• বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন ২০২৪, ১৩ আষাঢ় ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

বাজেট মানে কি মরার উপর খরার ঘা?

প্রকাশ:  ০৭ জুন ২০২৪, ১৫:২৬ | আপডেট : ০৭ জুন ২০২৪, ১৫:২৮
মনজুর রশীদ

আমি সমাজবিজ্ঞানের একজন সাধারণ ছাত্র। অর্থনীতি বুঝিনা, তাই অর্থনীতিবিদদের মত বাজেট বিশ্লেষণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। গতকাল অর্থমন্ত্রীর বাজেট উপস্থাপনের পর থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সোস্যাল মিডিয়ায় যে ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছি, তা দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে অন্য সকলের মত আমাকেও মারাত্মকভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বিশেষ করে যেভাবেই হোক টানা চতূর্থবার ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকার অবকাঠামোগত নানা উন্নয়ন প্রকল্প যেমনঃ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে, পদ্মা সেতু ও সেখানে রেল সংযুক্তি, ঢাকা বিমান বন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল স্থাপন, কক্সবাজারে রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে মহাসাফল্য দেখালেও এসব থেকে দেশের সাধারণ মানুষ বাস্তবে কতটা সুফল পাচ্ছে বা পাবে, সে বিতর্কে না গিয়ে প্রতিনিয়ত দেশের সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত উপার্জনের ওপর ও জীবনযাপনের ব্যয় নির্বাহে নানামুখি ছলনার আশ্রয় নিয়ে সরকার প্রতিনিয়ত যেভাবে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করে দিয়ে এবং অস্বাভাবিক করের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে আমাদের বেচে থাকার সংগ্রামকে ক্রমাগতভাবে দূর্বিষহ করে তুলছে – এ থেকে কী আমরা কক্ষনোই মুক্তি পাবো না?

চাপে থাকা সামষ্টিক অর্থনীতি ও বিদ্যমান চ্যালেঞ্জের পরও এবারের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ব্যয়ের সম্ভাব্য আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা - যা চলমান সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ১১ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। সেজন্য নাকি পৌনে পাঁচ লাখ কোটি টাকার বেশি কর আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে এই অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেছেন মাননীয় অর্থ মন্ত্রী। পত্রিকা মারফত আরও জানতে পারলাম নতুন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই বরাদ্দ মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ২৪ শতাংশ। একক খাত হিসেবে নতুন বাজেটে এটাই বৃহত্তম ব্যয়। পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটে সম্পদের ব্যবহার অংশে দেখা যায় সুদ বরাদ্দেই সবচেয়ে বড় অঙ্ক উল্লেখ করা হয়েছে।

দেশের সম্পদ ও লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা পাচার হওয়া টাকা উদ্ধার তো দূরের কথা, এখন পর্যন্ত কোন বড় পাচারকারির বিরুদ্ধে যেখানে কোন ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টা দৃশ্যমান নয়, সেখানে ইচ্ছেমত বারবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল, গ্যাস, পানি ইত্যাদির মূল্য প্রতি বছরেই কয়েকদফা করে বাড়ানো হচ্ছে জনগণের কোন ধরনের মতামত বা সামর্থ্য বিবেচনা না করেই। তার ওপর আবার প্রস্তাবিত বাজেটে প্রায় ২ ডজনের মত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশে ইউনিট প্রতি মূল্য নির্ধারণ করা থাকলেও যেমন আমরা ভুতুড়ে বিদ্যুৎ বিল দেখি, সেগুলো পরিশোধ করতে গেলে যেমন একটা বড় অংশ আবার ভ্যাট হিসেবে কেটে নেয়া হয়, এখন থেকে মোবাইল ফোনে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে সরকার কর হিসেবে নাকি ২৮ টাকা কেটে নেবে। মুঠোফোনের নম্বরে সরাসরি কথা না বলে ইমো বা মেসেঞ্জারে কথা বললেও রেহাই নেই। সেখানেও একই ঘটনা। ইন্টারনেটেও ১৫ শতাংশের জায়গায় ঘ্যাট করে ২০ শতাংশ ভ্যাট বসানো হয়েছে। নগরীতে বসবাস করা মেট্রোরেল ব্যবহারকারীদের জন্যও রয়েছে দুঃসংবাদ। আগামী ১ জুলাই থেকে মেট্রোরেলের টিকিটে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হচ্ছে – এমনিতেই দূরত্বের তুলনায় বর্ধিত ভাড়ার সাথে যা বিশ্বে নজিরবিহীন ঘটনা!

প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা এবারও বাড়েনি। আগের মতই বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। বরং ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের জন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে ৩০ শতাংশ হারে নতুন একটা কর স্তর তৈরি করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় অনেকটা কমে গেছে। এ কারণে করমুক্ত আয়সীমা না বাড়ালে এটা নতুন একটা চাপ তৈরি করবে। অন্যদিকে বড় বড় দুর্নীতিবাজ অসৎ ব্যবসায়ীগণ যারা বছরের পর বছর কর ফাঁকি দিয়ে রাষ্ট্রকে প্রাপ্য সকল বকেয়া থেকে বঞ্চিত করছে, রাষ্ট্র বরাবরই তাদের প্রতি সদয়শীল আচরণ প্রদর্শন করে যাচ্ছে! অনেক বছর ধরেই দেখছি কালো টাকা সাদা করার অপার সুযোগ প্রদান করা হচ্ছে। এবারও মন্ত্রী মহোদয় তার পূর্বসূরীদের পথ অনুসরণ করে কালো টাকা সাদা করলে কর ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। দেশ ও সমাজের এ সকল কীটদের নানা সুযোগ-সুবিধা প্রদান করলেও এসব অসৎ ব্যবসায়িরা কোনকিছুর তোয়াক্কা না করে নানা ছল-চাতুরি আর সরকারি যোগসাজশে দিব্যি তাদের সম্পদ বাড়িয়ে নিচ্ছে। এসব নিয়ে নীতিপ্রণেতাদের কোন মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হয়না। এসকল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কখনো কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা তা আমার অন্তত জানা নেই।

