• রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

টিআইবির হিসেবের তুলনায় পরিবহন খাতে চাঁদা বহুগুণ বেশি

প্রকাশ:  ০৮ মার্চ ২০২৪, ১৬:৫৬
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

পরিবহন খাতে বছরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) হিসেবের চেয়ে বেশি চাঁদা আদায় হয় বলে জানিয়েছেন একজন পরিবহন শ্রমিক নেতা। তার মতে এই খাতে টিআইবি ৪৬% সেবাগ্রহীতাকে চাঁদা দিতে হয় বললেও বাস্তবে ৯০%-কে চাঁদা দিতে হয়।

আর ব্যবসায়ীরা বলেছেন, “পরিবহনে চাঁদাবাজির কারণে পণ্যের দাম ৩০% পর্যন্ত বেড়ে যায়।” তাদের মতে পরিবহন খাতে যেকোনো ধরনের চাঁদা পণ্যমূল্যের ওপর প্রভাব ফেলে।

টিআইবি গত ৫ মার্চ “ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহন ব্যবসায় শুদ্ধাচার” শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, দেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস ও মিনিবাস থেকে বছরে ১,০৬০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হয়। এই চাঁদার ভাগ পায় দলীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারী, মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনের প্রতিনিধিরা।

টিআইবি: ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঢাকার দুই সিটির উদ্যোগ হতাশাজনকটিআইবি: ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঢাকার দুই সিটির উদ্যোগ হতাশাজনক অবশ্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, “বিআরটিএ কিংবা মন্ত্রণালয়ে কোনো মৌখিক, লিখিত অভিযোগসহ কোনো তথ্য না থাকা সত্ত্বেও টিআইবি অসত্য প্রতিবেদন তৈরি করেছে। বিআরটিএর সেবাগুলো ডিজিটাল হয়ে যাওয়ায় সশরীর অফিসে যেতে হয় না। ফলে ঘুষ-দুর্নীতিও হয় না।”

আর সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি এক বিবৃতি বলেছে, “প্রকৃতপক্ষে মালিক সংগঠন নির্ধারিত পরিচালনা ব্যয়ের অতিরিক্ত অর্থ কখনও আদায় করে না। এর বাইরে কেউ অবৈধ চাঁদা আদায় করলে তা কঠোর হস্তে প্রতিহত করা হয় এবং অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”

টিআইবি জরিপের মাধ্যমে তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে। জরিপে দেখা যায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য ও সমর্থনপুষ্টদের দ্বারা পরিবহন ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত হয়। মালিক সংগঠনের নেতাদের অধিকাংশ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ২২টি কোম্পানির কাছে ৮১.৪% বাসের মালিকানা রয়েছে। আর তাদের ৮০% ক্ষমতাসীন দলের।

জরিপে অংশগ্রহণকারী কর্মী বা শ্রমিকদের ৪০.৯%-এর মতে, তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির এক বা একাধিক বাসের নিবন্ধনসহ কোনো না কোনো সনদের ঘাটতি আছে। সিটি সার্ভিসের কর্মী বা শ্রমিকদের ৪০.৪% বলেছেন, তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির গাড়িতে নকশা পরিবর্তন করে অতিরিক্ত আসন সংযোজন করা হয়েছে। যাত্রীদের ৬০.৫% অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছেন।

সায়দাবাদে দুই বাসের মাঝে চাপা পড়ে পরিবহন শ্রমিকের মৃত্যুসায়দাবাদে দুই বাসের মাঝে চাপা পড়ে পরিবহন শ্রমিকের মৃত্যু গবেষণার ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “চাঁদাবাজির এই হিসাব খুবই রক্ষণশীল। বাস্তবে এর চেয়ে বহুগুণ বেশি চাঁদাবাজি হয়। এই চাঁদার ভাগ নানা পর্যায়ে যায়। যেহেতু খাতটি রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণে, সেহেতু চাঁদার নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে।”

বাংলাদেশে পরিবহন ভাড়া পাশের দেশ ভারতের চেয়ে অনেক বেশি/মাহমুদ হোসেন অপু/ঢাকা ট্রিবিউন

ড. ইফতেখারুজ্জামানের কথার সত্যতা পাওয়া যায় বাংলাদেশ পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি মো. হানিফ খোকনের কথায়। তিনি বৃহস্পতিবার বলেন, “টিআইবি বলেছে ফিটনেস, রুট পারমিট, রেজিস্ট্রেশন করার জন্য ৪৬% উৎকোচ দিতে হয়। বাস্তবে ৯০% উৎকোচ দিতে হয়। ভয়ে তারা প্রকাশ করে না।”

