• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

তরুণদের নিয়ে ভাবতে হবে

প্রকাশ:  ০৯ অক্টোবর ২০১৮, ১৭:৫৮ | আপডেট : ০৯ অক্টোবর ২০১৮, ২১:১২
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

তরুণদের নিয়ে আমি সব সময় স্বপ্ন দেখি। কারণ তরুণরা যা করতে পারে তা হয়তো অন্য কেউ তা করার ক্ষমতা রাখেনা। কিন্তু আমরা তরুণদের যেভাবে অনুপ্রাণিত করার কথা ছিল সেটি পারছি কিনা তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। তরুণদের চোখের দিকে তাকালে আমি অসীম সম্ভাবনা দেখতে পাই। তরুণরাই আমাদের শক্তি আর সৃজনশীল ভাবনার আধার। আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর ৩৪ শতাংশ তরুণ।

একটি অনলাইন সংবাদপত্রের জরিপে জানা গেছে, তরুণদের ৮৭.৫ শতাংশ আশাবাদী হওয়ার মতো মনোভাব রাখে। তাদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ তরুণের যে লক্ষ্য, তা অর্জন করার ব্যাপারে তারা খুব বেশি আত্মবিশ্বাসী। যদি এটিকে বয়সভিত্তিক বিবেচনা করা হয় তবে দেখা যায় ১৮ থেকে ২২ বছর বয়সী তরুণদের ৫৫ শতাংশ তাদের জীবন সম্পর্কে অনেক বেশি আশাবাদী। যদি ২৩ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণদের কথা ভাবা হয় তবে আশাবাদী তরুণের হার ৪৬ শতাংশ। তবে ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর ৩৫ শতাংশ ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। এ থেকে একটি বিষয় বলা যায়, মানুষের বয়স যত কম থাকে তার ইতিবাচক মনোভাব তত বেশি থাকে। বয়স যতই বাড়তে থাকে, বাস্তবতা তাকে বলে দেয় এত বেশি আশাবাদী হওয়া যাবে না। কিন্তু এমনটা আমরা কেউ চাই না। বরং উল্টোটাই আমরা ভাবতে চাই। এটি কীভাবে করা সম্ভব সেটাই খতিয়ে দেখা দরকার।কিভাবে আমরা তরুণদের অনুপ্রাণিত করে ইতিবাচক ধারায় আনতে পারি এই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে।

সম্পর্কিত খবর

    যেমন একটা চাকরির জন্য তরুণদের মধ্যে কত বেশি প্রতিযোগিতা। কিন্তু চাকরিই কি জীবনের অপরিহার্য বিষয়। হয়তো কিংবা হয়তো না। যেমন জ্যাকমা নামটি আমরা হয়তো সবাই জানি। কিন্তু তার ব্যর্থতা থেকে সফল হয়ে ওঠার গল্প আমরা ক’জনই বা জানি। ছোটখাটো গড়নের চীনা মানুষটি এখন প্রায় ২৩০ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের কোম্পানি আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়তে খুব বেশি অর্থের প্রয়োজন নেই। এ ধরনের আরেকটি বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে জেফ বেজসের অ্যামাজন। একজন তরুণ ঘরে বসেই এ ধরনের অনলাইন শপিং খুলে বসে কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারে। এর সঙ্গে আউটসোর্সিংয়ের মতো কাজ করেও তরুণরা তাদের জীবন বদলে ফেলতে পারে। প্রকৌশল ও বিজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে যে তরুণরা সম্পৃক্ত আছে তাদের বিভিন্ন উন্নত দেশের শিল্প-কারখানায় বাস্তব জ্ঞান নেয়ার জন্য পাঠাতে হবে। চীনের মতো টেকনোলজি ট্রান্সফার ও রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বিষয়গুলো বুঝিয়ে তাদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা যায়।

    এ তো গেল শিক্ষিত তরুণদের বিষয়। কিন্তু যে তরুণরা অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত রয়েছে, তারা কি বেকার হয়ে বসে থাকবে? না, তা হতে পারে না। এ তরুণদের আমাদের দেশে যে ৭ থেকে ৮ লাখ কুটির শিল্প রয়েছে সেই শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ধরনের তরুণরা নিুবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসে। তাদের ঋণ নেয়ার মতো থাকে না কোনো অর্থসম্পদ। এর সমাধান সরকার দিতে পারে। আমাদের যে বাজেট রয়েছে সেই বাজেটের একটা অংশ বিনা শর্তে এ ধরনের তরুণদের জন্য রাখতে হবে। এছাড়া বেসরকারি যে শিল্প-কারখানাগুলো রয়েছে তাদেরও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এ তরুণদের দায়িত্ব নিতে হবে। এখনও আমরা অনেক দেশে আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে পাঠাতে পরিনি। যে তরুণ জনগোষ্ঠীকে দক্ষ করে বিদেশে পাঠানো হবে, তাদের যাতায়াতের খরচ বহন করার জন্য সরকারকে বাজেট রাখতে হবে।