যেখানে দেশের সাধারণ মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী বিশেষত বেসরকারি চাকরিজীবীরা নিয়মিতভাবে সবচেয়ে বেশী আয়কর প্রদান করে থাকে, তাদের রক্ত-ঘামের বিনিময়ে দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে, প্রতি বছর বাজেট ঘোষণায় প্রধানত তাদের উপর বুলডোজার চালানোটাই যেন নিয়ামকে পরিণত হয়েছে। অথচ এসকল বেসরকারি চাকরিজীবীগণের বেশীরভাগেরই চাকুরি চুক্তিভিত্তিক। তাদের কষ্টার্জিত উপার্জন থেকে খেয়ে না খেয়ে কিছুটা সঞ্চয় তাদের কর্মহীন অবস্থায় পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনমতে কিছুদিন পাড়ি দেয়ার একমাত্র সম্বল। তাই কষ্ট করে হলেও উপার্জিত টাকা জমা রাখার ক্ষেত্রে এসব চাকরিজীবীদের বেশিরভাগের পছন্দ সরকার প্রদত্ত সঞ্চয়পত্র কেনা বা রাষ্ট্রীয় তহবিলের কোন একটা মাধ্যমে সঞ্চয় হিসেবে তা জমা রাখা। যাতে করে এখান থেকে প্রাপ্ত মুনাফা তাদের আপদকালীন সময়ে সহায়তার যোগান দিতে পারে। অথচ মুনাফায় সুদের হার ও সীমা ক্রমাগত কমিয়ে কমিয়ে সেই পথও দিন দিন একেবারেই সংকুচিত করা হয়েছে। আরোপিত করা হচ্ছে নানা ধরনের বর্ধিত উৎসে কর। আবার গ্রাহক আগে যেখানে তার সঞ্চিত অর্থ ব্যাংকে রাখাটা নিরাপদ মনে করতো, সেখানেও প্রস্তাবিত বাজেটে আটটি স্তরে বিন্যস্ত করে গ্রাহকের আমানত থেকে আরো বেশি করে টাকা কাটার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা হয়েছে।

ইতোমধ্যে চাকরি থেকে প্রাপ্ত প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকেও সকলের আর্থিক সুবিধা আগের চেয়ে অনেকটা কমে গেছে। আগে প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ কোথাও বিনিয়োগ করে যে আয় হতো তা করমুক্ত ছিল। এখন ঐ আয় থেকেও ৫ শতাংশ হারে উৎসে কর কেটে রাখা হয়। ফলে প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুদ ও বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত আয় এরইমধ্যে অনেকটা কমে গেছে। একইভাবে করের চাপ বাড়ায় গ্র্যাচুইটি ও শ্রমিক মুনাফা তহবিল থেকেও সকলের আয় কমে গেছে। এভাবেই ঘোষিত বাজেটে সাধারণ ব্যক্তিশ্রেণীর সৎ করদাতার ওপর করের বোঝা বাড়ানোর ধারা যথারীতি অব্যাহত আছে। অধিকন্ত, নিজের কষ্টার্জিত উপার্জন থেকে বছরের পর বছর এতো কর প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্র থেকে আমি কি সুযোগ সুবিধা বা সেবা পাচ্ছি তা কক্ষনোই বোধগম্য নয়। জনগণের সেবা প্রদানকারী বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যা আমাদের কষ্টার্জিত করের টাকায় চলে, সেখান থেকে ন্যায্য সেবা পাওয়া তো দূরের কথা, উপরন্তু প্রায় প্রতিটা প্রতিষ্ঠানই দুর্নীতির মহা আখড়ায় পরিণত হয়েছে। যে কোন সেবা গ্রহণে ঘুষ লেনদেন অতি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমরাও অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি ‘নিশ্চুপ থাকা’র (Culture of Silence) সংস্কৃতিতে।

যত জুজুর ভয় শুধু সাধারণ আমজনতার জন্য। দেশকে তথাকথিত মধ্যম আয়ের পথে উন্নীত করার ক্ষেত্রে যারা প্রধান শক্তি, আজ তারাই সবচেয়ে অবহেলিত। প্রতিদিনই খবরের পাতায় টানা চতূর্থবার ক্ষমতায় থাকা নেতা-নেত্রীদের মুখে কেবল শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির কথাই শুনে আসছি। সকল অন্যায্য ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়তে বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার নাকি গণ মানুষের বিবেকবোধকে ধারণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে বদ্ধপরিকর। যদি তাই-ই হয়, তবে দেশের সাধারণ জনগণের প্রতি সদয়শীল নীতি গ্রহণের পাশাপাশি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বেসরকারি কর্মজীবী মানুষদের জীবন-জীবিকার প্রতিও সরকারের সহানুভুতিশীল আচরণ কামনা করাটা আশা করি অযৌক্তিক হবেনা!

মনজুর রশীদ সমাজ বিশ্লেষক ও গবেষক।

মনজুর রশীদ
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close