• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

সোমেন চন্দ: এক পরিপূর্ণ লেখক ও কমিউনিস্ট

প্রকাশ:  ০৮ মার্চ ২০২২, ১৫:৫৮
রুহুল আমিন

বাংলা সাহিত্যের কোন সাহিত্যিক আততায়ীর হাতে নিহত হন? বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা কিংবা বিসিএসসহ অন্যান্য চাকরির পরীক্ষায় এই প্রশ্নটি এসে থাকে। প্রশ্নটির উত্তর হচ্ছে সোমেন চন্দ। উত্তরটি হয়তো অনেকেই জানেন, কিন্তু সোমেন চন্দকে কি তারা চেনেন?

১৯২০ সালের ২৪ মে, কেরানীগঞ্জের শুভাড্ডা ইউনিয়নের দেঘরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহন করে এক শিশু। পিতা নরেন্দ্রকুমার চন্দ ও মাতা হিরণমালা দেবীর স্নেহ-মমতায় আপন মাতুলালয়ে বেড়ে উঠতে থাকা শিশুটির নাম সোমেন চন্দ। মা হিরণমালা দেবী আকস্মিক মৃত্যুবরণ করলে চার বছর বয়সী শিশুপুত্র সোমেনকে নিয়ে অথৈই সাগরে পতিত হন মিডফোর্ড হাসপাতালের (বর্তমান স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) স্টোর কিপার পিতা নরেন্দ্রকুমার। সোমেনের দেখাশোনার কথা চিন্তা করে সূর্যদেবীকে বিয়ে করেন তার পিতা। নিজের দ্বিতীয় মাতারও প্রিয় পুত্রে পরিণত হন সোমেন, সেখানেই অতিবাহিত হয় তার শৈশব-কৈশোর।

শাঁখারীবাজার সংলগ্ন পোগোজ স্কুল থেকে ১৯৩৬ সা‌লে প্রবে‌শিকা অর্থাৎ মে‌ট্রিকু‌লেশন পাশ ক‌রে মিট‌ফোর্ড মে‌ডি‌কেল স্কু‌লে ভ‌র্তি হন তি‌নি। নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন বিসর্জন দেন। ওই বছর মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রগতি লেখক সংঘে যোগ দেন সোমেন। পরাধীন ভারতবর্ষের একঝাঁক তরুণ-যুবারা তখন ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর, যাদের বেশিরভাগই কমিউনিস্ট। তাই তরুণ লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী পরিচয় ছাপিয়ে মাত্র ১৭ বছর বয়সে যুক্ত হন কমিউনিস্ট পার্টিতে। এসময় বিপ্লবী সাংবাদিক রনেশদাশ গুপ্তের সান্নিধ্যে আসে সোমেন চন্দ। রনেশদাশ গুপ্তের অনুপ্রেরণায় একের পর এক পাঠ করতে থাকেন বঙ্কিম চন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র, বিভূতীভূষণ থেকে শুরু করে ম্যাক্সিম গোর্কী, মোঁপাসা, রঁলা, মারলো, কডওয়েল রালফসহ স্বভাষী ও বিভিন্নভাষী লেখকের লেখা। যে কারণে মাত্র ১৮ বছর বয়সী এক তরুণ হয়ে ওঠেন মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী তাত্তি¡ক। তার লেখনিতে উঠে আসতে থাকে শোষণ বৈষম্যহীন এক সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন। এসময় কমিউনিস্ট পাঠচক্রের প্রধানধারা প্রগতি পাঠাগারের পরিচালক হয়ে মাত্রই কৈশোর পেরুনো সোমেন তখন মিশে গেছে বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তরে, শহরে-নগরে, পথে-প্রান্তরে । একদিকে তার কলম ও কালিতে রচিত হতে থাকে মেহনতী মানুষের আশা, আকাঙ্খা ও স্বপ্ন ভঙ্গের উপাখ্যান; অন্যদিকে মিটিং, মিছিল ও স্লোগানে বিকশিত হতে থাকে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক স্বদেশের স্বপ্ন। তার লেখা ‘বনস্পতি ও অন্যান্য গল্প’ এবং ‘সংকেত ও অন্যান্য গল্প’ নামক কাব্যগন্থসহ বিভিন্ন লেখনী তখন গণকন্ঠস্বরে পরিনত হয়েছে।

