• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

ড. রাজ্জাকের বয়ান এবং আওয়ামী লীগের জবাবদিহিতা

প্রকাশ:  ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৩:২৯
সৈয়দ বোরহান কবীর

গত ২৭ ডিসেম্বর একটি পাঁচতারকা হোটেলে আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-উন্নয়ন দৃশ্যমান বাড়বে এবার কর্মসংস্থান।’ শিরোনামে নির্বাচনী ইশতেহারটি কেমন, তা বিচার-বিশ্লেষণ করার জন্য এই লেখা নয়। অনুষ্ঠানে নির্বাচনী ইশতেহার পাঠ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। এছাড়া মাত্র দুজন নেতা ঐ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার সুযোগ পান। এদের একজন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। অন্যজন ড. আবদুর রাজ্জাক। তিনি নির্বাচনী ইশতেহার কমিটির আহবায়কও বটে। তার সূচনা বক্তব্যের মধ্যে দিয়েই শুরু হয় ইশতেহার ঘোষণা অনুষ্ঠানটি।

ড. রাজ্জাক যখন ঢাকার প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে বক্তব্য রাখছিলেন, তার কাছাকাছি সময়ে লন্ডনে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং নির্বাচন নিয়ে একটি রিপোর্ট চূড়ান্ত করে। ঐ রিপোর্টে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ‘বাংলাদেশে বিরোধী দলের ওপর বল প্রয়োগ ও নিপীড়নের’ অভিযোগ এনেছে। ‘বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার মতো গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে। আর এরকম বক্তব্যের অকাট্য প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকের বক্তব্য। যদিও কৃষিমন্ত্রী তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তার মাধ্যমে। সেখানেও গুরুতর নৈতিকতার প্রশ্ন এসেছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর একজন মন্ত্রী তার রাজনৈতিক বক্তব্যের ব্যাখ্যা মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তাকে দিয়ে দেওয়াতে পারেন কিনা। ড. রাজ্জাকের আলোচিত-সমালোচিত বক্তব্য একজন মন্ত্রীর নয়, একজন রাজনৈতিক নেতার। নেতার বিতর্কিত বক্তব্যের ব্যাখ্যা একটি মন্ত্রণালয় দেয় কি করে? এতে অবাক হবার কিছু নেই। আজকাল এভাবেই সবকিছু হচ্ছে। ড. রাজ্জাকের বক্তব্যের জন্য তার কিছু হয়নি। কিছু হবে বলেও আমি মনে করিনা। তেমনি, নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে ড. রাজ্জাককে রাখা শোভন কিনা সেটি ভাবনার সময়ও আওয়ামী লীগের নেই। বলেছে তো বলেছে, কি হয়েছে-একরম একটি মানসিকতা যেন আওয়ামী লীগকে আস্তে আস্তে গ্রাস করেছে। সব কিছুকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা, উপেক্ষা অগ্রাহ্য করার এক ভয়ংকর মানসিকতা এখন লক্ষ্যণীয়ভাবে বেড়েছে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা দলটির মধ্যে। দলটির ভেতর জবাবদিহিতা লোপ পেতে পেতে শূন্যের কোটায় চলে গেছে।

একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া তার বিষ্ফোরক সাক্ষাৎকারের পর ড. রাজ্জাকের মধ্যে যেমন অনুশোচনা নেই, তেমনি আওয়ামী লীগের মধ্যেও এসব বাচালদের লাগাম টেনে ধরার কেউ নেই। সব কিছু ফ্রি স্টাইলে চলছে। এই অনুষ্ঠানে ড. রাজ্জাকের সূচনা বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হলো, তিনি যা বলেছেন সঠিক বলেছেন, দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বলেছেন। বিএনপি নির্বাচনে এলে সব নেতাকে ছেড়ে দেওয়া হতো। যেমন ছেড়ে দেওয়া হয়েছে শাহজাহান ওমরকে। ড. রাজ্জাক সরকারের একজন নীতি নির্ধারক হিসেবে এসব কথা বলেছেন। নির্বাচন তো হবে, কিন্তু নির্বাচনের পর যে সব ইস্যু বড় করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উত্থাপন করা হবে তার মধ্যে একটি ড. রাজ্জাকের ভাইরাল বক্তব্য। আওয়ামী লীগ অবশ্য এসব চাপ-টাপকে পাত্তা দেয় না। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এখন যুক্তিহীন অন্ধের মতো বিশ্বাস করে, শেখ হাসিনা যতোক্ষণ আছেন ততোক্ষণ সবকিছু একাই সামলাবেন। বাকি নেতারা শুধু দাঁত কেলিয়ে আলগা কথার আবর্জনা বাড়াবেন। ড. রাজ্জাক আগামী মন্ত্রী সভায় আরও বড় মন্ত্রী হবে নিশ্চয়ই। তার পিছনে সুশীলদের নিরঙ্কুশ সমর্থন আছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীও হবার স্বপ্ন দেখতে পারেন অদূর ভবিষ্যতে। সুশীলদের ‘রাজনৈতিক সংস্কারে’ তিনি তো সুপাত্র। মাইনাস ফর্মুলার আবার বাস্তবায়নে কে কোথায় থাকে তা দেখার অপেক্ষায় রইলাম। বাংলাদেশ তো সব সম্ভবের দেশ।

শুধু ড. আবদুর রাজ্জাক কেন গত ৫ বছরে আওয়ামী লীগে অদক্ষতা, দুর্নীতি, ব্যর্থতার কারণে কজন শাস্তি পেয়েছে?

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অর্থপাচার, ব্যাংক লুটেরাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার করা হয়েছে। কেউ কি বিশ্বাস করে, আবার ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগ অর্থ পাচারকারীদের ধরতে পারবে, ব্যাংক লুটেরাদের বিচার করতে পারবে? যে অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে সোনার অর্থনীতি শশ্মান হবার পথে, সেই অর্থমন্ত্রী পাঁচ বছরে ১০ দিন অফিস না করেও এবার আবার নৌকার টিকেট পেয়েছেন। জবাবদিহিতা কোথায়? আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ১১টি অগ্রাধিকারের মধ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ অন্যতম। পাঁচ বছরে যাদের ব্যর্থতার কারণে বাজারে সিন্ডিকেট হয়েছে তাদের কেউ মনোনয়ন তালিকা থেকে বাদ যাননি। এরা নির্বাচন করবেন, এমপিও হবেন। আর মনোনয়ন পাওয়া না পাওয়াতেই বা কি আসে যায়? মনোনয়ন না পেলেও তারা যদি স্বতন্ত্র দাঁড়াতেন তাদের কেউ বাঁধা দিতো না। পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার যেমন চলেছে ফ্রি স্টাইলে, কোন অপরাধেরই শাস্তি নেই- নীতিতে। তেমনি দলও চলছে ফ্রি স্টাইলে। দলে কোন চেইন অব কমান্ড নেই। কেউ কাউকে মানে না। যে যাকে ইচ্ছা গালি দেয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কুৎসা ছড়ায়। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন থেকে শুরু করে সিটি নির্বাচন সর্বত্রই বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। তাদের নিয়ে বহিষ্কার বহিষ্কার খেলা হয়েছে। ভোটে যে জিতবে, সেই আমার-এই নীতিতে চলছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের রুগ্ন চেহারাকে উজ্জল করতে ‘আমরা’ আর ‘তোমরা’ দলের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। স্বতন্ত্র এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের জন্য একটা নির্বাচনী প্রলেপ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সারাদেশে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়ে পরেছে। আওয়ামী লীগ বিভক্ত হলেই বিরাজনীতিকরণের পক্ষের শক্তিরা সবচেয়ে খুশী হয়। নির্বাচন তো পার করবে আওয়ামী লীগ। কিন্তু আওয়ামী লীগকে পার করবে কে? শেখ হাসিনা যতোদিন আছেন ততোদিন হয়তো আওয়ামী লীগ হাকডাক দেবে, কিন্তু তারপর?

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ই-মেইল: [email protected]

সৈয়দ বোরহান কবীর
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close