঘটে টার্নপাইক রোডের ব্রিজটাতে। ষাট মাইল বেগে ছুটে চলা আমার লিংকন ফাইভটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ব্রিজ থেকে নিচে পড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই মারা যায় গেজ। ওর মরদেহ উদ্ধার করার পর দেখা গেল ওর মুখ জুড়ে আঁচড়ের দাগ।’

বুড়ো দ্রোগান তার বাড়িতে ঘটে যাওয়া অতিপ্রাকৃত ঘটনা বলে চলেছে, আর হেলস্টোনের মনে ঠিক যেন ছায়াছবির মতো দৃশ্যগুলো তৈরি হচ্ছে। ফায়ারপ্লেসে পোড়া কাঠের চড় চড় আর বিড়ালের হালকা গরগর, এছাড়া পুরো ঘরে গাঢ় নিরবতা। অনেকটা এডগার গেস্টের সেই কবিতার মতো-

‘আমার কোলে একটি বিড়াল

সামনে ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে

সৃষ্টি করেছে একজন সুখী মানুষ

যার সন্ধানে হন্যে হয়ে সবাই ছুঁটছে।’

বিশাল আকৃতির লিংকন ফাইভ গাড়িটা ধীরগতিতেই চালাচ্ছে ডিক গেজ। টার্নপাইক হয়ে সে যাচ্ছে মিলফোর্ডের দিকে। বেতের ঝুড়িটা রাখা ছিল গাড়ির পেছনের সিটে। সামনের ঢালু রাস্তায় আরেকটা গাড়িকে পাশ কাটাতে ব্যস্ত ছিল ডিক। ঝুড়িটার মুখ খুলে কখন যে কালো বেড়ালটা বেরিয়ে এলো টের পেল না। ওটা যখন একলাফে ড্রাইভিং সিটে ওঠে এল চমকে ওঠলো সে। মুখের উপর বিড়ালটার ঝাঁপিয়ে পড়া ঠেকাবার সময়ই পেল না। গর্জে ওঠলো বিড়ালটা। ধারলো আঁচড় বসিয়ে দিলো ডিক গেজের মুখে। একট নখ ঢুকে গেল তার চোখে। তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে ওঠলো বেচারা। কোটর থেকে বেরিয়ে এলো থকথকে তরল। একের পর এক চলতেই থাকে নখের থাবা। মাকড়সার মত আঁকড়ে ধরেছে গেজের মুখ। হাতের ঝটকায় কোনোভাবেই সরাতে পারলো বিড়ালটাকে। উল্টো বরং ঘুরে গেল স্টিয়ারিং। টায়ারের তীব্র শব্দে বাঁক নিল গাড়ি। প্রচণ্ড গতিতে ব্রিজের পাশের কনক্রিটের দেয়ালে ধাক্কা খেল লিংকন ফাইভ। মুহূর্তে আগুন ধরে গেল ইঞ্জিনে। গাড়িটা বিস্ফোরিত হওয়ার আগে জানালা দিয়ে টর্পেডোর মতো বিড়ালটা বেরিয়ে গেল বাইরে।

হেলস্টোনের গলা শুকিয়ে যায়। ঢোক গিলে জানতে চায়, এরপর বিড়ালটা আবার এ বাড়িতে ফিরে আসে?

‘পুরনো একটা লোকসঙ্গীত আছে, বিড়ালেরা ফিরে আসে বার বার।’ মাথা ঝুঁকিয়ে বললো দ্রোগান। ‘ ডিক গেজকে কবরে শোয়ানোর একসপ্তাহ পর ওটাও ফিরে আসে।’

‘অবিশ্বাস্য। গাড়ি বিস্ফোরণের পরও প্রাণে বেঁচে বিড়ালটির ফিরে আসা।’

‘ওদের নাকি নয়টা জীবন আছে, লোকমুখে শুনেছি। বিড়ালটা ফিরে আসার পর গভীরভাবে ভাবতে থাকি, আসলে ওটা কী... কী ওটা...!’