    কারণ আমরা দেখি, যে তরুণদের আমরা বিদেশে পাঠাচ্ছি, জীবনের শেষ সম্বল বাড়ি-ভিটা বিক্রি করে তাদের বিদেশ যাওয়ার টাকা সংগ্রহ করতে হয়। অনেকে ভাবতে পারেন তরুণদের এ দায় দেশ ও সরকার নেবে কেন? এর কারণ হল বিদেশে যে তরুণদের আমরা কাজের জন্য পাঠাচ্ছি তাদের বিনিয়োগ হিসেবে ভাবতে হবে। যদি তাদের আমরা বিনিয়োগ হিসেবে ভাবতে পারি তবে দেশের প্রতি তাদের আনুগত্য ও আস্থা বাড়বে। ১৩ বছরের ভারতীয় বংশোদ্ভূত শিশু স্পর্শ শাহের বিষয়টি তরুণদের জন্য অনুপ্রেরণার গল্প হতে পারে। সে ব্রিটল বোন সিনড্রোম নিয়েই জন্মগ্রহণ করেছে। এই রোগের কারণে তার শরীরে ১৩০টিরও বেশি ফ্র্যাকচার রয়েছে। হয়তো এ কথা শুনে অনেকেই ভাবতে পারেন, এ অবস্থা নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। কিন্তু এই শিশুটি বলছে, ‘কোনো কিছুই আমার মনোবল ভাঙতে পারবে না কিংবা আমাকে গান থেকে বিরত রাখতে পারবে না।’ ভাবতেই অবাক লাগবে এ অবস্থা নিয়ে ছেলেটি ভারতীয় রাগসংগীত ও আমেরিকার র্যাপসংগীতের সমন্বয় করে নতুন ধরনের সংগীতের জন্ম দিয়েছে। এই ধারণাকে কেন্দ্র করে সে ‘ট্রিবুট টু এমিনেম’ নামের একটি অ্যালবাম বাজারে ছাড়ে; যার প্রতিটি গান সে নিজেই করেছে। এই অ্যালবাম থেকে অর্জিত টাকায় সে আমেরিকার বোস্টনের ব্রাকলি কলেজে লেখাপড়া করছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো, মানুষকে অনুপ্রাণিত করার জন্য বিখ্যাত টেপ টকের সে একজন মোটিভেশনাল বক্তা।

    এ ধরনের আরেকজন মানুষের গল্প আমরা তরুণদের প্রেরণা জোগাতে জানাতে পারি, যিনি শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে মানসিক শক্তির মাধ্যমে জয় করেছেন। মায়ের গর্ভ থেকে টেট্রা এমিলিয়া নামে বিরল সিডিরোম নিয়ে হাত-পা ছাড়াই জন্মগ্রহণ করেন অস্ট্রেলিয়ার নিক ভুজিসিস। নার্স যখন নিক ভুজিসিসকে মায়ের কাছে নিয়ে এলো তখন এই ধরনের বিকলাঙ্গ শিশুকে দেখে মা তাকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ‘এটিকে সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা’ হিসেবে বিবেচনা করে তাকে গ্রহণ করেন। এই ভুজিসিস ২০০৫ সালে ‘লাইফ উইদাউট লিম্বস’ নামের অলাভজনক একটি মোটিভেশনাল প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ইউটিউবে এ প্রতিষ্ঠানের নামে চ্যানেলটির প্রায় এক লাখ ১৫ হাজারের মতো সাবস্ক্রাইবার। তিনি হাত-পা ছাড়াই বিশাল সুমদ্র ¯্রােতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে পারেন, তিনি ফুটবল খেলতে পারেন, তিনি ছবি আঁকতে পারেন, স্কাই ডাইভার হিসেবে শূন্যে উড়তেও পারেন। এ ছাড়া যেকোনো ধরনের চ্যালেঞ্জিং কাজ তিনি করতে পারেন। অনেক বিখ্যাত বই যেমন ‘লাইফ উইদাউট লিমিটস’, ‘দ্য পাওয়ার অব আন স্টপেবল ফেইথ’, ‘লাইফ উইড আউট লাভ’ ইত্যাদি বইয়েরও লেখক।

