• সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

সশ্রদ্ধ স্মরণ হে বঙ্গপিতা

প্রকাশ:  ১৪ আগস্ট ২০২৩, ১৯:১৭ | আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০২৩, ০০:২৪
নিজস্ব প্রতিবেদক

❝যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা বহমান,

ততকাল রবে তোমার কীর্তি

শেখ মুজিবুর রহমান❞

অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতার মতোই বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ, যার জন্ম না হলে বিশ্বের মানচিত্রে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেতাম না।রাজনীতির মহান কবি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবর্তক, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ছিলেন সাম্যবাদী, শোষণবিরোধী এবং সুষম অর্থনীতিতে বিশ্বাসী। যার ত্যাগ ও সংগ্রাম বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। তিনি নিজ দেশকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন, ছিলেন একজন খাটি বাঙালি,মানবতাবাদী ও শান্তিকামী মানুষের আদর্শ।।

১৭ই মার্চ ১৯২০সালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম। ডাকনাম -খোকা, বন্ধুরা ডাকত মুজিব ভাই নামে। ছোটবেলা থেকে জীবনসংগ্রাম শুরু হয়, ৭ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বেরিবেরি রোগ, দুই বছর পরে গ্লুকোমা তে আক্রান্ত হন, সুস্থ হয়ে উঠেন। নির্ধারিত সময়ে জ্বরের এস এস সি পরীক্ষায় বসতে পারেন নি। জীবনের প্রথম ২০টি বসন্তের অধিকাংশ সময় কেটে গিয়েছে নিজের শরীরের সাথে সংগ্রাম করে।

বঙ্গবন্ধু সংগ্রামী জীবনে আসার দীক্ষা নেন গৃহশিক্ষক কাজী আব্দুল হামিদের থেকে যিনিও নিজেও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। ১৯৩৮সালে ৮ম শ্রেণীতে থাকাকালীন শেরে বাংলা স্কুল পরিদর্শনে এলে সংস্কারের দাবি জানান, এরপর ১৯৩৯সালে গোপালগঞ্জ জেলা মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৪৫সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ ছাত্রসংসদের জি এস, ৪৭এ চলে আসেন ঢাকায় চলে আসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন, ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে মুচলেকা না দেওয়ার জন্য বহিষ্কৃত হন।

১৯৪৮সালের ৪ঠা জানুয়ারী প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ৪৯সালের ২৩শে জুন বাংলাদেশ আওয়ামী গঠিত, কারাগারে থেকেই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৫২সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারী কারাগারে অনশন শুরু করেন,

যে অনুপ্রেরণায় ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হয়। ১৯৫৩সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, ৫৪সালে মন্ত্রী, ৫৬সালে দলের সাধারণ সম্পাদক এর জন্য মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করেন, কারন্তরীণ হওয়া শুরু হয় পরবর্তী জীবনের নিত্যদিনের সঙ্গী।

১৯৬৬সালে ঘোষণা করেন বাংলার ম্যাগনা কার্টা খ্যাত ছয় দফা ঘোষণা, ৬জুন আটক হন, অসংখ্য মানুষ নিহত হয়।

৬৮সালে পাকিস্তান বিভক্তির অপরাধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার হন, ৬৯এর ২২শে ফেব্রুয়ারী মুক্তি পান, ২৩ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন,

১৯৭০এর নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে বিপুল ভোটে প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০ এর মধ্যে ২৯৮আসন, জাতীয় পরিষদে ১৬৯এর মধ্যে ১৬৭ আসনে বিজয়ী হন। নির্বাচনের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করেন। ৩রা মার্চ সর্বদলীয় ছাত্রসমাজ কর্তৃক ❝জাতির জনক❞ উপাধি লাভ, ৭ই মার্চ ঘোষণা করেন স্বাধীনতার শপথ ঘোষণা, ২৩শে মার্চ ঘোষণা করেন পাকিস্তান প্রতিরোধ দিবস।।

২৫শে মার্চের পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যার খবর পেয়ে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, অই রাত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে আটক করে পরের দিন পাকিস্তানের করাচীর মিয়ানওয়ালা কারগারে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মন্ত্রমুগ্ধের মতো জাদুকরি শক্তির কারণে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিল। দীর্ঘ ৯মাস ৩০লক্ষ শহীদ ও ২লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়।