‘জাহান্নামের বিড়াল...।’

‘শয়তানের বাহক ওটা। শয়তানই ওকে বার বার ফিরে পাঠায়।’

‘আপনাকে শাস্তি দিতে।’ খোঁচা দেওয়ার সুযোগ পেলে তা কখনোই হাতছাড়া করে না হেলস্টোন। কণ্ঠে উপহাস নিয়ে আবারও বলে, ‘নিশ্চয়ই আপনাকে শাস্তি দিতে।’

‘জানি না। কিন্তু ভয় লাগে আমার। খুব ভয়।’ বুড়োটার গলা কেঁপে ওঠে। ‘এ বাসায় কাজ করতে আসে যে মহিলা, সেও বিড়ালটাকে সহ্য করতে পারে না। ও বলে, ও্ইটা অভিশপ্ত। মেয়েটা অবশ্য স্থানীয় ও অশিক্ষিত।’

নিজেকে সান্তনা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে দ্রোগান। বিচলিত ভঙ্গিতে বলে, ‘ওটাকে মারতে হবে। যে করেই হোক ওটাকে তোমার মারতে হবে। এ বাড়িতে গত চারমাস ধরে আমার সঙ্গে ওটা আছে। ছায়ার মতো ওটা হেঁটে বেড়ায়। আড়ে আড়ে আমার দিকে ফিরে তাকায়। মনে হয়, ওটা অপেক্ষায় আছে। রাতে দরোজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমোতে যাই। ঘুম আসে না। কেবল মনে হয়, ঘুম থেকে ওঠে দেখবো, বুকের উপর ওঠে এসেছে জানোয়ারটা। থাবা বাসনোর আগে গরগর করছে।’

বাইরে উথাল-পাতাল শীতল হাওয়া বয়ে যায়। ঢুকে পড়তে চায় পাথুরে চিমনির ভেতরে। পাগলা হাওয়া বাঁধা দেয় ফায়ারপ্লেসের উত্তাপ। ছড়ায় শন শন অপার্থিব শব্দ। সেই শব্দকে চাঁপা দেয় দ্রোগানের খন খনে কন্ঠ।

‘সোল লজিয়াকে একদিন আমার ইচ্ছের কথা জানাই। সেই বললো তোমার কথা। এ কাজের জন্য নাকি তুমি একাই যথেষ্ট।’

‘আমি একা একাই কাজ করতে পছন্দ করি।’

‘লজিয়াও তাই বললো। কোনো কাজে নাকি ব্যর্থ হওনি তুমি। কখনো ধরাও খাওনি। বিড়ালের মতো নিঃশব্দে শিকার করতে ওস্তাদ তুমি।’

হুইলচেয়ার বসে থাকা বুড়ো লোকটার দিকে তাকানো হেলস্টোনের চেহারায় ফুটে ওঠে নিষ্ঠুরতা। তার পেশিবহুল হাতের মোটা মোটা রুক্ষè আঙুল নেমে এলো বিড়ালটার গলার কাছে। ঠান্ডা গলায় সে বলে, ‘আপনি যদি চান কাজটা এখনই করে ফেলতে পারি। ওটা কিছু টের পাওয়ার আগেই ঘাড়টা মটকে ফেলব।’

‘না না। এখানে না।’ আর্তনাদ করে ওঠলো দ্রোগান। লম্বা করে একটা শ্বাস নিয়ে বললো,‘তুমি এটাকে এ বাড়ি থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যাও।’ বুড়োর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হাসলো হেলস্টোন। বিড়ালটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বললো, ‘ঠিক আছে। কাজটা আমি করবো। মরা দেহটা আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব।’

‘না, দরকার নেই। ওটাকে মেরে ফেললেই হবে। এরপর পুঁতে ফেলো কোথাও।’ একটু থেমে কিছু একটা ভাবলো দ্রোগান। হুইল চেয়ার থেকে সামনের দিকে বুড়ো বাজপাখির মতো মুখ বাড়িয়ে বললো, ‘কেবল ওটার লেজটা আমার চাই, যেন আগুন ছুঁড়ে মারতে পারি। দেখতে পারি কীভাবে ওটা পোড়ে।’

