• শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

বৈষম্যের শিকার নারী অধ্যাপক, আদালতের নির্দেশ উপেক্ষিত

প্রকাশ:  ০৭ মার্চ ২০২২, ২১:২৪ | আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২২, ২১:৪০
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অধ্যাপক ডা. জাহানারা আরজু বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অধিকাংশ শিক্ষকের ভিআইপি রুমে অফিস থাকলেও তার বেলায় জুটেছে জরাজীর্ণ-পরিত্যক্ত ও অপরিচ্ছন্ন রুম। এমনকি এই অধ্যাপককে ইউনিট প্রধান হওয়া থেকেও বঞ্চিত করে ৫ পাঁচ বছরের জুনিয়র এক সহকারি অধ্যাপককে সেই পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর ডা. জাহানারা আরজুকে সরকারি বেতন স্কেল দিতে অস্বীকৃতি জানানোর অভিযোগ রয়েছে।

জানা যায়, বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের এই অধ্যাপক বাথরুম সংযুক্ত অফিসকক্ষের জন্য দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আবেদন করেও কোনো সাড়া পাননি। সর্বশেষ ২০২১ সালের ১০ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আবারও আবেদন করেন তিনি।

এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ১৪ জুলাই ডা. জাহানারা আরজুকে চিঠি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার ডা. স্বপন কুমার তপাদার স্বাক্ষরিত এ চিঠিতে বলা হয়, ‘উপযুক্ত বিষয় ও আপনার ১০/০৪/২০২১ইং তারিখের আবেদনের প্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে, আপনার আবেদন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত হয় নাই।” এ দফায়ও সাড়া না পেয়ে এবার তিনি বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে রিট করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন।

আদেশে হাইকোর্ট জাহানারা আরজুর করা আবেদনটি ১৫ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়। পাশাপাশি দ্রুত জাহানারা আরজুর জন্য শৌচাগার সংযুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত অফিসকক্ষ নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হাইকোর্টের ওই রুলও অমান্য করেছে।

ফলে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পুনরায় হাইকোর্টে আবেদন করেন ডা. জাহানারা আরজু। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালতের আদেশ প্রতিপালন না হওয়ায় বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রেজিস্ট্রার ও কার্ডিওলজি বিভাগের চেয়ারম্যানের প্রতি আদালত অবমাননার রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত ২০ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল দেন।

হাইকোর্টের আাদেশের বিষয়ে জাহানারা আরজুর আইনজীবী মো. ফয়জুল্লাহ সংবাদ মাধ্যমকে জানান, আদালতের আদেশ প্রতিপালন না করায় উপাচার্যসহ তিনজনের বিরুদ্ধে কেন আদালত অবমাননার কার্যক্রম শুরু করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে। এক সপ্তাহের মধ্যে তিনজনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

আদালত অবমাননার রুল জারির পর গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এ বি এম আবদুল হান্নান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক জাহানারা আরজুর নামে ডি-ব্লকের ৪০৯ নং কক্ষটির বরাদ্দ বাতিল করা হলো। একই সাথে তাকে বেতার ভবনের হাইজিনিক বাথরুমসহ ৮২ নং কক্ষটি বরাদ্দ দেয়া হলো। এই বরাদ্দ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে এবং পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।’

সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বরাদ্দকৃত এ রুম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল চত্ত্বরের বাইরে। এমনকি রাস্তার অপর পাশে বেতার ভবনে অবস্থিত। শুধু তাই নয়, প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়া ভবনের এই রুম শ্যাওলা জমে বেহাল অবস্থায় রয়েছে। ওয়াশ রুমের অবস্থা আরও ভয়াবহ। তাছাড়া এই রুমের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের দূরত্বও কম নয়।

এদিকে এই রুমকে ভীতিকর, অস্বাস্থ্যকর এবং নিরাপত্তাহীন আখ্যা নিয়ে উপাচার্য বরাবর চিঠি দিয়েছেন ডা. জাহানারা আরজু। চিঠিতে তিনি উপাচার্যকে সম্মান জানিয়ে লেখেন, মেডিক্যালের কার্ডিওলজি বিভাগের বাইরে, এমনকি হাসপাতাল চত্বরের বাইরে রাস্তার অপর পারে বেতার ভবনে ৮২নং কক্ষটি তার নামে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। চিঠি পাওয়ার পর কক্ষটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে তিনি দেখতে পান- সেখানে হাসপাতালের (কোভিড-১৯ এর পরীক্ষা করা ছাড়া) কোনো কার্যক্রম নেই। প্রায় পরিত্যক্ত ভবনে ভীতিকর ও অস্বাস্থ্যকর একটি কক্ষ তার নামে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

চিঠিতে তিনি আরও লেখেন, এই রুম অফিস হিসেবে ব্যবহার করলে নারী ডাক্তার হিসেবে আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবো বলে মনে করি। সেখান থেকে হাসপাতালের ভেতরে কার্ডিওলজি বিভাগের সিসিইউ, এসডিইউ, ক্যাথল্যাব এর রোগীদের সেবাসহ নিয়মিত চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম প্রদান করা কিভাবে সম্ভব সেটি বোধগম্য নয়। তাছাড়া ব্যস্ততম ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক বার বার অতিক্রম করে একজন মহিলা ডাক্তারের পক্ষে মূল হাসপাতালের অভ্যন্তরে কাজ করা কীভাবে সম্ভব, যেখানে কোনো ফুটওভার ব্রিজ ও জেব্রা ক্রসিংও নেই। এতে বিজ্ঞ আদালতের আদেশমত হাইজেনিক রুম দেয়ার নামে আমাকে মারাত্মক বিপদজ্জনক পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়া হয়েছে বলে আমি মনে করি।

