• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

মতিহারের মহানায়ক

প্রকাশ:  ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২১:৩২
আহমদ সফিউদ্দিন

জুতো খুঁজছি আমরা। তুমুল আড্ডাবাজের একজোড়া জুতো। সবার চোখ ছাত্রদের পায়ের দিকে। জিনস পড়াদের দিকেই নজরটা বেশি। ভাই কিছু মনে করবেন না। আপনার জুতোর তলাটা একটু দেখবো। থমকে যাবার পর বুঝিয়ে রাজি করানো। না চলবে না। নতুন জুতো। ছবিতে সোলের ডিটেইলস আসতে হবে। পুরনো জুতো চাই। অনেক খুঁজেও পছন্দসই জুতো পাওয়া গেলনা। হতাশ আপেল আবদুল্লাহ্, রেজা হক শান্তি, তারিক-উল-ইসলাম। অবশেষে হঠাৎ নজর পড়লো দলনেতার জুতোর দিকে। দাউদী আপনার পা ওঠান। ইউরেকা! এইতো পেয়ে গেছি! এবার যাত্রা কেন্দ্রীয় কাফেটেরিয়ার দিকে। সরাসরি টেবিলের ওপর পা। পাশে চায়ের কাপ। সিগারেটের প্যাকেটও বাদ গেলনা। বিভিন্ন এ্যাংগেলে ছবি তুললাম। অলঙ্করণ করলেন মোশতাক দাউদী। আড্ডা কবিতাপত্রে প্রচ্ছদ জুড়ে একজোড়া জুতো। আলোড়িত হলো ক্যাম্পাস। ঢাকা অবধি ছড়িয়ে গেল। ব্যাক কভারে ষোলজন কবির ষোলটি মুখচ্ছবি। আড্ডার ঢঙে। এগুলিও তোলা হয়েছিল চায়ের আড্ডায়। কাফেটেরিয়ায়। তখন সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ। সংবাদপত্রে সেনসরশিপ। বাংলা ১৩৮৭ সনে (খৃ. ১৯৮০) আড্ডার প্রচ্ছদ ছিল সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতীকি প্রতিবাদ।

এবার ছুটছি আমরা জনমানবহীন পদ্মার চরে। হাতে লম্বা লাঠি আর কাস্তে। সঙ্গে একজন মাত্র ছাত্রী। ভয়ও লাগছে! আরো সামনে। অদূরে দেখা যাচ্ছে উঁচু বালির পাহাড়। ওখানে দাঁড়ালে ব্যাক গ্রাউন্ডে শুধুই আকাশ। অতএব সিলউট ছবিতে অবয়ব শুধু দৃশ্যমান হবে। চেহারা বোঝা যাবেনা। এভাবেই অনেক বুঝিয়ে রাজী করানো হযেছিল মাহাফিয়া পারভিন মানাকে। পলিটিক্যাল সায়েন্সের নজরকাড়া সুদর্শিনী। গার্লস গাইড করতেন স্কুল থেকে। খুবই সাহসী। কিন্তু রাকসু প্রকাশনায় প্রচ্ছদের কখা শুনে রাজী হলেন না। রাকসুর ক্যাবিনেটে ভিপি ফজলে হোসেন বাদশা। জিএস জাহাঙ্গীর কবির রানা। সাহিত্য সম্পাদক রেজা হক শান্তি। ছাত্র সমাজের ভিসি বারী বিরোধী আন্দোলন সবে শেষ হলেও জুলুম গ্রেফতার চলছে। অবশেষে সিলউট ছবিতে মডেল হতে রাজী হয়েছেন আমার বন্ধু ভগিনী। মোয়াজ্জেম হোসেন বুলবুল আর মানার হাতে কাস্তে। মোশতাক দাউদী আর রেজা হক শান্তির হাতে লাঠি। তার আগে পোটলা খুলে প্যান্টের ওপরই লুঙ্গি জড়ানো হয়েছে। বুলবুলের মাথায় গামছা। সিনেমা পরিচালকের মত ডিরেকশন দিচ্ছেন দাউদী। ছবি তুললাম। প্রচ্ছদে এই ছবির সাথে মোটা তুলিতে দাউদী লিখলেন- রণক্ষেত্রে। স্বৈরাচার বিরোধী মুক্তি চেতনার বহিঃপ্রকাশ এই প্রচ্ছদ। শেষ প্রচ্ছদও হুবহু একই। শুধু অতিরিক্ত সংযোজন একটি লাইন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের বিশেষ প্রকাশনা। রাকসুর নাম প্রচ্ছদের সামনে আনলে প্রচ্ছদের ব্যাঞ্জনা হারিয়ে যেত। (রাকসু নেতারা তা বুঝেছিলেন, এখন যা হতো অসম্ভব)। ১৯৮১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির প্রকাশনাটি সারাদেশে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করলো। সম্পাদনায় রাকসুর সাহিত্য সম্পাদক রেজা হক থাকলেও আসল গুরু ছিলেন দাউদী। তখন সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন ছিল যে মানার আপত্তিতে মডেলদের নাম ছাপানো গেলনা। দাউদী ছবি আঁকতেন। হাতের লেখাও অতুলনীয়। কমপিউটারে বাংলা তখনো আসেনি। প্রচ্ছদের ইলাসট্রেশন ডিজাইন সবই হাতে করতে হতো। প্রচ্ছদে বিপ্লব আনলেন দাউদী।