হেলস্টোন সাইক্লোন স্পোন ইঞ্জিনের ১৯৭৩ প্লাইমাউথ গাড়ি চালায়। চুরি করা গাড়িটার কিছু অংশ সে নিজের মতো করে পাল্টে নিয়েছিল। ওয়াইড টায়ার লাগনো গাড়িটি ঘন্টায় একশ ষাট কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে। দ্রোগানের অট্টালিকা থেকে হেলস্টোন রাত সাড়ে নয়টার দিকে বেরিয়ে এলো। নভেম্বরের আকাশে চলছিল আধখানা আকারের চাঁদ আর ছেঁড়া মেঘের লুকোচুরি। কনকনে ঠান্ডার মাঝেও গাড়ির সবকটা জানালা খুলে দিয়ে এগোতে থাকে। বুড়োটার বাড়ি থেকে বয়ে আনা বার্ধক্য আর ভীতির দুর্গন্ধ দূর করতে চাইছিলো সে। শীতে হাতপা অসাড় হয়ে এলেও বাইরের হিমেল হাওয়ায় চাঙা হয়ে ওঠে হেলস্টোন।

প্লেসার গ্লেন হয়ে টার্নপাইক দিয়ে যাচ্ছে হেলস্টোন, নির্জন শহরের মাঝখান দিয়ে ছুটে চলেছে একা। ফাঁকা রাস্তায় বাড়িয়ে দিয়েছে প্লাইমাউথের গতি। বিড়ালের মতোই গরগর শব্দ করছে টিউন করা স্পোনের ইঞ্জিন। বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটের কোণায়। শহর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। দুপাশে পাকা ভুট্টোক্ষেতের মধ্যে দিয়ে সত্তর মাইল বেগে ছুটছে গাড়ি।

বিড়ালটাকে ডবল লেয়ারের একটা শপিং ব্যাগের ভেতর ভরে নিয়েছে সে। শক্ত দড়িতে বেঁধে দিয়েছে ব্যাগের মুখ। ড্রাইভিং সিটের পাশেই ব্যাগটা রাখে। ওটাকে ব্যাগের ভেতর ঢোকানোর সময় মোটেও বাঁধা দেয়নি। ঘুমে ঢুলু ঢুলু ছিল, শব্দ করছিল গরগর। বিড়ালটা বোধহয় ভেবেছিল, হেলস্টোন তাকে আদর করার জন্য ব্যাগে ঢুকাচ্ছে।

বড় অদ্ভুত এই খুনের মিশন। মনে মনে ভাবছে হেলস্টোন। এই সহজ কাজটাকে এতো সিরিয়াসলি নেওয়ার কোনো মানে হয় না। এটা ঠিক যে বিড়ালটাকে তার খুব পছন্দ হয়েছে। ওটার প্রতি একধরনের মমতা অনুভব করছে সে। নিষ্ঠুর বৃদ্ধের কবল থেকে এটাকে মুক্ত করতে পারলে তার ভালোই লাগতো। আহা, কি নির্দয় আচরণ করা হয়েছে বিড়ালটার সঙ্গে। গেজ চেয়েছিল ওটাকে মিলফোর্ডের পশুচিকিৎসকের গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মেরে ফেলতে। বিড়ালটার প্রতি জেগে ওঠা মমতাবোধটা মাথা থেকে সরানোর চেষ্টা করলো সে। যতোই মায়া তৈরি হোক, ওটাকে মেরে ফেলতে তার হাত মোটে কাঁপবে না। কারণ কখনো চুক্তির বরখেলাপ করেনি, এবারও করবে না। কাজটা করবে সে খুব দ্রুত। বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে ঘট করে ঘাড়টা মটকে দিবে। এরপর চাকু দিয়ে কেটে নিবে ওটার লেজ। পরিত্যক্ত কোন মাঠে নিয়ে এমনভাবে পুঁতে ফেলবে যাতে শেয়াল-বেজি ওটাকে খুঁড়ে বের করতে না পারে।

নির্জন রাস্তায় ভৌতিক অন্ধকারে তীব্র বেগে প্লাইমাউথ চালাতে চালাতে এসবই ভাবছিল হেলস্টোন। আচমকা বিড়ালটা তার চোখে পড়লো। লেজ উুঁচ করে দাঁড়িয়ে আছে ড্যাশবোর্ডের ওপর। অশুভ মুখটা তার দিকে ফেরানো, দেখে মনে হচ্ছে শয়তানির হাসি হাসছে।