চিঠির শেষে তিনি লেখেন, ‘আমার উত্থাপিত বিষয়গুলোর সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে কার্ডিওলজি বিভাগের একজন নিয়মিত অধ্যাপক হিসেবে বিভাগের অভ্যন্তরে আমাকে বাথরুমসহ একটি কক্ষ বরাদ্দ দেয়ার জন্য অনুরোধ করছি।’

সূত্র জানায়, কার্ডিওলজি বিভাগের (ব্লক-ডি) ৪র্থ তলায় ৪১২ নং কক্ষটি অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডা. সজল কৃষ্ণ ব্যানার্জী ব্যবহার করেছিলেন। তিনি ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর অবসর গ্রহণ করেন এবং তার নিয়মিত পদটিতে অধ্যাপক ডা. জাহানারা আরজু কার্ডিওলজি বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে যোগ দেন। তার পরবর্তী সময়ে এই কক্ষটি শূন্য অবস্থাতেই রয়েছে, কাউকে বরাদ্দ দেয়া হয়নি। তবে বরাদ্দ না দেয়া হলেও এখনো এ রুম ছাড়েননি অধ্যাপক সজল কৃষ্ণ ব্যানার্জী। যদিও তিনি চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইউজিসি'র অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন।

বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কক্ষটি যেহেতু কার্ডিওলজি বিভাগের অভ্যন্তরে অবস্থিত, কাজেই একজন নিয়মিত অধ্যাপককে এই রুম বরাদ্দ দেয়া উচিত।

এদিকে এই দাবিতে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চিঠিও দেন অধ্যাপক ডা. জাহানারা আরজু।

এ চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘বিশ্ববিদ্যায়ের প্রশাসনিক ভবনে (ব্লক-ডি) ইউজিসি'র অধ্যাপকদের জন্য রক্ষিত বাথরুমসহ ১টি কক্ষ বরাদ্দ ছিল, যে কক্ষটি প্রাক্তন অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় ডা. এম নজরুল ইসলাম স্যার ব্যবহার করতেন। কাজেই কার্ডিওলজি বিভাগের একজন নিয়মিত অধ্যাপক হিসেবে বিভাগের অভ্যন্তরে আমাকে বাথরুমসহ ৪১২নং কক্ষটি বরাদ্দ দেয়ার জন্য বিনীত অনুরোধ করছি।’

সূত্র আরও জানায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ কালার কোড তথা ইউনিট প্রধান দেয়া নিয়েও অনিয়ম করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১০ সালের সিন্ডিকেট আইন বলছে, শুধু অধ্যাপকই ইউনিটের তত্ত্বাবধায়ক হবেন। তার তত্বাবধানে অন্যান্য ডাক্তাররা থাকবেন। কিন্তু এক্ষেত্রে উপাচার্য সহযোগী অধ্যাপক ডা. রসুল আমিনকে কালার কোড দিয়েছেন। যদিও এই শিক্ষক ডা. জাহানারা আরজুর চেয়ে ৫ বছরের জুনিয়র। এক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার হয়েছেন ডা. আরজু।

এ প্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ১২ অক্টোবর কালার কোড বিধি লংঘনের বিষয়ে উপাচার্যকে চিঠি দেন তিনি। এমনকি ২০২১ সালের ২৪ আগস্ট তারিখে তিনি নিয়মিত পদে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়া সত্বেও কর্তৃপক্ষ তাকে সরকারি বেতন স্কেল দিতে অস্বীকৃতি জানানোর অভিযোগও রয়েছে।

বাথরুম সংযুক্ত অফিসকক্ষের জন্য আবেদন করার বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. জাহানারা আরজু বলেন, দেখুন, আমি নিরুপায় হয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছি। বারবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আবেদন করেও কোনো সাড়া পাইনি। আমার মতো একজন নারী অধ্যাপককে এভাবে ভোগান্তিতে ফেলা কোনোভাবেই সমীচীন নয়।

এ বিষয়ে কার্ডিওলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. একেএম ফজলুর রহমান জানান, রুম বরাদ্দ দেয়ার বিষয়টি আমার এখতিয়ারভুক্ত না। এটি প্রশাসন দেখভাল করে থাকে। রুম বাতিল বা বরাদ্দ সম্পূর্ণ বিষয়টি প্রশাসনের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় হয়। সেক্ষেত্রে উপাচার্য, রেজিস্টার উনারাই হচ্ছেন প্রশাসনের অংশ।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার অধ্যাপক ড. এবিএম আবদুল হান্নান জানান, এটার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। উনি যেভাবে চাচ্ছেন কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা সেভাবেই ব্যবস্থা নিচ্ছি। এটি যেহেতু এখনো আদালতে বিচারাধীন, মামলা চলছে। সে কারণে এর চেয়ে বেশি কিছু এখন বলা যাবে না। আদালত যেভাবে বলবে, আমরা সেভাবেই কাজ করবো।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, এ ব্যাপারে এখনো পরবর্তী বৈঠক হয়নি। বৈঠক হলেই সিদ্ধান্ত হবে। আমি তো কোনো সিদ্ধান্ত একা নিই না। কর্তৃপক্ষ আছে, সবাইকে নিয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। সূত্র: বিবার্তা২৪ ডট নেট


পূর্বপশ্চিম/এসকে

আদালত,নারী অধ্যাপক,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close