• রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

জাবিতে গণধর্ষণ: অবৈধভাবে হলে থাকতেন ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজ

প্রকাশ:  ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৮:১৬ | আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৮:৫৮
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) এক দম্পতিকে ডেকে নিয়ে স্বামীকে আবাসিক হলে আটকে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর রহমান অবৈধভাবে আবাসিক হলে থাকতেন। বিধি-বহির্ভূতভাবে এক বছরের বেশি সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের একটি কক্ষ দখল করে অবস্থান করছিলেন তিনি।

সূত্রে জানায়, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজ মীর মশাররফ হোসেন হলের “বি” ব্লকের ২০৫ নম্বর কক্ষে থাকতেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদকের পদে ছিলেন। তবে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পরপরই ছাত্রলীগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয় সংগঠন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর শুরু হয়ে ৭ ডিসেম্বর শেষ হয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির তত্ত্বীয় পরীক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ অনুযায়ী, স্নাতকোত্তর শ্রেণির পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাত দিনের মধ্যে আবাসিক হল ছেড়ে দিতে হয় শিক্ষার্থীদের। তবে এই বিধির বাস্তবায়ন নেই জাহাঙ্গীরনগরে।

ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরেও বহু ছাত্র অবৈধভাবে হলে থাকছেন শিক্ষার্থীরা। এদের মধ্যে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের হলে অবৈধভাবে অবস্থান করার প্রবণতা বেশি।

শনিবার রাতে ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়া মোস্তাফিজের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠলে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা হলগুলো থেকে অছাত্রদের বের করার দাবি জানান। ধর্ষণে অভিযুক্তদের বিচার নিশ্চিতের পাশাপাশি হল থেকে অছাত্রদের বের করতে তিন দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছেন তারা।

এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রাধ্যক্ষ সাব্বির আলম বলেন, “অছাত্রদের হল থেকে বের করতে আমরা প্রচেষ্টা চালাচ্ছি, পদক্ষেপ নিচ্ছি। অতি দ্রুত একে একে সব অছাত্রকে হল থেকে বের করা হবে।”

এদিকে, শনিবার মধ্যরাত থেকেই মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। রবিবার দিনভর বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি চলে; এতে শিক্ষকরাও যোগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা।

রবিবার দুপুর ১২টার দিকে বিভিন্ন বিভাগের কয়েকশ’ শিক্ষার্থী নতুন প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে এই বিক্ষোভ শুরু করেন; তার আগে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন ও মিছিল করেন তারা।

দুপুর ১টার দিকে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের একটি দল বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে তিনটি দাবি তুলে ধরেন। তাদের দাবিগুলো হলো-

উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক পারভীন জলী বলেন, “আমরা তিনটি দাবি জানিয়েছি। উপাচার্যকে বলেছি জরুরি সিন্ডিকেট সভা ডেকে বিষয়গুলো সমাধান করার জন্য। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন।”

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিকেল ৩টায় সিন্ডিকেটের জরুরি সভা ডেকেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিকেল ৫টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সভা চলছিল।

এদিকে নতুন প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীরা “ধর্ষক ও সহযোগী, সমান অপরাধী”, “অছাত্র ধর্ষণ করে, প্রশাসন কী করে” এসব স্লোগান দিচ্ছেন।

বিক্ষোভকারীদের একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী রাসেল ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “ক্ষমতার ব্যবহার কারা করে সেটা সবাই জানে। এই দায় প্রশাসনের, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কিংবা বাইরে থেকে যারা ঘুরতে আসে তাদের নিরাপত্তা কে দেবে? অবশ্যই প্রশাসন। ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে যদি নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে এই প্রশাসনের থাকার দরকার নাই। যেই ক্যাম্পাস আমার সেই ক্যাম্পাস ধর্ষকের না।”

জাবি ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদকের পদত্যাগজাবি ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদকের পদত্যাগ আরেক শিক্ষার্থী জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের তানজিনা আমান তানজুম বলেন, “এই দায় সম্পূর্ণ প্রশাসনের। প্রশাসন অছাত্রদেরকে এখনও হল থেকে বের করতে পারে না সেই অছাত্ররাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। মনে হচ্ছে, প্রশাসন ধর্ষকদের পোষে।”

মামলা ও গ্রেপ্তার এদিকে গতকালের ঘটনায় ভুক্তভোগীর স্বামী বাদী হয়ে শনিবার রাতেই আশুলিয়া থানায় ছয়জনকে আসামি করে “নারী ও শিশু নির্যাতন দমন” আইনে মামলা করেছেন।

মামলার পরিপ্রেক্ষিতে রবিবার বেলা ১২টার দিকে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) বলেন, “প্রধান আসামি মোস্তাফিজকে সাভার থানা এলাকা থেকে ভোরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”

এছাড়া সকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের সহযোগিতায় সাব্বির হাসান সাগর, সাগর সিদ্দীকি এবং হাসানুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযুক্ত মোস্তাফিজকে পালিয়ে যেতে সহায়তার প্রমাণ মিলেছে।