হায় হায় রে... আঁতকে উঠলো হেলস্টোন। কীভাবে যেন শপিং ব্যাগটার একপাশ ছিঁড়ে ওটা বেরিয়ে পড়েছে। চোখের পলকে বিড়ালটা সাই করে একটা থাবা মারলো তার চেহারায়। ঝট করে মাথাটা সরিয়ে নিল হেলস্টোন, কাপলে এসে লাগলো থাবাটা। অল্পের জন্য রক্ষা পেল চোখটা। কিন্তু ড্যাশবোর্ডের ওপর থেকে বিড়ালটা সরলো না। এমনভাবে ওটা চোখের সামনে জায়গা করে নিয়েছিল যে, হেলস্টোন সামনের কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। একহাতে স্টিয়ারিং সামলে অন্যহাতের তালুর উল্টো পিঠ দিয়ে ঝটকা মেরে বিড়ালটাকে সরিয়ে দিতে চাইলো সে। সরে যাওয়ার বদলে বদমাইশটা ঝাপ দিয়ে পড়ল তার উপর।

ডিক গেজ, বুড়ো দ্রোগানের সেই ভৃত্যের কথা মনে পড়ে গেল হেলস্টোনের। গেজের সঙ্গে যা হয়েছিল ঠিক তাই হচ্ছে...।

আচমকা ব্রেক কষলো সে। বিড়ালটা ছিল তার মাথার, নড়লো না একচুলও। হেলস্টোনের দু’চোখ ঢাকা পড়েছিল ওটার লোমশ পেটের নিচে, বার বার খামচানোর চেষ্টা করছিল। আগের মতোই গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে রেখে অন্যহাতে কয়েকবার ওটাকে আঘাত করলো সে। কিন্তু কোনো লাভ হলো কই? উল্টো বরং গায়েব হয়ে গেল রাস্তা। পাশে পাথুরে উঁচুনিচু জমিন দিয়ে নিচে নামতে শুরু করলো প্লাইমাউথ। লাফাতে থাকলো গাড়িটি। একটা বড় পাথরের ওপর ওঠে গেল টায়ার। প্রচন্ড একট ধাক্কায় সিটবেল্ট প্রায় ছিঁড়ে সামনের দিকে নিয়ে ফেললো হেলস্টোনকে। মাথার ভার কমে গেল। শুনতে পেল বিড়ালটার পাশবিক কাতরানি, যেন অতৃপ্ত কোনো নারীর যৌন আনন্দের চুড়ান্ত মুহূর্তের প্রবল শিৎকার। চারপাশে ঘনিয়ে এলো গহীন অন্ধকার।

আকাশের আধখানা চাঁদ ডুবে গিয়েছিল আগেই। ভোর হতে বাকি আরও কিছু সময়। দূর থেকে ভেসে এলো ভীত সন্ত্রস্ত একটা প্যাঁচা ছানার কান্না। দুমড়ানো মোচড়ানো প্লাইমাউথটা পড়ে আছে একটা গিরিখাতের মাঝখানে। রাস্তার পাশের ব্যারিকেডের কাঁটাতার পেঁচিয়ে গেছে গাড়িটার বডিতে। রেডিয়েটর ফেটে উড়ছে কালচে ধোঁয়া।

কতোক্ষণ হেলস্টোন অচেতন ছিল অনুমান করতে পারলো না। হাতড়ে হাতড়ে গাড়ির দরোজার হাতলটা খুঁজে পেল। কিন্তু পা দুটোয় কোন সাড়া নেই। ইঞ্জিনের একটা অংশ এমনভাবে ঢুকে গেছে গাড়ির ভেতর তাতে চাপা পড়েছে ডান পা। আরেক পায়ে ঢুকে গেছে একটা পাইপ। রক্ত ঝড়ছে। নড়ার ক্ষমতা নেই । বেদনা বোধ হারিয়েছে সে।

কানে হাসলো বিড়ালটার মৃদু গরগরানি। অক্ষতই আছে শয়তানটা। পাশের সিটে বসে ওটা যেন হেলস্টোনের জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় ছিল। আয়েশ করে আড়মোড়া ভাঙলো। এরপর লাফ দিয়ে ওঠে পড়লো ঘাড়ের উপর। ওটাকে সরাবার চেষ্টা করতে গিয়ে সে আবিষ্কার করলো, হাত দুটোও নাড়াতে পারছে না।

