• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

নেত্রহীন নেত্র নিউজ কি জঙ্গি অর্থায়নপুষ্ট?

প্রকাশ:  ১৮ আগস্ট ২০২২, ১৪:৩৭
আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল

কথিত সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের সহকারী হিসেবে পরিচিত বিতর্কিত সাংবাদিক তাসনীম খলিল এবারও "আয়নাঘর" শিরোনামে গুম নিয়ে বানোয়াট একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই ভিডিওচিত্র প্রকাশের নেপথ্যে জঙ্গি পৃষ্ঠপোষকতার যে রহস্য রয়েছে তা আপাতদৃষ্টিতে বোঝার উপায় নেই। কিন্তু পর্যবেক্ষণ করলে যে কেউ অনুধাবন করতে পারবেন - এটি সাজানো, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বানোয়াট একটি প্রতিবেদন। এই প্রতিবেদনের সূত্রগুলো মিলিয়ে নিলে জঙ্গি সমীকরণের রহস্যও সহজে বের করা যায়। গুমের ন্যূনতম প্রমাণ উপস্থাপন না করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা সরকারের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ তোলা হয়েছে যা ব্যক্তিগত বা দলীয় আক্রোশ বলেই প্রতীয়মান হয়।

মূল প্রসঙ্গে আসার আগে একটি মৌলিক বিষয় বোঝা দরকার। ডিবি, এসবি, সিআইডি, র‍্যাব, সিটিটিসি, এনএসআই বা ডিজিএফআই ইত্যাদি গোয়েন্দা/নিরাপত্তা সংস্থা স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে থাকে। তাদের সকলের যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে পুলিশ। অর্থাৎ তদন্ত পরবর্তী পদক্ষেপ পুলিশ বা থানার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। কিন্তু খলিলের প্রতিবেদনে সকল সংস্থা কর্তৃত্ব গ্রেফতারকৃতদের জন্য নির্দিষ্ট "আয়নাঘর" এর কথা বলা হয়েছে যা রীতিমতো হাস্যকর।

সম্পর্কিত খবর

    প্রতিবেদনের অন্যতম প্রধান চরিত্র শেখ মোহাম্মদ সেলিমের বর্ণিত টাইমলাইন খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর আলোকে নেত্র নিউজের প্রতিবেদনের প্রধান কিছু অসংলগ্নতা তুলে ধরছি যার মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য প্রতীয়মান হবে।

    ১. সেলিম ২০০৭ সালে মালয়েশিয়া পাড়ি দেন। ২০১৫ সালের শেষে দেশে আসার কয়েকমাস পর অর্থাৎ ২০১৬ সালের মে মাসে ডিবি কর্তৃক গ্রেফতার হন। তার পরিবারও একই দাবি করে। এটা কি স্বাভাবিক কোনো ঘটনা? কোনো কারণ ছাড়াই কাউকে গ্রেফতার করা হবে?

    ২. সেলিমের ভাষ্য হচ্ছে, তার সঙ্গে বংশালের ছাত্রদল নেতা সোহেলের বন্দি অবস্থায় সাক্ষাৎ হয়েছে। কিন্তু তথ্য মোতাবেক সোহেল ২০১৩ সালে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কারণে গ্রেফতার হয়। তাকে রিমান্ডেও নেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে তাকে নিখোঁজ বলে দাবি করা হয়। গুম হওয়া সেই সোহেল ওরফে চাচা সোহেল ২০২২ সালের ছাত্রদলের কমিটিতে পদ পেয়েছেন।

    সূত্র: ছাত্রদল নেতা সোহেল ও উজ্জল তিন দিনের রিমান্ডে

    https://www.risingbd.com/index.php/entertainment-news/27540

    ৩. সেলিমের দাবি অনুযায়ী তার সঙ্গে জঙ্গি প্রশিক্ষক লিটনের পরিচয় হয়েছিল। খলিলের প্রদর্শিত ছবি দেখে সেলিম তাকে সনাক্তও করেন। এমন কি তার মায়ের ফোন নম্বরও মুখস্থ বলে দিয়েছেন।

    প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, জঙ্গি সদস্য রিগানের তথ্যের ভিত্তিতে ২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর উত্তরা এবং আদাবরে অভিযান চালিয়ে শেখ মো. আবু সালেহ ওরফে লিটন ওরফে হুরাইয়াসহ ৫ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

    ৪২ বছর বয়সী লিটনের অলিম্পিকের কারাটে ইভেন্টে অংশ নেয়ার মিথ্যা তথ্যও দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ অলিম্পিকে মার্শাল আর্টের কোনো ইভেন্টের জন্য মনোনীত বা তালিকাভুক্ত নয়।

    https://bn.mtnews24.com/jatio/126291/প্রকৌশলী-থেকে-যেভাবে-জঙ্গি-হলেন-সালাম

    এবার মূল রহস্য উন্মোচন করা যাক: ৪. সেলিম, লিটনের মায়ের ফোন নম্বর হিসেবে উল্লেখ করে যে ফোন নম্বর দিয়েছে তা লিটনের মায়ের নয়; নম্বরটি আন্তর্জাতিকভাবে জঙ্গি পরিবার হিসেবে পরিচিতি পাওয়া জঙ্গি তেহজিব করিমের মায়ের নম্বর।

