• শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

বইমেলা প্রাঙ্গণে বিকাশ স্টল, চিত্রশিল্পীদের স্টল কোথায়!

প্রকাশ:  ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৫:৪২
জান্নাতুল মাওয়া সুইটি

বইমেলায় ঘুরতে এসেছেন ফাতেমা। পছন্দের বই কিনেছেন স্টল ঘুরে ঘুরে। ফেরার পথে তিনি চিত্রশিল্পীদের খুঁজছেন। কারণ তার মায়ের পুরানো একটি ছবির পোট্রেট আঁকতে চান তিনি। কিন্তু অনেক খুঁজেও তিনি কোন চিত্রশিল্পীকে মেলার মাঠে ও আশেপাশে কোথাও দেখতে না পেয়ে ফিরে গেলেন।’ প্রতিবছর বইমেলা প্রাঙ্গণে অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ঢোকার মুখে পেন্সিল আর ক্যানভাস নিয়ে বসতেন তরুণ চিত্রশিল্পীরা। কিন্তু এবারের বইমেলায় তাদের দেখা নেই। অনেকেই তাদেরকে খুঁজে না পেয়ে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাড়ি ফিরছেন।

চিত্রশিল্পীদের বেশিরভাগই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী। এরা মূলত মেলায় আসা দর্শনার্থীদের পোট্রেট আঁকতেন। বছরের পর বছর মেলায় আসা ক্রেতাদের অনেকেই মেলার আগে থেকে ভেবে থাকে এবারের মেলা চলাকালীন সময়ে নিজেদের অথবা প্রিয়জনদের ছবি আকঁবেন অথচ তারা নিরাশ হচ্ছেন। কারণ চিত্রশিল্পীদেও দেখা নেই। তবে কেন দেখা নেই রঙের কারিগরদের?

সম্পর্কিত খবর

    খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, চিত্রশিল্পীদের মেলায় ঢোকার অনুমতি নেই। এমনকি মেলার বাইরেও বসার নির্দেশ নেই। এক চিত্রশিল্পী জানালেন, ‘প্রতিবছর আমরা মেলার জন্য অপেক্ষা করে থাকি। একুশে গ্রন্থমেলা শুরু হলে আমাদের কদর বাড়ে। এই কাজে শিল্পীদের মনের খোরাকটাই আসল হলেও আয়-রোজগারও হয়। তবে সবসময় অনেকটা ভাসমান দোকানীদের মতই থাকতে হয় শিল্পীদের। বইমেলার এই দীর্ঘপথ চলায় ও আমাদের কোনো স্থায়ী ঠিকানা হয়নি। বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন তিনি।

    যার হাত ধরে শুরু হয়েছিলো বইমেলায় চিত্রশিল্পীদের পোট্রেট আঁকানোর প্রচলন তিনি হলেন চিত্রশিল্পী রাজু সাহা। তিনি বলেন. ‘১৯৯৮ সাল থেকে বইমেলায় আঁকাআঁকি শুরু করি। তৎকালিন মহাপরিচালক কবীর নুরুল হুদা মেলা প্রাঙ্গণে আমার হাতে ক্যানভাস দেখে বলেছিলেন ছবি আঁকতে চাও? তখন হ্যাঁ বলায় উনি আমাকে বইমেলায় বসতে অনুমতি দেন। পরবর্তীতে সুমন, রতনসহ আমরা তরুণ চিত্রশিল্পীরা একসাথে ছবিমেলা প্রাঙ্গণে পোট্রেট আঁকা শুরু করি। জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি ছবি এঁকে সুনাম অর্জন করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু গত ২ বছর ধরে আমাদেরকে মেলা প্রাঙ্গণে বসতে দেওয়া হচ্ছে না। মেলা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অনেকবার যোগাযোগ করা হলেও আমাদের বসার অনুমতি মেলেনি।

    অনেক ক্রেতারা মেলায় এসে আমাদেরকে খোঁজেন। অনেকেই মেলা শুরু হওয়ার আগে থেকে বলেন ভাই, এবারের মেলায় থাকবেন তো! আমরা তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছি না। আমরা বইমেলায় ছবি আঁকার প্রচলন শুরু করলেও আমরাই এখন ছবি আঁকতে পারছি না।’ অনেকটা আক্ষেপ নিয়ে এই চিত্রশিল্পী বললেন, বর্তমানে মেলার স্থান বেড়েছে। সেইসঙ্গে বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন স্টল রয়েছে যেমন-খাবারের স্টল, রক্তদান কর্মসূচি, বিকাশ ইত্যাদি। তবে আমাদের জন্য একটি স্টল দিতে সমস্যা কোথায়?