স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তানপন্থী জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ, পিডিপিসহ বেশির ভাগ মুসলিম ভাবাপন্ন রাজনৈতিক দলগুলো গোপনে পাকিস্তানসহ বাংলাদেশ বিরোধীদের পরামর্শে ❝মুসলিম বাংলা❞ কায়েমের লক্ষ্যে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন এবং একটি ব্যর্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা চলতে থাকে। তাই১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদের মাধ্যমে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাশ হয়। এতে সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে একক রাজনৈতিক দল ❝বাকশাল❞ গঠন করে বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেওয়া হয় তথা প্রতিকূল রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিয়ে একই সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা টিকিয়ে রাখার মূখ্য ছিল অর্থাৎ বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষা ও উন্নয়ন বিপ্লব। একটি দেশের স্বাধীনতার পটভূমি নির্মাণ থেকে শুরু করে স্বাধীনতা পরিবর্তী স্বনির্ভর,স্বাবলম্বী করার পুরো দৃশ্যপট রচিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধু কে ঘিরে। একটি তর্জনী একটি দেশের জন্ম দিয়েছিল ❝বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ❞।

মাত্র ৫৫বছরের জীবন, বাল্যকালে ৩বছর বেরিবেরি ও গ্লুকোমা রোগে, স্কুলজীবন থেকে শুরু করে ব্রিটিশ ভারতের ৮দিন বাদে পাকিস্তানের অধীনে ৪৬৭৫দিন অর্থাৎ ১৪বছর কারাগারে কাটিয়েছেন, মাত্র ২৩বছরে। পুরো জীবনটাই কাটিয়েছেন বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামের জন্য। নিজ ছেলেমেয়েরাও সঠিকভাবে চিনতে পারত না, ইনি কি তাদের বাবা, তাইতো একবার শেখ কামাল শেখ হাসিনাকে বলেছিল, ❝আমি কি তোমার বাবাকে বাবা বলে ডাকব।❞

পৃথিবীতে প্রচলিত, কীর্তিমানেরা হয় ক্ষণজন্মা, স্বল্প সময়ে দুনিয়াকে আলোকিত করে চলে যেতে হয়। সেই ক্ষণজন্মা হয়ে বাংলাদেশের জন্য এসেছিলেন বাঙালি জাতির জনক তথা বঙ্গপিতা শেখ মুজিবুর রহমান। তেমনি ১৫ই আগস্ট সূর্যোদয় বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জঘন্য ও নির্মম সুপ্রভাত, সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়। কিন্তু ১৯৭৫সালের ১৫ই আগস্ট প্রথম প্রহরের ভয়াল কালরাত্রি তে দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে সপরিবারে হত্যা করে যদিও দেশের বাইরে থাকায় ভাগ্যক্রমে বেচে যান তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হেনির কিসিঞ্জার বলেছিলেন,❝আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মত তেজী এবং গতিশীল নেতা আগামী বিশ বছরের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যাবে না।❞

মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এতটাই দুঃখ পেয়েছিলেন যে, তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন,❝তোমরা আমারই দেয়া ট্যাঙ্ক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ! আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি।❞

মওলানা ভাসানী বলেছিলেন- ❝টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবের কবর একদিন সমাধিস্থলে রূপান্তরিত হবে এবং বাঙালির তীর্থস্থানের মতো রূপলাভ করবে।❞

নোবেল বিজয়ী উইলিবান্ট বলেছিলেন- ❝মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যেকোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।❞

কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ বলেন, ❝একাত্তরের মার্চে শেখ মুজিব সৃষ্টি করেছিলো শুভ দাবানল, শুভ প্লাবন, শুভ আগ্নেয়গিরি, নতুনভাবে সৃষ্টি করেছিলেন বাঙালি মুসলমানকে, যার ফলে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম।❞

মোটকথা, স্বাধীন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেওয়া হয়, শত বছর পিছিয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশকে। ঘাতকরা শুধু জাতির জনককে হত্যা করেনি, একই সঙ্গে হত্যা করতে চেয়েছিল বাঙালির সংস্কৃতি ও বাংলাদেশকে। তারা বাংলাদেশকে এবং বাঙালির কণ্ঠ রোধ করতে চেয়েছিল। তাদের প্রকৃত লক্ষ ছিল বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশকে অভিভাবকহীন করা। বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান তৈরি করা। তখন বাঙালি বোঝেনি পিতা হারানোর বেদনা এত দুঃসহ হবে। পুরো বাঙালি জাতি যেন পিতৃহীন হয়ে গেল। তাই, বাংলাদেশের আজন্ম আক্ষেপ;

❝যদি রাত পোহালে শোনা যেত,

বঙ্গবন্ধু মরে নাই।

যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো,

বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই।

তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা,

আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা।❞

লেখক: মোঃ কামরুল হুসাইন সহ সভাপতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ

শেখ মুজিবুর রহমান
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close