• শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১০ মাসে ১৬ হত্যাকাণ্ড, আসামি ৪০০ মামলা ১৬৫

প্রকাশ:  ২০ জুন ২০১৮, ১৩:০০
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গত ১০ মাসে ১৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সবশেষ সোমবার রাতে উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে গলা কেটে হত্যা করা হয় রোহিঙ্গা নেতা আরিফ উল্লাহকে। একই দিন দিবাগত রাতে টেকনাফে রোহিঙ্গাদের দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ১২ জন। এ ছাড়া আরও দেড় শতাধিক বড় ধরনের অপরাধকাণ্ড ঘটিয়েছে মিয়ানমারের এই নাগরিকরা। খুন ছাড়াও তাদের অপরাধের মধ্যে চোরাচালান, মাদক ব্যবসা, ডাকাতির মতো ঘটনা রয়েছে। এসব ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় আসামি করা হয়েছে প্রায় ৪০০ রোহিঙ্গাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতে, অপরাধের এ মাত্রা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। ভিটেমাটিহারা এসব রোহিঙ্গা অপরাধ চক্রের সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত হতে হতে এরা মানসিক বৈকল্যের শিকার হচ্ছে বলে জানান মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাই তারা সহজে খুনের মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, অপরাধকর্মের কারণে এ পর্যন্ত সহস্রাধিক রোহিঙ্গাকে সাজা দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করে জেলে দিয়েছে আরও শতাধিক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে। মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের শিকার এসব রোহিঙ্গা মনোবৈকল্যের কারণে এমন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এখনো ৮০ শতাংশ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু রয়েছে ট্রমাতে। এ অবস্থা থেকে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে কাজ করছে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি উইং এবং দেশি-বিদেশি অন্তত এক ডজন এনজিও।

সম্পর্কিত খবর

    জানা গেছে, ২৪ আগস্টের পর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে ‘জাতিগত নিধনের’ শিকার হয়ে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে আশ্রিত রয়েছে আরও প্রায় সাড় তিন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। যুগ যুগ ধরে মানবাধিকারবঞ্চিত এই জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার। রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, শিক্ষা, আবাসন, স্বাস্থ্যসহ সব ধরনের নাগরিক ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে নিজ দেশে পরবাসী জীবন যাপন করে আসছিল রোহিঙ্গারা। সবশেষ গত বছর ২৪ আগস্ট রাত থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত নিধন অভিযান শুরু করে। ব্যাপক নির্যাতন, গণহত্যা, গুম, নারী ও শিশু ধর্ষণ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ফলে ভীতসন্ত্রস্ত রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু সর্বস্ব ত্যাগ করে খালি হাতে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এ ঘটনায় খুঁজে পেয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের আলামত।

    জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এ ঘটনাটিকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের ‘পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’ বলে আখ্যা দিয়েছে। জাতিসংঘ এবং পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ বর্বর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর, মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিপন্ন রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, ধর্মীয় নেতা, মন্ত্রী, উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল এসে উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করেছেন। মার্কিন মানবাধিকার সংস্থা হলোকাস্ট মিউজিয়াম এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানবাধিকার সংস্থা ফোরটিফাই গ্রুপ এক যৌথ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার ‘জোরালো প্রমাণ’ পাওয়ার কথা জানিয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত সংঘবদ্ধ ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার যৌন নিপীড়নের আলামত হাজির করেছে। এত সব অমানবিক অত্যাচার-অনাচারের শিকার হয়ে যারা বেঁচে আছে, তারা মানসিকভাবে চরম বিপর্যয়ের শিকার বলে জানান মনোবিশ্লেষকরা।

    রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ১১টি সেন্টার স্থাপন করে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা ইউনাইটেড থিয়েটার ফর সোশ্যাল অ্যাকশনেন (উৎস)। এর প্রধান নির্বাহী মোস্তফা কামাল যাত্রা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হতে হতে রোহিঙ্গারা অনেক আগে থেকেই মনোবৈকল্যের শিকার। এর ওপর জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে তারা নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদের পর প্রতিটি ধাপে যে অন্যায়-অত্যাচারের শিকার হয়ে এপারে এসেছে। এতে তাদের স্বাভাবিক ও মানসিক আচরণ বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। নিজের চোখের সামনে নিকটজনকে হত্যা-ধর্ষণের মতো পাশবিক নির্যাতন ঘটার কারণে অনেকে এখনো বাকরুদ্ধ। মনের ওপর নেতিবাচক চাপ পড়াতে তারা এখন ভালো কিছুর পরিবর্তে নেতিবাচক বিষয়ে জড়িয়ে পড়ছে।’

    এদিকে রোহিঙ্গাদের মানসিক সেবা দানের জন্য উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সরকারের নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন, এসিএফ, এমএসএফ, গণস্বাস্থ্য, মুক্তি, সিআইসি, ব্র্যাকসহ ১২টি প্রতিষ্ঠান। এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড সাইকো স্যোসিও সাপোর্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ (এমএইচপিএসএস) নামের একটি মোর্চা গড়ে তুলেছে, যেখান থেকে মানসিক বিপর্যস্ত রোহিঙ্গাদের সহায়তাদানে নিয়মিত কর্মপরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়িত হচ্ছে বলে জানান এমএইচপিএসএস কো-অর্ডিনেটর ফারহানা রহমান ঈশিতা।

    এদিকে রোহিঙ্গাদের এই অপরাধ নিয়ে চট্টগ্রামের ডিআইজি ড. এস এম মনিরুজ্জামান সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে গিয়ে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতনের শিকার হয়ে একটি আবদ্ধ জায়গা থেকে এসেছে। তবে এখানে যে অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে, সেগুলো পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি বা ভালো লাগা না লাগা থেকে হয়েছে। ইতিমধ্যে কিছু চিহ্নিত অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও সতর্ক থাকতে হবে।’ উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের বলেন, ‘নানা কারণে রোহিঙ্গারা অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। এদের অনেকের কোনো পিছুটান নেই। অনেকে আবার উদ্বাস্তু জীবনে অসন্তুষ্ট। তাই তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় থেকে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

    সুত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

    /এসএইচ

    সারাদেশ

    অনুসন্ধান করুন
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close