• রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

ভয় তাড়ানোর পাঠ

প্রকাশ:  ১১ নভেম্বর ২০২২, ২১:৫৭ | আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০২২, ২২:০০
হাসান শাওন

অনেক মানবিক প্রবৃত্তি নিয়েই মানুষ। এর একটি হচ্ছে ভয়। সমসময়ে এই “ভয়” কীভাবে সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, সংস্কৃতি থেকে ব্যক্তিজীবনে পর্যন্ত সারাক্ষণ তাড়া করে এর অনুসন্ধান জরুরি।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড.আলী রীয়াজ তারই বিস্তৃত ব্যাখ্যা করেছেন তার “ভয়ের সংস্কৃতি : বাংলাদেশে রাষ্ট্র, রাজনীতি সমাজ ও ব্যক্তিজীবন” বইয়ে।

সম্পর্কিত খবর

    ১৮৪ পৃষ্ঠার এই বই বিন্যাস্ত বেশ কয়েকটি অধ্যায়ে। প্রথম অধ্যায়ে লেখক বর্ণনা করেছেন “ভয়ের সংস্কৃতি : কী, কেন, কীভাবে”। বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে আছে “ভয়ের সংস্কৃতির রাজনৈতিক অর্থনীতি”। তৃতীয় অধ্যায়ে আছে “ভাবাদর্শের জাল ও আনুগত্য আদায়”। চতুর্থ অধ্যায়ে “ভীতি উৎপাদনের চার হাতিয়ার”। পঞ্চম অধ্যায়ে “‘নত হও, নত হতে শেখো’- কথা বলা যখন অপরাধ”। ষষ্ঠ অধ্যায়ে “প্রান্তিকতা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠী”। “অস্তিত্বহীন জনগোষ্ঠী” নিয়ে আলোচনা আছে সপ্তম অধ্যায়ে। অষ্টম অধ্যায়ে “নারীর অধস্তনতার বিভিন্ন মাত্রা ও ভয়ের সংস্কৃতি”। বইয়ের নবম অধ্যায়ে লেখক ড. আলী রীয়াজ ব্যাখ্যা করেছেন “হিন্দু জনগোষ্ঠীর জীবন, অনিশ্চয়তা ও ভীতি” নিয়ে। বইয়ের দশম অধ্যায়ে আছে “ভয়ের সংস্কৃতি ও ভবিষ্যৎ”। অসামান্য এই তথ্যভিত্তিক বইয়ের শেষে লেখক যুক্ত করেছেন “গ্রন্থপঞ্জি”।

    প্রথমা প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত এই বইটি প্রথমে বের হয় ২০১৪ সালের নভেম্বরে। পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকায় বোধ করি এর তৃতীয় মুদ্রণ ২০২১ সালের নভেম্বরে।

    লেখক ড. আলী রীয়াজ মনে করেন “ভয়” স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয় না। একটি গোষ্ঠীর জবরদস্তির শাসন চালানো হচ্ছে এই “ভয়” তৈরির উপলক্ষ। এতে জবাবদিহিতার শাসন বা কর্তৃত্ববাদ সহজে জারি করা চলে। একই সঙ্গে তা টিকে থাকে। একজনকে শিক্ষা দিয়ে আরও বহুজনকে বাধ্য করা সর্বত্র বিস্তৃত ভয়ের সংস্কৃতির মোদ্দাকথা।

    অনেক ইতিহাস নির্ভরতা থাকলেও বইয়ে মূলত ১৯৯০ সাল পরের ঘটনা প্রাধান্য পেয়েছে। কারণ লেখক মনে করেন, “১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেনাশাসন অবসান ঘটার পর আশা করা হয়েছিল যে এই ধরনের অবস্থার অবসান হবে; কিন্তু কার্যত তা ঘটেনি। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের মধ্যে যে শাসকগোষ্ঠীর আধিপত্য রয়েছে, তারা জনগণের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নের চেয়ে, নাগরিকের অংশগ্রহণের কাঠামো তৈরির চেয়ে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার দিকেই অধিক মনোনিবেশ করেছে। ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার এই প্রবণতাই আতঙ্ক এবং সন্ত্রাসের ব্যাপ্তি ঘটেছে এবং ক্রমান্বয়ে ভয়ের সংস্কৃতিই হয়ে উঠেছে সমাজ ও শাসনের বৈশিষ্ট্য।”

    বইয়ের অধ্যায়ে অধ্যায়ে লেখক সুস্পষ্ট করেছেন ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের আঁতাত ও দ্বিচারিতা। তিনি বইয়ের পরতে পরতে উল্লেখ করেছেন যথার্থ সংবাদসূত্রও।

    লেখক ড. আলী রীয়াজের পরিস্থিতি বিবরণে বাদ যায়নি গণমাধ্যমের ভূমিকা। তার মতে সংবাদমাধ্যম, “ব্যক্তির মহিমাকীর্তন এবং সন্ত্রাস ও আতঙ্ককে স্বাভাবিকীকরণের মধ্য দিয়ে সেই কাজ প্রতিদিন করা হচ্ছে। আরও গভীরভাবে বিবেচনা করলে প্রভুত্বকারী-কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির ধারাকে যে প্রতিদিন বাংলাদেশের গণমাধ্যম সমালোচনাহীনভাবে উপস্থাপন করছে, তা-ও তার ওই ভূমিকার অন্তর্গত। গণমাধ্যম নির্ধারণ করছে গণ-আলোচনার সূচি, যেখানে অনুপস্থিত নাগরিকের অধিকারের প্রশ্ন, আইনের চোখে নাগরিকের সমতার প্রশ্ন।”

