• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

কুড়ি কুড়ি বছরের পরে

প্রকাশ:  ০১ আগস্ট ২০২২, ১৫:৩৬ | আপডেট : ০১ আগস্ট ২০২২, ১৬:৩১
জিয়াউল হক মুক্তা

— শনু, শোন।

ভদ্রমহিলা চমকে গেলেন। সেই ডাক! খুব নরম গলা তবে জড়ানো নয় এতটুকু, বেশ জোরালো। জগতে একজনই তাকে এভাবে ডাকেন। শরীর না সরিয়ে তিনি ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে তাকালেন। তার চোখে কিছুটা বিস্ময়— বাস্তবের বিভোরকে অনেক বুড়ো দেখাচ্ছে। তিনি তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন। বিস্ময় কাটিয়ে ওঠে ইশারায় কাছে ডাকলেন। দুজন পাশাপাশি হেঁটে কিছুটা সামনে গিয়ে একটি বেঞ্চে বসলেন।

— বয়স কতো হলো আপনার? একাত্তর না?

— তোমার বাহাত্তর।

— পার্কে মেয়েদের পেছন পেছন হেঁটে পাছা দেখার অভ্যাস এখনো গেলনা! লুচ্চামি ছাড়েন।

— তুমি খুব ভালো করে জানো এবং বিশ্বাসও করো যে আমি তোমার সোয়ামির মতো নই। জীবনে মাত্র একবারই একজনের পেছন পেছন হেঁটেছি, আর সেটা তুমি, তুমি তা জানো।

— মৃতদের নিয়ে টানাহ্যাঁচরা করা শোভন নয়।

— অ্যাপোলজিস।

— গ্র্যান্টেড।

— বাজে কথা বললে কেন?

— এখনো ফান বোঝেন না কেন?

বিভোর চুপ করে গেলেন। শনুও। তারা পাশাপাশি বসে রইলেন। একসময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর পরে ভার্চুয়াল-রিয়ালিটির কল্যানে পরস্পরের সব খবরই তাদের কাছে আছে। খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য এখানে কোন প্রশ্ন করার দরকার নেই।

কতোক্ষণ গিয়েছে তারা বলতে পারবেন না; শীত-সকালের কোমলতা ততোক্ষণে গিলে খেয়েছে কড়কড়ে রোদ। ঘাসের শিশির সব উধাও। বিভোর নিরবতা ভাঙলেন—

— আমরা পারি বটে!

— কী?

— এই কিছু না বলে পাশাপাশি বা কাছাকাছি থাকা।

— হুঁ।

— আমাদের যৌবন থেকে।

— আমি তখন ভিজে যেতাম।

— জানি।

— অথচ ভাব করতেন যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানতেন না।

— তোমাকে একবার বলেছিলাম। তখন তুমি অবশ্য ভীষণ রকম চমকে ওঠে আমার চোখে তাকিয়েছিলে সরাসরি; অনেকক্ষণ।

— কিন্তু ততো দিনে আমি অন্যের হয়ে গেছি।

— আই ম্যানুফ্যাকচার্ড দ্যাট।

— য়্যু ব্রুটাল।

— না, আমার খুব অভিমান হয়েছিল। বিসর্জন-মগন ছিলাম।

— য়্যু স্টুপিড, ইডিয়ট।

— হ্যাঁ। তার কুড়ি বছর পর তুমি যেদিন আমাকে নির্বোধ ডাকলে, আমার মনে হয়েছিল আমরা আমাদের বিষয়ে একটা ঐকমত্যে পৌঁছে গিয়েছি। আমি তখন তোমার থেকে এক হাজার মাইল দূরে। সে বিকেলে আমি পাখি হয়ে গিয়েছিলাম। মেট্রোয় চড়ে যেন উড়ে গিয়েছিলাম দশ কিলোমিটার দূরে কিনোকুনিয়ায়। সেদিন অনেকগুলো কবিতার বই কিনেছিলাম। তোমার জন্য কিনেছিলাম ‘দ্য জর্নালস অব সিলভিয়া প্লাথ ১৯৫০—১৯৬২’। ফেবার অ্যান্ড ফেবারের অরিজিনাল প্রিন্ট।

— আর আমি তখন আপনাকে ফোন করে করে সারা।

— হ্যাঁ, কিন্তু আমার মন খারাপ হয়নি। একটি পরিতৃপ্তিবোধ ছিল মানস ও অবয়ব জুড়ে। সে ছিল তোমার ফেরা।

— আমাদের বাচ্চারা তখন বড় হচ্ছিলো। আমাদের দায়বদ্ধতা ছিল।

— হ্যাঁ, আমরা পরষ্পরকে সহযোগিতা করছিলাম আমাদের দায়িত্বগুলো ভালোভাবে পালন করতে।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিভোর বললেন, সামনে চলো। শনু উৎসুক হলেন, কোথায়? তিনি উত্তর দিলেন, গেইটের বাইরে, দেজা ভু। শনু বললেন, ওখানে আমার ভালো লাগেনা, বুড়োবুড়িদের দঙ্গল সারাক্ষণ বকরবকর করে। বিভোর টিপ্পনি কাটলেন, এঁহঁ... একেবারে কচি খুকি আমার, বায়ো কি তেয়ো! চপলা কিশোরীর মতো কিনিকিনি হেসে ওঠলেন শনু। প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল বিভোরমানস। মৃদু পায়ে হেঁটে এসে দেজা ভু-তে তারা বসলেন মুখোমুখি।