    সাধারণ মানুষকে আমরা একটি ছবি আঁকিয়ে দিয়ে বিনোদন দিয়ে থাকি। আমাদের শিল্পকর্মকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে। এমন হলে তো চিত্রশিল্পীরা হারিয়ে যাবে। বইমেলায় অনেক শিশু-কিশোররা আসে। তারা এসে যখন মেলা প্রাঙ্গণে ছবি আঁকার দৃশ্য দেখবে তখন তাদেরও অনেক ভালো লাগবে। তারা এই শিল্পটাকে বুঝতে শিখবে। আমরা যখন বসতাম তখন অনেক অবিভাবকরা তাদের সন্তানদেরকে আমাদের দেখিয়ে বলতেন দেখো আংকেলের মত ছবি আকঁতে হবে কিন্তু! অনেকেই আসতো তাদের বাবা-মা বা প্রিয়জনের শেষ স্মৃতি একটি পুরোনো ছবি নতুন করে আঁকিয়ে নেওয়ার জন্য। তাদের প্রত্যাশা পূরণে ও আনন্দ দেওয়ার জন্যই আমরা ছবি আঁকি। কিন্তু বর্তমানে শিল্পকর্মকে বাণিজ্যিকভাবে রুপ দেওয়া হচ্ছে। প্রশাসনিক জটিলতায় আমরা শিল্পচর্চা করতে পারছি না।’

    এদিকে বইমেলা প্রাঙ্গণে বিকাশ স্টলের সামনে দেখা গেলো দু’জন চিত্রশিল্পকে। যারা সেখানে বসে ছবি আঁকছেন। জানা গেলো, যেসব ক্রেতারা নির্দিষ্ট বিকাশ স্টলে এসে একাউন্ট খুলবেন তারা পাবেন বিকাশের সৌজন্যে ফ্রি পোট্রের আঁকার সুযোগ। এটি অনেকটা বিণিজ্যিকিকরণ বলে উল্লেখ করে চিত্রশিল্পী রাজু সাহা বলেন, ‘আমিও দেখেছি বিকাশ স্টলে বসা দু’জন আর্টিস্টকে। তবে তাদের ছবি আঁকা নিয়ে আমাদেরও সন্দেহ রয়েছে। আমাদের সঙ্গে তাদের কোন সংযোগ নেই। শুধুমাত্র বাণিজ্যিকভাবেই তাদেরকে বসানো হয়েছে। শিল্পের কদর করতে নয়।’ তিনি আরও বলেন, ভাষার মাসে আমরা ভাষাকে সম্মান জানানোর জন্যই বইমেলার আয়োজন করি। বইয়ের সঙ্গে চিত্রের ওতোপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। মেলায় যখন ক্রেতারা যখন বই কিনতে আসেন তখন কিন্তু প্রথমে বইয়ের প্রচ্ছদগুলোই আগে দেখেন তারপর মলাট উল্টান! আর বইয়ের প্রচ্ছদগুলো আঁকান চিত্রশিল্পীরা। অথচ সেব শিল্পীদেরই কদর নেই!

    এই শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মেলা প্রাঙ্গণে যদি ২ বা ৪ জন আর্টিস্ট বসে ছবি আকাঁন তাহলে তো কোন সমস্যা হওয়ার কথা নই। বইমেলার কর্তৃপক্ষসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে সেলফির যুগ চলছে। আর এ সময়েও হাতে আকাঁ ছবি দেখার আগ্রহ রয়েছে সবার মনেই। এভাবেই যদি চিত্রশিল্পীদেরকে অবজ্ঞা করা হয় তবে তো ছবি আঁকার প্রচলন হারিয়ে যাবে। আমাদের শিল্পচর্চায় সহযোগিতা করে বইমেলায় যেন একটা অবস্থান তৈরী কওে দেওয়া হয় এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সজাগ দৃষ্টি কামনা করছি। এই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখুক তারা। আমরা শিল্পের চাষ করতে চাই যাতে ভবিষ্যত প্রজন্মরা ফসল হিসেবে নিজেদের দৃষ্টান্ত তৈরী করতে পারে।’

