• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

পারমাণবিক ক্ষেপনাস্ত্র প্রয়োগ কি অত্যাসন্ন

প্রকাশ:  ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৪:২১ | আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৮:১২
রুদ্র মাহমুদ

ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর আগ্রাসনে দেশটির পাশে দাঁড়িয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব।বিভিন্ন দেশ থেকে আসছে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সামরিক সহায়তা। রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেনকে যেভাবে পদানত করার কথা ভেবেছিল, তা বাস্তবে সম্ভব হয়নি। রুশ বাহিনীকে দিকে দিকে রুখে দিয়েছে ইউক্রেনের সেনা ও জনযোদ্ধারা। এই পরিস্থিতি রাশিয়ার একরোখা প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার সেনাবাহিনীকে তাদের কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রকে ‘বিশেষ সতর্ক’ অবস্থায় প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এটি রাশিয়ার কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র শক্তির সর্বোচ্চ পর্যায়ের সতর্কতা।

পুতিনের এই নির্দেশনা কি ইউক্রেন যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগের সংকেত? করোনা দংশন কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই বিশ্ববাসী কি মানবসৃষ্ট মহাদূর্যোগের মুখোমুখি হতে চলেছে? এ প্রশ্নে শঙ্কিত এখন বিশ্ববাসী।

অবশ্য এমন আশঙ্কার কথা আগেই জানিয়েছিল নোবেল পুরস্কারজয়ী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবোলিশ নিউক্লিয়ার উয়েপন্সের (আইসিএএন) প্রধান বিট্রিস ফিন। ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনা অভিযানের প্রথম দিনই তিনি বলেছিলেন, যেকোনো সংঘাতে যদি এক বা একাধিক পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ যুক্ত থাকে, তাহলে সেই সংঘাত চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হতে পারে। এতে বিশ্ব মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।

সেনাবাহিনীকে দেওয়া পুতিনের বিশেষ সতর্কতার প্রস্তুতির নির্দেশনা যেন বিট্রিস ফিনের সেই আশঙ্কার পূর্বাভাস।

এরই মধ্যে রুশ প্রেসিডেন্টে এই নির্দেশনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘে মার্কিন দূত লিন্ডা টমাস-গ্রিনফিল্ড বলেছেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন এমনভাবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের উত্তেজনা সৃষ্টি করছেন, যা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। ন্যাটোর মহাসচিব জেন্স স্টলটেনবার্গ বলেছেন, পুতিনের 'পারমাণবিক সতর্কাবস্থা বৃদ্ধি' বিপজ্জনক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। বিষয়টি পরিস্থিতিকে আরও গুরুতর করে তুলছে।

রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের ভান্ডার বিশ্বের সর্ববৃহৎ। কয়েক দিন আগেই রুশ নেতা ইউক্রেন অভিযান চালানোর ঘোষণায় বলেছিলেন, কেউ এতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে এমন পরিণতি হবে, যা ইতিহাসে কখনও দেখা যায়নি। একে তখন অনেকেই পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি বলে ব্যাখ্যা করেছিলেন।

এবার আরেক ধাপ এগিয়ে পুতিন তার দেশের পরমাণু বাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিলেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, 'পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার প্রতি শত্রুতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে এবং বেআইনি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।' বিশেষ করে বৈশ্বিক ব্যাংকিং মেসেজ আদান-প্রদানের সুইফট সিস্টেম থেকে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংককে বাদ দেওয়ার বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পুতিন তার অবস্থান আরও কঠোর করেছেন।

তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ ন্যাটো জোটের বাইরের কয়েকটি দেশ রাশিয়া ও পুতিনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো যুদ্ধরত কোনো দেশ হিসেবে ইউক্রেনকে সামরিক অর্থায়ন ও অস্ত্র দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইইউ। রাশিয়ার সবচেয়ে বড় জ্বালানি তেল কোম্পানি রসেনফেটের শেয়ার প্রত্যাহার করছে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানি। এসব চাপের মুখে পুতিন যে আরও কঠোর হবেন- তা ধারণা করাই যায়।

সাবেক সোভিয়েত আমলে ইউক্রেন একটি পারমাণবিক সক্ষমতা সম্পন্ন অঞ্চল ছিল। এমনকি, প্রায় ৩ দশক আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়ে সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া দেশ ইউক্রেন অল্প কিছু দিনের জন্য বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউক্রেনের মাটিতে হাজারো পারমাণবিক অস্ত্র থেকে গেলেও দেশটি পরবর্তী বছরগুলোতে স্বেচ্ছায় পূর্ণাঙ্গ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের উদ্যোগ নেয়। ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়া। এ আশ্বাসের ভিত্তিতে দেশগুলো ১৯৯৪ সালে বুদাপেস্ট স্মারক নামে নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি সই করে।

চুক্তি সইয়ের আগে ইউক্রেনের কাছে ১৭৬টি আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) লঞ্চার এবং ১ হাজার ২৪০টি ওয়ারহেড (ক্ষেপণাস্ত্রের মাথায় বসানোর জন্য ব্যবহৃত বিস্ফোরক উপকরণ) ছিল। ১৩০টি এসএস-১৯এস লঞ্চারের মাধ্যমে ৬টি করে পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপ করা সম্ভব ছিল। এ ছাড়া, বাকি ৪৬টি এসএস-২৪এস লঞ্চারের মাধ্যমে ১০টি করে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের সক্ষমতা ছিল ইউক্রেনের। ইউক্রেন ১৯৯৭ সালে বাকি ক্ষেপণাস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র সংরক্ষণের জন্য নির্মিত সাইলো ও লঞ্চ সাইট (যেখান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়) ধ্বংস করতে রাজি হয়। এ কার্যক্রমের জন্য দেশটি নুন লুগার সমবায় হুমকি হ্রাস প্রকল্পের আওতায় ৪৭ মিলিয়ন ডলার অনুদান পায়। ২০০১ এর মধ্যে সব আইসিবিএম সরিয়ে নেওয়া হয়।

২০০২ সালে ইউক্রেন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের বিস্তার প্রতিরোধক হেগ আচরণবিধিতে সাক্ষর করে। বস্তুত সে সময় থেকেই ইউক্রেনের পারমাণবিক সক্ষমতা শুধুমাত্র বেসামরিক কার্যক্রমের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

বর্তমানে, পূর্ব ইউরোপে সামরিক বাহিনীর কলেবরের দিক দিয়ে রাশিয়ার পরেই ইউক্রেনের অবস্থান। তাদের সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ, যাদের মধ্যে নিয়মিত সদস্য ২ লাখ ১৫ হাজার। আর রাশিয়ার সেনাবাহিনী সারা পৃথিবীর মধ্যে পঞ্চম বৃহত্তম বাহিনী। ১০ লাখ নিয়মিত সদস্য ও ২ লাখ বাড়তি সেনার সমন্বয়ে রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে।

রুশ বাহিনীকে রুখতে ইউক্রেনকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো (ন্যাটো)। তাদের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বেপরোয়া পুতিন যদি পারমাণবিক অস্ত্রে ব্যবহার করেই বসে তাহলে ইউক্রেনকে সহায়তাকারী পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশগুলো নিশ্চয়ই বসে থাকবে না। এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। মানব সভ্যতার জন্য এ এক অশনি সংকেত। ধ্বংস স্তুপে রূপান্তরিত হবে বিশ্ব।

লেখক: ব্লগার ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট

পূর্বপশ্চিম - এনই

ইউক্রেন,রাশিয়া,পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close