    “ভয়ের সংস্কৃতির রাজনৈতিক অর্থনীতি” অধ্যায়ে লেখক আলোকপাত করেছেন ঔপনিবেশিকতার পর্যায় থেকে এখনের রাষ্ট্রের রূপান্তরের প্রধান প্রবণতা। তিনি লিখেছেন, “রাষ্ট্রযন্ত্রের সেবক ও ভৃত্যের প্রয়োজনে ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার ঘটানো হয়। এভাবে গোটা সমাজ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রানুগত, রাষ্ট্র পরিপোষিত একগুচ্ছ নতুন মধ্যশ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। . . . ১৯৪৭ সালের আগে বিভাগপূর্ব গোটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই মধ্যশ্রেণি বারবার কর্তৃত্বের আসনে নিজেকে স্থাপন করতে চেয়েছে। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের সঙ্গে যুগপৎ সহযোগিতা ও দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হতে সচেষ্ট হয়েছে। তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে আরও বেশি আদায়; রাষ্ট্র পরিচালনায় কিঞ্চিৎ অংশীদারত্ব। মধ্যশ্রেণির এই আপসমুখী রাজনীতির বাইরে গ্রামের দারিদ্রপীড়িত নিগৃহীত শ্রেণিগুলো (কৃষক যার অন্যতম) প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে বারবার চ্যালেঞ্জ করেছে। “

    লেখকের মত, “১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্রের একটা বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে যায়; সেটা কাকতালীয় নয়, বরং ক্ষমতাসীনদের চেষ্টার ফসল। বাংলাদেশে ‘ইন্টারমিডিয়েট স্টেস্ট’ থেকে ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ স্ট্রেট’- এ পরিণত হয়। এই ধরনের রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, যারা তার ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকে, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, তারাই পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে, তাদের হাতেই রাষ্ট্রের সম্পদ বণ্টনের ক্ষমতা পুঞ্জীভূত হয়।”

    লেখক মনে করেন, “ভাবাদর্শ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উপায় হচ্ছে দুটো। প্রথমত, একটি নির্দিষ্ট ধরনের ডিসকোর্স সৃষ্টি ও বহাল রাখা। দ্বিতীয়ত, ওই ডিসকোর্সের স্বীকৃতি ও অনুমোদনের ব্যবস্থা করা। এভাবেই সম্পন্ন হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ওপর ভাবাদর্শের জাল বিস্তার ও আনুগত্য আদায়ের তৎপরতা।

    ভীতি উৎপাদনের চার হাতিয়ারের মধ্যে ড. আলী রীয়াজ গুরুত্ব দিয়েছেন দেশে বিরাজমান চার প্রবণতাকে। এর মধ্যে আছে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, গায়েবি মামলা। তিনি মনে করেন এর কোনো কোনোটি কেবল রাষ্ট্রীয় সংস্থার পক্ষেই ঘটানো সম্ভব।

    বইয়ের “কথা বলা যখন অপরাধ” অধ্যায়ে উল্লিখিত হয়েছে আইসিটি অ্যাক্ট এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট এর ব্যবহার নিয়ে বেশ কিছু প্রবণতা। এমন আইনি ভীতির সঙ্গে যখন মিশে যায়, নাগরিকের ফোনে আড়ি পাতার মতো নিকৃষ্ট অপরাধ।

    ড. আলী রীয়াজ বইয়ের “প্রান্তিকতা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠী” অধ্যায়ে একই দেশে জাতিগত বৈষম্যের কথা বলেছেন সহজ ও তথ্য নির্ভর ভাষায়। বইয়ের আরও দুই অধ্যায় হচ্ছে “নারীর অধস্তনতার বিভিন্ন মাত্রা ও ভয়ের সংস্কৃতি” ও “হিন্দু জনগোষ্ঠীর জীবন, অনিশ্চয়তা ও ভীতি” লৈঙ্গিক ও ধর্মীয় দিক থেকে সর্বগ্রাসী ভয়ের মাত্রা উন্মোচন করেছেন।

    ভয় মূলত অধীনতারই নির্দেশক। আর স্বাধীন সত্ত্বা হয় ভয়হীন উদার। বইয়ের শেষ অধ্যায়ে “ভয়ের সংস্কৃতি ও ভবিষ্যৎ” এ ভয় মুক্ত থাকার ডাক দিয়েছেন এ কালের বিরলপ্রভ সত্যনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী ড. আলী রীয়াজ। তিনি জোর দিয়েছেন একই সঙ্গে সমষ্ঠিগত ও ব্যক্তিগত প্রতিরোধের। যার অভাবে এখন ধুঁকছে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। তখন ভয়ের রাজত্ব উড়িয়ে দেওয়ার ডাকের এক বই মনে হয় “ভয়ের সংস্কৃতি : বাংলাদেশে রাষ্ট্র, রাজনীতি সমাজ ও ব্যক্তিজীবন”।

    পাঠ প্রতিক্রিয়া

    বই : ভয়ের সংস্কৃতি : বাংলাদেশে রাষ্ট্র, রাজনীতি সমাজ ও ব্যক্তিজীবন

    লেখক : আলী রীয়াজ

    প্রচ্ছদ : মাসুক হেলাল

    প্রথমা প্রকাশন

    নভেম্বর ২০২১

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close