    জঙ্গি তেহজিব করিম:

    পৈতৃক সূত্রে ও সপরিবারে জঙ্গি তেহজিব করিমকে বৃটেনের আদালত জঙ্গি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। ২০১১ সালে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিমান উড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তেহজিব করিমের ভাই রাজিব করিমকে ব্রিটেন দোষী সাব্যস্ত করে।

    গার্ডিয়ান তেহজিব সম্পর্কে লিখেছে, "Tehzeeb Karim, "another committed terrorist and member of JMB", joined him in fundraising and helping sympathisers travel abroad to fight or train as terrorists."

    বৃটিশ আদালতে বলা হয়, রাজিব করিম ও তার ভাই তেহজিব করিম পরস্পর যোগাযোগ সাপেক্ষে ষড়যন্ত্র করছিল।

    তেহজিবের ভাই রাজিব ইয়েমেনের কুখ্যাত জঙ্গি ও বিশ্বের ওয়ান্টেড সন্ত্রাসী আনোয়ার আল আওলাকির সহকর্মী বলে দাবি করেছে বৃটিশ গোয়েন্দারা।

    এ নিয়ে গার্ডিয়ান সহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

    উল্লেখ্য, রাজিবের হামলার সহযোগী রেজোয়ানুল আহসান নাফিজ বৃটেনে নাশকতা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়ে আমেরিকা পাড়ি দেন। ২০১২ সালের ১৮ অক্টোবর গাড়ি বোমা হামলা পরিকল্পনার অভিযোগে এফবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হয়ে ৩০ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। রাজিব করিম ব্রিটেনের আদালতে ২০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে জেলে আছে।

    ২০১৬ সালে আজিমপুর জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে তেহজিবের নিহত হওয়ার খবর প্রকাশ করে আনন্দবাজার সহ কয়েকটি পত্রিকা। পরবর্তীতে জানা যায়, নিহত হওয়ার খবর প্রচার করে আত্মগোপনে চলে গিয়েছিল তেহজিব। কয়েকটি অভিযান চালিয়ে ২০১৯ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং ২০১৯ সালের মে মাসে তাকে আদালতে হাজির করা হয়।

    আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলোতেও রাজিব ও তেহজিব করিমের ঘটনার উল্লেখ রয়েছে।

    সূত্র:

    https://www.theguardian.com/uk/2011/feb/02/ba-airline-bomb-plot-court-uk-al-qaida

    https://www.banglanews24.com/cat/news/bd/31280.details

    https://archive.dhakatribune.com/bangladesh/militancy/2019/05/21/missing-for-3-years-two-men-set-to-appear-for-remand-hearing-today

    https://www.refworld.org/docid/4d66043b2.html

    https://www.anandabazar.com/bangladesh/tehzeeb-karim-who-went-missing-from-airport-shot-dead-1.475655

    ৫. সেলিম একজন স্কুল শিক্ষিকার গ্রেফতার হওয়ার কথা বলেছেন। তিনি হিযবুত তাহরীরের বাংলাদেশে কার্যক্রম চালুর অন্যতম নেপথ্য নায়ক এবং জঙ্গি কানেকশনের অভিযোগে বন্ধ হওয়া লেকহেড গ্রামার স্কুলের অধ্যক্ষ জেনিফার আহমেদ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও হিজবুত তাহরীরের সংগঠক গোলাম মাওলার স্ত্রী। এই স্কুলের ২৬ জন শিক্ষকই জঙ্গিবাদে জড়িত ছিলেন। স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন যুক্তরাজ্যে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আল-কায়েদা ইন এরাবিয়ান পেনিনসুলা বা একিউএপি’র রাজিব করিম ও তার ভাই তেহজিব করিমের শ্বশুর এ রশিদ চৌধুরী। এ ঘটনার তদন্ত করে সিটিটিসি।

    লেকহেড স্কুল বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয় ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে।