    আরেক চিত্রশিল্পী রতন বলেন, ‘প্রশাসনিক অনুমতি না পাওয়ায় আমরা মেলায় বসতে পারিনি। যথেষ্ট জায়গা থাকা স্বত্ত্বেও আমরা জায়গা পাচ্ছি না। বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষরাও ছবি আকার বিষয়ে জানা স্বত্ত্বেও আমাদের স্থান দিচ্ছে না। যখন আমি মেলায় ছবি আঁকতাম তখন অনেকেই আসতো কিন্তু এখন অনেক পরিচিতরাও আমাকে খুঁজে পাচ্ছে না। সবাই ছবি আঁকা পছন্দ করে। এই বিনোদন আমরা সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই। বইয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত ছবি আঁকা। আর বইমেলা মানেই শিল্পী সাহিত্যিকদের মিলনমেলা। বইপ্রেমী যারা মেলায় আসেন তখন ছবি আকার বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত।

    চিত্রশিল্পীদের গুরুত্ব বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘ভাষার জন্য যেমন দেশের মানুষ রক্ত দিয়েছেন তেমনি ভাষার জন্য শিল্পীরাও রঙ দিয়েছেন। এই অক্ষর, বর্ণমালাগুলো সবই আঁকানো হয়েছে। আমরা মুখেই ভাষা বলতাম। বর্ণমালার অক্ষরগুলো কেমন হবে তা কিন্তু আমাদের জানা ছিলো না। চিত্রশিল্পীদের মাধ্যমেই কিন্তু ভাষাকে অক্ষরে রুপ দেওয়া হয়েছে। ছবির মাধ্যমেই কিন্তু বর্ণমালাগুলো প্রকাশ পায়।

    আপনারা সবাই লক্ষ্য করেছেন বইমেলা প্রাঙ্গণের সাজসজ্জায় ফুটে উঠেছে চিত্রশিল্পীদের হাতের কারুকাজ। ভাষা আন্দোলনের চিত্রকর্ম দিয়েই কিন্তু বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ সাজানো হয়েছে আর এগুলো একেছেন শিল্পীরা। তাহলে আমাদের অবস্থানটা আসলে কোথায়? তিনি প্রশ্ন রাখেন। আগে আমরা বইমেলার ভেতরে ছবি আঁকতাম। এরপর স্থান সংকুলান না হওয়ায় আমাদেরকে বাইরে বসতে বলা হলো। এরপর যখন বাইরে বসা শুরু করলাম এরপর পুলিশ ঝমেলা করত। আমাদের পাশেই বইয়ের হকাররা বসত। একসময় বুঝতে পারলাম পুলিশ আমাদের সঙ্গে হকারের মত ব্যবহার করছে। যখন নিয়ম হল মেলা প্রাঙ্গণে হকার বসবে না আমরাও হকারের সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেলাম! যখন মেলা সোহরাওয়ার্দিতে চলে গেল তখন ভেবেছিলাম হয়ত এবার আমাদের জন্য স্থান সংকুলান হবে কিন্তু তবুও আমরা জায়গা পাইনি বলে জানালেন তিনি।

    চিত্রশিল্পীরা ২০১৭ সালে মেলায় স্থান না পাওয়ায় সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন। এ বিষয়ে তরুণ এ চিত্রশিল্পী বলেন, ‘মন্ত্রী অনেক সহযোগিতা করেছেন আমাদেরকে। কিন্তু অন্যান্য কর্তৃপক্ষরা সায় পাইনি। আমি বইমেলাকে বাণিজ্যিকভাবে দেখি না। আমাদের অন্তরের সঙ্গে মিলেমিশে আছে বইমেলা। একদিন মেলা প্রাঙ্গণে না গেলে খারাপ লাগে। মেলায় আঁকতে না পারলেও প্রতিদিন অন্তত মেলায় ঢুকে ঘোরাঘুরি করি।

    আমি একজন চিত্রশিল্পী। কিন্তু আমার কদর নেই! এই ভেবে খারাপ লাগে। শুধু আমি নয় সকলের অবস্থা একই। এখন মনে হয় কেন আর্টস নিয়ে পড়েছি? এই আক্ষেপ হয়ত অনেকের মনেই রয়েছে। কারণ আমরা মূল্যায়ন পাচ্ছি না। শিল্পীদেরও তো পেট আছে। আমরা অনেকের ছবি ফ্রিতেও আঁকিয়ে দেই। কারণ আমাদের ভালো লাগা এটি। আমাদের পেশা ছবি আঁকা, নেশাও এটি।’

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close