১৯৩৯ সালে বেঁজে উঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে গোটা পৃথিবী। হিটলারের প্রবল আক্রমণে দিশেহারা ব্রিটিশদের কবল থেকে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে চঞ্চল হয়ে ওঠে বিপ্লবীরা। সুভাষ চন্দ্র বোসের নেতৃত্বে গঠিত ফরওয়ার্ড ব্লক ও কমিউনিস্ট পার্টি সমাজতান্ত্রিক ভারত গড়ার লক্ষ্যে লড়লেও তাদের লড়াইয়ের পদ্ধতি ছিল আলাদা। ১৯৪১ সালের ১৭ জানুয়ারিতে সুভাষ চন্দ্র বোস ইংরেজ গোয়েন্দাদের ফাঁকি দিয়ে দেশ ত্যাগ করেন। প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতাপ্রার্থী হলেও সারা না পেয়ে জার্মানিতে চলে যান তিনি। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর আত্মপ্রকাশ করেন সুভাষ। একই দিনে জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ করেন। সেদিনই ভারতীয় কংগ্রেস সভাপতি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ও মুসলিম লীগ সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক বৈঠকে ভারত ছাড় আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেন।

এদিকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম অব্যাহত রাখলেও হিটলারের গনহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ১৯৪১ সালের ২২ জুন হিটলার সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া আক্রমন করলে পরিস্থিতি পুরোপুরি ঘুরে যায়। রাশিয়া ইংরেজদের সাথে মৈত্রী করলে বিভ্রান্তিতে পড়ে যায় এদেশর কমিউনিস্টরা। আপাতকালীন সময়ের জন্য জার্মান নেতৃত্বধীন অক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে, ১৯৪১ সালের ২২ জুলাই ইংরেজ সরকার কমিউনিস্ট পার্টির রাজবন্দিদের মুক্ত করে। সুভাষ বোসের নেতৃত্বে ফরওয়ার্ড ব্লক এবং কমিউনিস্ট পার্টির পরস্পর বিরোধী অবস্থান তৈরি হয়।

এরূপ পরিস্থিতিতে ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ সোমেন চন্দ ও তার সহযোগীরা ঢাকায় ফ্যাসিবাদ বিরোধী সম্মেলন আহ্বান করে। ৮ মার্চ ভোরবেলায় ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সম্মেলনে অংশগ্রহনকারীরা আসতে থাকে। তরুণ লেখক ও বিপ্লবী সোমেন চন্দও দুচোখে মানবমুক্তির স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সম্মেলন অভিমুখে। সোমেনের চির পরিচিত পথ ধরেই সে এগিয়ে যাচ্ছিল জীবনের আহ্বানে। ঋষিকেশদাশ লেনের কদমতলা অতিক্রমকালে কতিপয় মানুষরুপী হায়েনার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সে থেমে যায় জীবনের ফেরিওয়ালার প্রাণস্পন্দন। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরেও খুনিরা বুকচিরে কলিজা বের করেছিল। ধারণা করা হয় ফরওয়ার্ড ব্লকের অনুসারীদের দ্বারা সংগঠিত হয় এ বীভৎস হত্যাকান্ড। তারা হয়তো দেখতে চেয়েছিল ২২ বছর! মাত্র ২২ বছরের একটা ছেলের কলিজা কিভাবে এতো বড় হলো!

সেই কদমতলায় এখনো কদমগাছ আছে। প্রতিদিন হাজারো মানুষ সেই পথ ধরে হেঁটে যায়। তারা হয়তো জানে না, সে পথেরই কোন এক কোনে তাদেরই মুক্তি প্রত্যাশায় বিসর্জিত হয়েছিল এক মহাপ্রাণ। সে প্রাণ! সোমেন চন্দের প্রাণ কোন তথ্য নয়, এ যেন পরিপূর্ণ সংগঠিত কিন্তু অমীমাংসিত এক মহাকাব্য। সোমেন চন্দ কোন এক প্রশ্নের উত্তর নয়, হাজারো প্রশ্নের উৎপত্তি।

লেখক: রাজনৈতিক কর্মী ও প্রাবন্ধিক

পূর্বপশ্চিমবিডি/জেএস

সোমেন চন্দ,কমিউনিস্ট
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close