    তিনিও টেপ টকের একজন মোটিভেশনাল বক্তা হিসেবে গোটা পৃথিবীর অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর অনুপ্রেরণার গল্পে তিনি প্রায়ই বলে থাকেন, ‘একজন মানুষ যদি হাত-পা ছাড়াই বড় স্বপ্ন দেখতে পারে, তবে আমরা কেন নয়।’ এখান থেকে তরুণদের শেখানো যেতে পারে, মানুষ কখনো তার স্বপ্নের সমান আবার কখনো তার স্বপ্নের চেয়েও বড়। বিগ ব্যাং থিওরির প্রবক্তা বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস ১৯৬২-৬৩ সালের দিকে দুরারোগ্য মোটর নিউরন ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। আমেরিকায় এই রোগকে বলা হয় লো গ্রেইরিজ ডিজিজ। চিকিৎসকরা হকিংসকে জানিয়ে দিলেন, তিনি আর দুই থেকে আড়াই বছর বাঁচবেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো, তাঁর সব কিছু প্যারালাইজড হয়ে যাওয়ায় তাঁকে হুইলচেয়ারের বিজ্ঞানী বলা হতো। হকিংস চিকিৎসকদের কথায় ভেঙে পড়েননি, বরং নিজের ভাবনাকে ইতিবাচক করে গবেষণার আনন্দ ও সৃষ্টিতে মেতে উঠলেন। এটাকেই বলা হয় ঘুরে দাঁড়ানো, যা চিকিৎসাবিজ্ঞানকেও হার মানিয়েছে। যেখানে দুই-আড়াই বছর বাঁচার কথা, সেখানে তিনি আরো ৫৪ বছর বেঁচে থাকলেন। এটা কি মিরাকল, নাকি ইতিবাচক মনোভাবের প্রতিফলন। এটা যে মিরাকল ছিল না, এটা যে জীবন বদলে ফেলার ইতিবাচক মনোভাববিষয়টি আমাদের তরুণদের বোঝাতে হবে। মানুষ যদি শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতা সত্ত্বেও শুধু নিজের জীবন নয়, অন্যদেরও জীবন পাল্টে দিতে পারে, তবে আমাদের তরুণরা পারবে না কেন। তরুণদের এ বিষয়গুলো বোঝানোর মতো নেতৃত্ব গ্রহণ করার দায়িত্ব আমাদের সমাজের সবার।

    আমরা শুধু ব্যর্থতা, হতাশা, বেকারত্ব ও তরুণদের নেতিবাচক বিষয়গুলো বেশি শুনে থাকি। কিন্তু তরুণরাও যে দেশ, মানুষ ও পৃথিবী বদলে ফেলতে পারে তার প্রচার-প্রচারণা তেমন একটা নেই। ফেসবুক, টুইটার, স্ক্রাইপি, ভাইবার, লিংকডিনে তরুণরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে আমরা হা-হুতাশ করছি। কিন্তু এগুলো ব্যবহার করেই তরুণরা যে আউটসোর্সিং করছে, অনলাইন শপিংয়ের মতো নতুন ধারণা সৃষ্টি করছে। বিদেশি গবেষকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করে গবেষণার জ্ঞানকে আদান-প্রদান করছে, সে বিষয়গুলো নিয়ে আমরা কিছুই বলছি না। জ্যাক মা নামটি আমরা হয়তো সবাই জানি। কিন্তু তাঁর ব্যর্থতা থেকে সফল হয়ে ওঠার গল্প আমরা কয়জনই বা জানি। ছোটখাটো গড়নের চীনা মানুষটি এখন প্রায় ২৩০ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের কম্পানি আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু এই অর্জন এক দিনেই গড়ে ওঠেনি। একটার পর একটা ব্যর্থতার পরই এসেছে এ ধরনের সফলতা। চীনের একটি সরকারি কলেজে তাঁর ভর্তি হতে তিন বছর সময় লেগেছিল, হার্ভার্ডে ১০ বার আবেদন করে ১০ বারই ব্যর্থ হন। চাকরির বাজারেও বারবার তাঁকে হোঁচট খেতে হয়েছে। ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৩০টি কম্পানিতে আবেদন করেও তিনি চাকরি পাননি। পুলিশের চাকরিতেও যেমন তিনি ব্যর্থ হয়েছেন, তেমনি কেএফসির মতো প্রতিষ্ঠানে ২৪ জনের মধ্যে ২৩ জনের চাকরি হলেও তাঁর সেখানেও চাকরি জোটেনি। এই ব্যর্থ মানুষটি যে ঘুরে দাঁড়ানোর দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন, তা আমরা তরুণদের সেভাবে বলতে পারিনি।

    এখন দরকার আমাদের গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। তরুণদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এ পি জে আবদুল কালাম, আইমান সাদিক, বিল গেটস, স্টিভ জবস, মার্ক জাকারবার্গ, টমাস আলভা এডিসন, আইজ্যাক নিউটন, আইনস্টাইন, শেকসপিয়ার, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মানুষদের সফলতা ও অনুপ্রেরণার গল্প শুনিয়ে বদলে ফেলতে চাই তাদের জীবন। তরুণদের আমরা এ পি জে আবদুল কালামের মতো করে বলতে চাইস্বপ্ন বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে স্বপ্ন দেখতে হবে।

    লেখকঃ শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ।

    অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close