তিনি আরও বলেন, “আমরা সবাইকে আশ্বস্ত করতে চাই, যে-ই অপরাধী হোক না কেনো তার পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমরা কাজ শুরু করি এবং ছয় আসামির মধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে চুরিজাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে চুরি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরও বলেন, “বাকি দু’জনকে গ্রেপ্তারে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। আশা করছি দ্রুতই তাদের গ্রেপ্তার করতে পারব।”

তারা অভিযোগ স্বীকার করেছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আপাতত এতটুকু আপনাদের জানানো হয়েছে। বাকি বিষয় তদন্তের পরে আবার জানানো হবে।”

আসামিদের সাতদিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে বলেও জানিয়েছে পুলিশ। অন্যদিকে, ভুক্তভোগীকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে পাঠানো হয়েছে।

যা ঘটেছিল শনিবার সন্ধ্যায় প্রথমে ভুক্তভোগী নারীর স্বামীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেকে আনেন মামুন নামে এক বহিরাগত। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এলে তাকে মীর মশাররফ হোসেন হলের “এ” ব্লকের ৩১৭ নম্বর কক্ষে জিম্মি করেন অভিযুক্তরা। মামুন তার বাসায় রেখে আসা জিনিসপত্র জিম্মির স্ত্রীকে নিয়ে আসতে বলেন।

ওই নারী মামুনের জিনিসপত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে এলে সেগুলো বুঝে নেন মামুন। ভুক্তভোগীর অভিযোগ, অভিযুক্তরা তাকে “স্বামী অন্য গেট (জঙ্গলের দিক) থেকে আসছেন” বলে হল সংলগ্ন জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করেন।

ওই নারী বলেন, “মামুন আমাদের বাসায় ভাড়া থাকতেন। (শনিবার) সন্ধ্যায় তিনি আমার স্বামীর মাধ্যমে ফোন করে আমাকে তার রেখে যাওয়া জিনিসপত্র নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে বলেন। আমি তার জিনিসপত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে যাই। তখন তিনি আমাদের বাসায় থাকবেন না বলে জানান। তিনি মীর মশাররফ হোসেন হলের মোস্তাফিজ ভাইয়ের কাছে থাকবেন বলেও জানান।”

তিনি বলেন, “এরপর মামুন আমার কাছ থেকে তার জিনিসপত্রগুলো নিয়ে হলে রেখে আসেন। আমার স্বামী অন্যদিক থেকে আসছেন বলে আমাকে হলের পাশে জঙ্গলের নিয়ে যায়। তার সঙ্গে মোস্তাফিজ ভাইও ছিল। সেখানে তারা আমাকে ধর্ষণ করে।”

কাগজে-কলমে দেশের একমাত্র আবাসিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৪৭তম ব্যাচ থেকে ৫২তম ব্যাচ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম চলমান। ফলে এই ছয় ব্যাচের শিক্ষার্থীরাই কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈধ শিক্ষার্থী। তবে হলগুলোতে ৪১তম ব্যাচ থেকে ৪৬তম ব্যাচের বহু শিক্ষার্থী অবস্থান করছেন।

এদের বেশিরভাগই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। খোদ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুটি করে চার আসনবিশিষ্ট মোট চারটি কক্ষ দখলে রেখেছেন। এর মধ্যে মওলানা ভাসানী হলের ৩২০ ও ৩২২ নম্বর কক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ৩৪৯ ও ৪৪৭ নম্বর কক্ষে সাধারণ সম্পাদক মো. হাবিবুর রহমান লিটন থাকছেন। লিটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পোষ্য কোটায় ভর্তি হওয়া ছাত্র। নিয়ম অনুযায়ী পোষ্য কোটার কেউ হলে থাকতে না পারলেও তিনি একাই দুই কক্ষ দখল করে থাকছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটিতে চার শতাধিক নেতাকর্মী পদ পেয়েছন। এদের মধ্যে শীর্ষ পদগুলো ছাড়াও অন্তত ২০০ নেতাকর্মীর ছাত্রত্ব নেই। এছাড়া সবমিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে কয়েক হাজার অছাত্র অবস্থান করছেন।

এর ফলে, নিয়মিত শিক্ষার্থীদের গণরুমে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হল থেকে অছাত্রদের বের না করতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেমন ভেঙে পড়বে, তেমনি নতুন হল নির্মাণ করেও আবাসন সংকট নিরসন করা যাবে না।

এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রাধ্যক্ষ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক নিগার সুলতানা বলেন, “আমাদের কাছে এখনো নবনির্মিত নতুন দুটি হল আছে। পর্যাপ্ত লোকবল না থাকায় আমরা হল দুটি চালু করতে পারিনি। আশা করি, দেড় মাসের মধ্যে নতুন হল খুলে দেওয়া হবে। তাহলে গণরুম ও মিনি গণরুম থাকবে না।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অছাত্রদের রুম থেকে বের করা, গণরুম বিলুপ্তি ও মিনি গণরুমে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীদের আসন নিশ্চিতকরণের দাবিতে আট দিন অনশন করেন সামিউল ইসলাম প্রত্যয় নামে এক শিক্ষার্থী।

ধর্ষণ,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,নারীর প্রতি সহিংসতা

সারাদেশ

অনুসন্ধান করুন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close