    সূত্র:

    https://www.banglatribune.com/law-and-crime/260429/লেকহেড-স্কুলের-যত-জঙ্গি-কানেকশন

    https://samakal.com/todays-print-edition/tp-first-page/article/17111712/

    অসংলগ্ন ও পরস্পরবিরোধী বক্তব্য: সেলিম, হাসিন ও সামির ভাষ্য অনুসারে 'আয়নাঘর' এর সেলের কক্ষ ৫টি, ১৬টি নাকি ৩০টি তা সুস্পষ্ট নয়। প্রতিটি রুমে এক্সহস্ট ফ্যান আছে কিনা তা নিয়েও তথ্য বিভ্রাট রয়েছে। কখনো বলা হয়েছে বাইরের শব্দ শোনা যায় না, আবার বলা হয়েছে প্লেনের শব্দ শুনেছে। কখনো বলেছে ৩০ ফুট উঁচু দেয়াল আবার প্রদর্শিত ছবিতে দেখা যায় বড়জোর ১০ ফুটের ঘর। তাতে এক্সহস্ট ফ্যানও দেখা যাচ্ছে না। আবার ৩০ ফুট উঁচু হলে হাসিন কিভাবে বাইরে দেখলেন তা নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। এছাড়া সেলিম নয় বছর পর দেশে এলেও চোখ বাঁধা অবস্থাতে কিভাবে বুঝতে পারলেন - তাকে "রেসিডন" (রেডিসন) এর আশেপাশে নেয়া হয়েছে - এটা আরেক রহস্য!

    সেলিমের মোটিভ কি?

    শেখ মোহাম্মদ সেলিমকে গ্রেফতার করার কারণ নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। সেলিমের সঙ্গে তেহজিব করিমের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। মালয়েশিয়া থেকে দেশে আসার পর তেহজিব করিমের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সেলিম মূলত মানবতার ইস্যু তুলে তার জঙ্গি সহযোগীদের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালিয়েছে। সেলিমের সঙ্গে আল কায়েদার সম্পর্ক থাকার বিষয়টি সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। বাংলাদেশের উচিত সেলিমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ফিরিয়ে আনতে বা সেখানেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে মালয়েশিয়া সরকারকে আহব্বান জানানো।

    কি প্রমাণ করলো নেত্রহীন নেত্র নিউজ!

    উল্লিখিত তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে তাসনীম খলিলের প্রচারিত প্রতিবেদনের পক্ষে কি কিছু প্রমাণ করা যাচ্ছে?

    ১. নেত্র নিউজের প্রতিবেদনে গুমের কথা বলা হলেও কোনো প্রমাণ তারা উপস্থাপন করতে পারে নি।

    ২. গুমের শিকার দাবিদার ব্যক্তিরা কেউই রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নন। নিরাপত্তাজনিত কারণ ছাড়া তাদেরকে গ্রেফতার করার কোনো কারণ নেই।

    ৩. সেলিমের দাবি অনুযায়ী তাদেরকে এনার্জি বিস্কুট, মাম পানি সহ উন্নতমানের খাবার দেয়া হয়েছিল এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করা হয়েছে।

    ৪. কারো বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ থাকলে কি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে না? হলি আর্টিজেনের মতো ঘটনার

    দায়ভার কে নিবে?

    ৬. জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের রক্ষা করার জন্য যদি মানবাধিকার ইস্যু সামনে আনা হয় তাহলে জনগণের সার্বিক নিরাপত্তা তথা দেশের মানবতা ও মানবাধিকার সুরক্ষিত হবে কিভাবে? জঙ্গি লালন পালনের জন্য কি 'বায়নাঘর' তৈরি করতে হবে?

    সেলিমের সঙ্গে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা থাকার বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কিন্তু জঙ্গিবাদ নিয়ে যার বিশেষ আগ্রহ, সেই তাসনীম খলিল কি জঙ্গিদের পরিচয় জানে না? খলিলের সহকারী সামির বিরুদ্ধে চুরি, প্রতারণা ও জালিয়াতি সহ নানা অভিযোগ রয়েছে।গুঞ্জন রয়েছে সামির সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের পররাষ্ট্র দপ্তরের কয়েকজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। সম্প্রতি সামির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলে তাকে হাঙ্গেরি থেকে বের করে দেয়ার তথ্য জানিয়েছেন ইউটিউবার ইলিয়াস হোসাইন। বর্তমানে সামি যুক্তরাজ্যে আশ্রয় প্রার্থনা করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

    সামি-খলিলের বিরুদ্ধে এর আগেও গুজব ও অপপ্রচারের অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু এবারের বিষয়টি ভিন্ন। জামায়াতের অর্থায়নে প্রতিবেদনটি করা হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আল কায়েদা, আইএস এবং/অথবা লন্ডন কেন্দ্রিক জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাহরীরের স্বার্থ রক্ষার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। এটি কি তাসনীম খলিল সজ্ঞানে করেছে? প্রচারিত ভিডিওতে কি প্রমাণ হয় না যে, হিজবুত তাহরীর এবং/অথবা আল কায়েদার আর্থিক সহায়তা পেয়ে নেত্র নিউজ বিশেষ মিশনে নেমেছে? নেত্র নিউজের বিশেষত সাংবাদিক পরিচয়দানকারী সামির জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা তদন্তে বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক সহায়তা কামনা করা। যথাযথভাবে তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করা হলে সহযোগিতা পাওয়া না গেলেও এমন পদক্ষেপ দেশের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখতে সহায়ক হবে।

    লেখক: রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও কলামিস্ট

    নেত্র নিউজ
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close