ঘাড়ে বসে কানের কাছে বিড়ালটা গজরাতে শুরু করলো। হেলস্টোন ভয়ংকরভাবে খেঁকিয়ে উঠলো, সরে যা আমার ওপর থেকে, সরে যা হারামজাদা। আচমকা কর্কশ কণ্ঠ শুনে কি ভয় পেল বিড়ালটা! ঘাড় থেকে লাফ দিয়ে নেমে গেল পাশের সিটে। পরের মুহূর্তেই ঝাঁপ দিল তার কণ্ঠনালী বরাবর। উহ তীব্র যন্ত্রণা, বেরিয়ে আসছে উষ্ণ রক্ত ¯্রােত। তীক্ষè থাবায় আঁচড়াতে লাগলো ক্লিন সেভড হেলস্টোনের দুইগাল। বিড়ালটার রোমশ পেটে কামড় দিল সে। মুখ ভরে গেল কালো পশমে। চমকে উঠে সরে গেল ওটা একটু দূরে, রাগে গজরাচ্ছে।

ক্ষত-বিক্ষত শরীরের তীব্র বেদনাবোধকে ছাড়িয়ে গেল এক অস্বস্তিকর অনুভূতি। হেলস্টোন বুঝতে পারলো অসাড় হাত-পায়ে ফিরে আসছে অনুভূতি। ভাবছে, দুর্ঘটনাটা সাংঘাতিক আর মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে সে। কিন্তু বিড়ালটার কিছু হলো না কেন?

পাশের সিটেই বসে ওটা মুখ ফাঁক করে হিসহিস করেই চলেছে। মনে পড়ে গেল দ্রোগানের কথা, বুড়ো বলেছিল জাহান্নাম থেকে আসা বিড়াল ওটা। একদম ভুয়া কথা। হাতের অনুভূতি ফিরে পেয়েছে সে। ডান হাতটা একটু নাড়লো সে। শোল্ডার হোলস্টারে অনুভব করলো পয়েন্ট ফোর ফোর হাইব্রিড রিভলবারটা অস্তিত্ব। হাতটাকে কেবল নিয়ে যেতে হবে সেখানে। সারা দেহে তীব্র যন্ত্রণা, তবু হেলস্টোনের মুখে ফুটে ওঠে বাঁকা হাসি।

বিড়বিড় করে সে বলে, এমনটা করতে আমি চাইনি রে কিটি। অস্ত্রটা যদি ধরতে পারি, একবারে তোর ইহকালের সঙ্গে পরকালও শেষ করে ফেলব আজ। গুলি করে মানুষের খুলি উড়িয়ে দিলেও কোনো পশুর খুলি উড়িয়ে দেওয়া হবে এবারই প্রথম। বুঝলিরে শয়তানের বাচ্চা কিটি? আর দু-চার মিনিটের মধ্যে হাতটা আমার জায়গা মতো পৌঁছে যাবে। আমার পরামর্শ চাস? জানালা খোলা আছে, সময় থাকতে এখনই পালা। মনে করে সঙ্গে তোর লেজটাও নিয়ে যা।

আরে আরে বিড়ালটা গেল কোথায়? পাশের সিট থেকে ওটা অদৃশ্য হয়ে গেছে মুহূর্তেই। কই গেল? মাথা ঘুরিয়ে পেছনের সিটে দেখার চেষ্টা করলো হেলস্টোন। পারলো না। ঘাড়ের তীব্র ব্যাথায় গুঙিয়ে ওঠলো। ব্যাকভিউ মিররের সন্ধানে উপর দিকে চাইলো সে। অক্ষত নেই জিনিসটা, ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে কোথাও।

সবার আগে বিড়ালটার ব্যবস্থা করতে হবে, ভাবছে হেলস্টোন। এরপর চেষ্টা করতে হবে প্লাইমাউথটা থেকে বের হওয়ার। কেউ না কেউ নিশ্চয় বিধ্বস্ত গাড়িটা দেখে এগিয়ে আসবে সাহায্য করতে। কিন্তু ভোর সাড়ে চারটায় এমন একটা উল্টোপথে কেই বা আসবে? তবু সম্ভাবনা যে একদম নেই তাও না। আর...।