তার মতে, বিআরটিএর চেয়ারম্যান বলেছেন ড্রাইভিং লাইসেন্স এখন অনলাইনে দুই-তিন দিনে হয়ে যায়। বাস্তবতা হলো চার বছরেও ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায় না। এখানেও ঘুষ আছে।

তিনি বলেন, “পরিবহন খাতে এখন নানা ধরনের চাঁদা আদায় হয়। পরিবহন থেকে মালিক ও শ্রমিক সমিতির নামে চাঁদা আদায় হয়। ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ২৫ পয়েন্টে চাঁদা নেওয়া হয়। সায়দাবাদ থেকে পটুয়াখালী ১৫ পয়েন্টে চাঁদা নেওয়া হয়। মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ১,২০০ গাড়ি চলাচল করে। তাদের ট্রিপ হয় দুইটা করে। প্রতি ট্রিপে ৮০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। টিআইবি যে বছরে এক হাজার কেটি টাকা চাঁদা আদায়ের কথা বলেছে, বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি চাঁদা আদায় হয়।”

“মালিক সমিতি বিআরটিএ থেকে নানা সুবিধা পায় তাই তারা টিআইবির রিপোর্টের বিরুদ্ধে বলছে। আর বিআরটিএর চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘এই প্রতিবেদনে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে’। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের চাঁদাবাজি ওইসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দায়। তাতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে কেন? সাহস থাকলে তিনি তার সম্পদের তালিকা প্রকাশ করুক।”

আর এফবিসিসিআইর সাবেক পরিচালক এবং দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, “যেই অস্বীকার করুক না কেন, পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি হয়। এই খাতে চাঁদাবাজির কারণে পণ্যের দাম ৩০% পর্যন্ত বেড়ে যায়। বিশেষ করে পচনশীল দ্রব্যের ওপর চাঁদাবাজদের নজর বেশি। কারণ ওই পণ্য আটকে রাখলে বা দেরি করলে ব্যবসায়ীরা লোকসানে পড়েন।”

তিনি বলেন, “ট্রাকের ওজন স্কেলের নামে চাঁদাবাজি হয়, হাইওয়েতে ট্রাক আটকে সার্চ করার নামে চাঁদাবাজি হয়। এছাড়া পৌরসভা এলাকা পার হওয়ার সময়ও পণ্যবাহী ট্রাককে চাঁদা দিতে হয়। চাঁদাবাজি হলে পরিবহন ভাড়া বেড়ে যায়। আর সেটা ব্যবসায়ীদেরই বহন করতে হয়।”

“আমরা একবার সরেজমিন তদন্ত করে দেখেছি। তাতে শাকসবজিসহ কাঁচামালের ট্রাকই চাঁদাবাজির শিকার হয় বেশি”।- বলেন এই ব্যবসায়ী নেতা।

আর বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “পরিবহন খাতে এই চাঁদাবাজি টিকিয়ে রাখার জন্য শাসক দলকে দরকার হয়। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন খাতেও শাসক দলের লোকজন নিয়ন্ত্রণ নেয়। চাঁদাবাজির জন্যই এটা হয়।”

তার কথা, “বাংলাদেশে পরিবহন ভাড়া পাশের দেশ ভারতের চেয়ে অনেক বেশি। সেবার মান অনেক খারাপ। পাবলিক যানবাহনও নিম্নমানের। এর কারণ চাঁদাবাজি। চাঁদাবাজির কারণে ভাড়া যেমন বেশি। তেমনি নিত্যপণ্যের দামও বেড়ে যায়।”

তার কথা, “টিআইবি পরিবহন খাতের চাঁদাবাজির আংশিক হিসাব দিয়েছে। তারা শুধু বাস মিনিবাসের কথা বলেছে। কিন্তু সড়কে সাত-আট ধরনের যানবাহন আছে। আমার হিসেবে এই খাতে বছরে ১০ হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়।”

তিনি বলেন, “চাঁদাবাজির কারণে সড়ক পরিবহনে নৈরাজ্য চলছে। এর সঙ্গে বিআরটিএ, মালিক ও শ্রমিক সংগঠন, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, পুলিশ জড়িত। এটাকে অস্বীকার না করে সরকারের উচিত আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া।”

গণপরিবহন,ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি),বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি,বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ),মহাসড়ক
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close