সম্পর্কিত খবর

    আমাকেও খুঁজে বের করেছিলেন দাউদী। তখন শহর আর ক্যাম্পাস মিলিয়ে হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র ক্যামেরা। ফিল্ম প্রিন্ট ব্যয়বহুল। দৈনিক বাংলা-র পাশাপাশি সাপ্তাহিক বিচিত্রা আমাকে একই সাথে রাজশাহী শহর ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছে। এসএলআর ক্যামেরা আমার হাতে। দাউদী দলবল সহ প্রেসক্লাবে এসে আমাকে সম্মোহিত করলেন- আপনাকে ছবি তুলতেই হবে। স্টুডিওঅলারা এসব বুঝবেনা। এভাবেই পরিচয়। আমি সিনিয়র হলেও সেই থেকে বাংলা বিভাগের একঝাঁক নবীন কবিকুঞ্জে ঠাঁই পেলাম। প্রচন্ড সৃজনশীলতায় উন্মাদ, কখনও কাজ পাগল, কখনও খেয়ালী। মুখে মুখে ছড়া কবিতা গান। আড্ডায় প্রেম, বিরহ, স্বদেশ ভাবনা। অবসরে লেখালেখি। কবিতাপত্র থেকে সংবাদপত্র। কী বিভাগে, কী হলে, কী আমতলায়, কী শহরে সবখানে ওরা সৃজনশীল আড্ডার দখলদার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাসা পর্যন্ত এরা প্রশ্রয় পেয়েছিলেন। আর ওদের মধ্যমনি মোশতাক দাউদী।

    (প্রকাশিতব্য স্মারক গ্রন্থ থেকে)

    <নোট: মানা লোকপ্রশাসন বিভাগের ড. এটিএম ওবায়দুল্লাহর স্ত্রী। মোয়াজ্জেম হোসেন বুলবুল রাজশাহী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান।

    ‘এই খানে বসা যাক তবে, এইখানে

    সমস্ত করণীয় ফেলে বাবলার নিরেট-নির্জনে

    এইখানে বসা যাক এসো সরে এসো শিতল ছায়ায়

    দ্বিধাহীন ডুবে থাকি এসো মতিহার সবুজ মায়ায়’

    মোশতাক দাউদী- ‘এমনি দারুন দিনে হায়’ থেকে

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close