গরগর গররগরর। হেলস্টোনের ভাবনার তাঁর ছিড়ে গেল। পিছন থেকে এলো শব্দটা। এ তো বিড়ালের নাকডাকার শব্দ। নিশ্চিত ঘুমিয়ে পড়েছে ওটা। ঘুমাক আর না ঘুমাক, ওটাকে মরতেই হবে। আবারও ডানহাতটা নাড়াবার চেষ্টা করলো। কোলের ওপর থেকে আধ ইঞ্চি সরাতে পারলো। দাঁত চেপে ব্যাথার তীব্রতা সহ্য করার চেষ্টা করছে সে। যেভাবেই হোক হাতটাকে নিয়ে যেতে হবে শোল্ডার হোলস্টারে। তারপর তর্জনিটা রাখবে ট্রিগারে। বিড়ালটাকে দেখা মাত্রই দেবে চাপ। ভুম... সাঙ্গ হবে জাহান্নামের কালো বিড়ালের ভবলীলা।

পূবের আকাশে কমলা রঙের সূক্ষ আলোর আভা। কোথাও গেয়ে উঠলো একটা পাখি। ভোর হচ্ছে ধীরে ধীরে। হাতে শক্তিও ফিরে পাচ্ছে হেলস্টোন। অসহ্য ব্যাথা সয়ে হাতটাকে রিভলবারের খুব কাছাকাছি নিয়ে যেতে পেরেছে সে। আর মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে হোলস্টার।

খস খস করে শব্দ হল। বিড়ালটাকে আবারও দেখা গেল। হেলস্টোন দুপায়ের মাঝখানে এসে বসেছে ওটা। চোখের সবুজ মণি জ্বলজ্বল করছে। লাথি দিয়ে ওটাকে সরানোর অবস্থা নেই তার। একপা চাপা ইঞ্জিনে, অন্যপায়ে ঢুকে আছে পাইপ। পা নাড়ানোই অসম্ভব।

উপহাসে বিড়ালটা ভেংচি কাটলো তাকে। হেলস্টোনের তাই মনে হলো। চূড়ান্ত আঘাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে ওটা। বিড়ালটার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে আর্তচিৎকার দিল সে। অমনি ওটার থাবা পড়লো দুপায়ের মাঝখানে। নখ বের করে ছিড়ে ফেরলো প্যান্টের মোটা ক্যানভাস কাপড়। দানবীয় যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়লো তার সারা দেহে। বিড়ালটা তার অণ্ডকোষে কামড় বসিয়েছে।

মুখ হাঁ করে আর্তনাদ করে ওঠে হেলস্টোন। ঠিক তখনই বিড়ালটা তার খোলা মুখের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয় মাথাটা। মুহূর্তেই তার মনে হলো একটা কথা, এটা সাধারণ কোন বিড়াল হতেই পারে না। এটা অশুভ, অপার্থিব জগতের প্রাণী।

বিড়ালটা চুড়ান্ত আঘাত হানলো হেলস্টোনের মুখের ভেতরে। কণ্ঠরোধ হয়ে এলো তার। দুই থাবায় তার কণ্ঠনালী ছিড়ে ফেললো ওটা। ধারালো নখরে ফালাফালা হয়ে গেল জিহ্বা। বমি করে দিল হেলস্টোন। সেই বমি বাইরে বের হতে পারলো না। কণ্ঠনালী দিয়ে আবারও ঢুকে পড়লো গলার ভিতরে। দম বন্ধ হয়ে এলো তার।

একটু একটু করে বিড়াল ঢুকে পড়ছিল হেলস্টোনের মুখের ভেতর। শরীরটাকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে কুঁচকে ছোট করে ঢুকছে ওটা। প্রাণীটাকে ঢোকার জায়গা করে দিতে ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছিল তার চোয়াল। শেষ চেষ্টায় হাত নাড়াতে পারলো সে। ওটাকে টেনে বের করতে হাত বাড়ালো। কোনোরকমে একবার কেবল লেজটা ছুঁতে পারলো।

বিশাল দেহ নিয়ে কালো বিড়ালটা অলৌকিক কোনো কৌশলে ঢুকে পড়লো হেলস্টোনের মুখের ভেতরে। স্প্রিংয়ের মতো কয়েকবার ঝাঁকি খেল তার দেহ। শরীরটা মুচড়ে উঠলো। হাতদুটো ধপ করে পড়ে গেল কোলের ওপর। সিলেন্ডার থেকে গ্যাস বের হওয়ার মতো ‘হসস’ শব্দ বের হয়ে এল গলা থেকে। খোলা দুটি চোখ কোটর ঠেলে বেরিয়ে এসে স্থীর চেয়ে রইলো উইন্ডশিল্ডে চুইয়ে আসা ভোরের প্রথম আলোর দিকে।