ওয়েটার এলেন; খুব মিষ্টি একটা মেয়ে; হতে পারে পার্ট-টাইমার; কালো জিন্স আর স্লিভলেস জলপাই ভেস্ট ছাপিয়ে বুকের ওপর নিপাট সাদা এ্যাপ্রন বাঁক নিয়েছে মনোহর। স্মিতমুখে তাকিয়ে রইলেন বুড়োবুড়ির দিকে। বিভোর অর্ডার করলেন, আর্ল গ্রে মিডিয়াম, নো মিল্ক, নো সুগার, সিম্পল লিকার, টু। শনু সরাররি মেয়েটিকে বললেন, আমার ওর মতো সুগার প্রবলেম নেই; ফর মি আর্ল গ্রে মাইল্ড, উইথ হানি অ্যান্ড লেমন; আজকের সকালটা মধুর। হো হো হেসে ওঠলেন বিভোর।

শনু বসেছেন আরাম করে, সামান্য হেলান দিয়ে। বিভোর বসেছেন টেবিলে কনুই রেখে দুই করতলে নিজের মুখাবয়ব ধরে, শনুর দিকে সামান্য ঝুঁকে। তারা তাকিয়ে আছেন চোখে চোখে। দেজা ভু-র কাঁচের দেয়ালের বাইরে পার্কে গাছের মাথায় রোদ ঝলমল করছে; শাখারাও কইছে কথা হেলেদুলে নিচুস্বরে খুব— বোঝা যায়।

এনজয় দ্য আর্ল গ্রে, য়্যুরসেল্ভস ঠু, বলে চায়ের কাপ রেখে চোখ টিপে মেয়েটি চলে গেল।

প্রথম চুমুক দিয়ে বিভোর পার্কের কথপোকথনের জের টেনে বললেন, তখনও তুমি বলতে যে আমার সাথে কথা বললে তোমার সারা শরীরে এক অদ্ভুত অনুভূতি হতো, রাতভর তুমি ঘুমোতে পারতে না, সকালে অস্থির থাকতে মাথার ব্যথায়। নরম, গভীর ও ভারি হয়ে এসেছে তার কণ্ঠস্বর।

— হুঁ। দ্যাট ওয়জ এ কাইন্ড অব সিকনেস।

— হুইচ লগড মি টু এ সারটেইন কাইন্ড অব স্যাডনেস। চুপি চুপি কাঁদতাম।

— চিরকালের ছিঁচকাঁদুনে। সেন্টিমেন্টাল রাবিশ।

— এরপর আমাদের দ্বিতীয় এপিসোড শেষ করে তুমি আবারও চলে গেলে দ্বিতীয় কুড়ি বছরের বিরতিতে।

— এটা অশেষ বা প্রলম্বিত হতো আজ দেখা না হলে।

— হুঁ।

আবারও তারা ডুব দিলেন নিরবতার গহীনে। হয়তো ভেতরে ভেতরে কথা বলছিলেন যার যার মতো করে।

— শনু!

— হুঁ।

— তোমার হাতটা দাও।

— অর্ডার করেন কেন? আপনার হাত নেই?

বিভোর দু'হাত বাড়িয়ে শনুর ডান হাতটি তুলে নিলেন। তার তালুর উল্টো পিঠে অধরোষ্ঠ দিয়ে এঁকে দিলেন নরম ভেজা একটি চুমু। তারপর সে হাত আলতো ধরে রাখলেন নিজের গালে। উভয়ের চশমার লেন্স তখন কিছু বাস্প ধরছিলো।

অনেক অনেকক্ষণ পর অস্ফুট স্বরে শনু বললেন, যাবো। বিভোর খুব আলতো করে শনুর হাতটি রাখলেন ঠিক যেখান থেকে তুলে নিয়েছিলেন সেখানে।

— যাবে?

— হুঁ।

— কী কাজ?

— বা রে! একার হলেও একটা সংসার আছে তো! নাকি? মোস্টলি সার্ভিস-ম্যানেজমেন্ট।

— তা ঠিক।

দেভা ভু-র পেমেন্ট সেরে বাইরে দাঁড়িয়ে শনুকে পার্কিঙের দিকে বিদায় দিচ্ছেন বিভোর। শনু হেঁটে যাচ্ছেন চল্লিশ বছর আগের মতো ছন্দোবদ্ধ ধীর পদবিক্ষেপে। তিনি ডাকলেন, শনু!

শনু কাঁধ বাকিয়ে পেছনে তাকালেন; তাদের প্রথম দেখার মতো করে।

— কবে দেখা হবে?

— আবার? চতুর্থ এপিসোড? আরো কুড়ি বছর বাঁচার শখ আপনার?

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সম্পাদক, লড়াই।

পূর্বপশ্চিম- এনই

জিয়াউল হক মুক্তা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close