হেলস্টোনের মুখের বাইরে তখনও একটা কালো চকচকে লেজ বেরিয়েছিল ইঞ্চি দুয়েকের মত, নড়ছিল এদিক-ওদিক। কিছু সময় পড়েই তা অদৃশ্য হয়ে গেল পুরোপুরি।

নভেম্বরের সকালটাকে উজ্জ্বল করে সূর্যের কিরণ ছড়িয়ে পড়তে থাকলো কানেক্টিকাটের প্রান্তরে।

খাদের মধ্যে পড়ে থাকা থাকা প্লাইমাউথটা প্রথম দেখলো স্থানীয় এক কৃষক, নাম উইল রিউস। ট্রাকে করে নিজের খামারে যাচ্ছিল সে। চোখ গেল গিরিখাতে। ট্রাক থেকে নেমে একটু এগিয়ে দেখলো, নিচের কাঁটাতার জড়ানো বিধ্বস্ত গাড়িটাকে। সাবধানে নিচে নেমে এলো। যা দেখলো, বিস্ময় আর আতঙ্কে স্তম্ভিত হয়ে গেল সে।

রিউস দেখলো, চালকের আসনে সিটবেল্ট বাঁধা লোকটার মুখে লেপ্টে আছে রক্ত। চেহারাটা ক্ষতবিক্ষত। কোটর ছেড়ে বের হওয়া প্রাণহীন চোখ দুটি চেয়ে আছে শূন্যে।

অনেক কষ্টে গাড়িটার জ্যাম হয়ে থাকা দরজাটা খুলতে পারলো উইল রিউস। সিটবেল্ট থেকে মুক্ত করলো মরদেহটাকে। রক্তে ভেজা কোটের পকেট হাতড়ালো আইডি কার্ড জাতীয় কিছু যদি পাওয়া যায়। হঠাৎ সে টের পেল, লাশটির তলপেটে কেমন যেন ঢেউ খেলে যাচ্ছে। একবার উঁচু হচ্ছে, মুহূর্তে আবার স্বাভাবিক হচ্ছে। বেল্টের ওখানটা একটু একটু করে ফুলে উঠছে। কী আজব ঘটনা!

হায় ঈশ্বর, এসব কী হচ্ছে। লাশটির শার্ট টেনে উপড়ে তুলে দিল সে। ক্রস আঁকলো নিজের বুকে। দেখতো পেল মৃত লোকটার নাভির মাংশ ছিন্নভিন্ন করে তৈরি হয়েছে একটা গর্ত। ওই গর্তে উকি দিল রক্তমাখা একটা কালো বিড়ালের মুখ, চোখদুটো জ্বলছে ঠিক আগুনের গোলার মতো।

আতঙ্কে কাঁপতে থাকলো উইল রিউস। একঝটকায় পেছনে সরে এলো। অপার্থিব দৃশ্যটার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে রইলো সে। দেখলো, লাশটার পেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা কালো বিড়াল। লাফ দিয়ে স্টিয়ারিংয়ের ওপর বসলো। জিহ্বা বের করে গোঁফে লেগে থাকা রক্ত চেটে চেটে খেল। এরপর একলাফে গাড়ির ওপাশের জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেল। নিমিষেই হারিয়ে গেল রুক্ষ্ম মাঠের সোনালি ঘাসের জঙ্গলে।

ওই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে উইল রিউস পত্রিকার রিপোর্টারকে বলেছিল, ‘আমার মনে হচ্ছিল, ওটার অন্য কোথাও যাওয়ার বুঝি খুব তাড়া আছে। যেন কোনো এক অসমাপ্ত কাজ বাকি রয়ে গেছে।’

[স্টিফেন কিংয়ের ‘দ্য ক্যাট ফ্রম হেল’ অবলম্বনে]

পূর্বপশ্চিম- এনই

বিপুল হাসান,স্টিফেন কিং,দ্য ক্যাট ফ্রম হেল
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close