• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

ভারত নারীদের জন্য বিপজ্জনক এটা মানতে মন সায় দিচ্ছে না

প্রকাশ:  ০৫ জুলাই ২০১৮, ০১:৪৬
নিজস্ব প্রতিবেদক

পৃথিবীর ৫৪৮ জন বিশেষজ্ঞ মনে করেন, পৃথিবীতে মেয়েদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলো হচ্ছে— ১. ভারত, ২. আফগানিস্তান, ৩. সিরিয়া ৪. সোমালিয়া, ৫. সৌদি আরব, ৬. পাকিস্তান, ৭. গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো, ৮. ইয়েমেন, ৯. নাইজেরিয়া, ১০ যুক্তরাষ্ট্র।

এই তালিকায় বাংলাদেশ নেই। বিস্মিত হওয়ার কথাই বটে। কী কারণে আমাকে বিশ্বাস করতে হবে যে বাংলাদেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র মেয়েদের জন্য বেশি বিপজ্জনক, আমি তার সদুত্তর জানি না।

সম্পর্কিত খবর

    সাত বছর আগে প্রথম এই সমীক্ষা করেছিল থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন। সেই তালিকায় ভারত ছিল চার নম্বরে। এক নম্বরে ছিলআফগানিস্তান। কিন্তু শেষ সাত বছরে ভারত উঠে এসেছে এক নম্বরে। এই মুহূর্তে মেয়েদের জন্য সবচেয়ে বিপদের দেশের তালিকায় ভারতের পরেই আছে আফগানিস্তান। পাকিস্তান আগে ছিল তিন নম্বরে। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় পাকিস্তান ছয় নম্বরে। তালিকায় দশটি দেশের নটিই এশিয়া বা আফ্রিকার। এর বাইরের একমাত্র দেশ যুক্তরাষ্ট্র।

    মেয়েদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর তালিকায় এক নম্বরে ভারত। আইসিসের আঁতুড়ঘর সিরিয়া, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের মেয়েরাও ভারতের মেয়েদের তুলনায় ভালো আছেন। নাইজিরিয়া, পাকিস্তান, সোমালিয়া—প্রতিটি দেশই এখন ভারতের থেকে তুলনামূলকভাবে ভাল জায়গায়। থমসন রয়টার্সের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় উঠে এল এই তথ্য। এই তথ্য কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? ৫৪৮ জন বিশেষজ্ঞের মতামতের ভিত্তিতে এই জরিপ করেছে থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন। মোট ছ’টি বিষয়কে সূচক হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল। মেয়েদের জন্য স্বাস্থ্য, লিঙ্গবৈষম্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যৌন নিগ্রহ, নারী নির্যাতন, নারীপাচার, নারীবিরোধী সামাজিক কুপ্রথা—এই ছ’টি বিষয়ের ভিত্তিতেই সমীক্ষাটি করা হয়েছে।

    কুপ্রথা, যৌন নিগ্রহ ও নারীপাচারে এক নম্বরে ভারত। বাকি সূচকগুলোতে কোথাও দুইয়ে, কোথাও তিনে। কুপ্রথায় আফগানিস্তান, সোমালিয়া, পাকিস্তান আর সৌদি আরবের চেয়েও পিছিয়ে আছে ভারত। যৌন নিগ্রহের বেলাতেও এক নম্বরে ভারত। ধর্ষণ এক বিশাল সমস্যা ভারতে। নারী পাচারেও লিবিয়া, নাইজেরিয়া, রাশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, আফগানিস্তানকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে ভারত।

    থমসন রয়টার্সের এই সমীক্ষা অনেককে হতাশ করেছে। বিশেষ করে ভারতীয়দের। তাঁরা কিছুতেই মানতে পারেন না যে ভারত মেয়েদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ। ভারতীয় জাতীয় মহিলা কমিশনের নেত্রী মনে করেন না মেয়েদের বিরুদ্ধে নির্যাতন দিন দিন বাড়ছে। তিনি মনে করেন, নির্যাতন আগেও ছিল, তবে অভিযোগ করার এবং অভিযোগ নথিভুক্ত করার সংখ্যাটা বাড়ছে। টমাস রয়টার্স ফাউন্ডেশন জানিয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে মেয়েদের বিরুদ্ধে যত রকম নির্যাতন এবং হেনস্থা আছে, তা বন্ধ হবে, মেয়েরা নিরাপত্তা পাবে, স্বাবলম্বী হবে, সামাজিক মর্যাদা পাবে। আমার মনে হয় না ফাউন্ডেশনের এই প্রতিশ্রুতি আদৌ বাস্তবায়ন হবে।

    আমি বিশ্বাস করি ভারতে নারীবিরোধী কুপ্রথা অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি। কিন্তু ভারত নারীদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক এ কথা মানতে আমার মন সায় দিচ্ছে না। নারীর জন্য ভারতের চেয়ে আফগানিস্তান ভালো, এ আমি কী করে মানবো? ভারতে উদারপন্থী যেমন আছে, রক্ষণশীলও তেমন আছে। নারীবাদী যেমন আছে, নারীবিদ্বেষীও তেমন আছে। প্রথা মানার লোক আছে, প্রথা ভাঙ্গার লোকও আছে। যৌন নির্যাতন সব দেশেই ঘটছে, ভারতে শিক্ষিত এবং সচেতন মানুষ বাড়ছে বলে যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে অভিযোগ নথিভুক্ত করার লোকও বাড়ছে।

    ভারত সম্পর্কে কিছু বলার আগে আমাদের জানতে হবে যে ভারতে একই সঙ্গে তিনটি বিশ্ব বাস করে, প্রথম বিশ্ব, দ্বিতীয় বিশ্ব, তৃতীয় বিশ্ব। একই সঙ্গে দুটি জগতও বাস করে, একটি সভ্য, আরেকটি অসভ্য। একই সঙ্গে দুটো কালও বাস করে, একটি এখনকার, একবিংশ শতাব্দির, আরেকটি এক হাজার থেকে কয়েক হাজার বছরের পুরোনো। এমন বৈপরীত্য অন্য কোনও দেশে মেলা ভার। সম্পদের বণ্টনও অদ্ভুত। কেউ বাড়ি বানায় ২০০ কোটি টাকা দিয়ে। ওদিকে ৬০ কোটি মানুষ বাড়িতে টয়লেট নেই বলে খোলা মাঠে যায় প্রশ্রাব পায়খানা করতে। অনেকে ভারতের আধুনিকতা দেখে, কিন্তু পিছিয়ে থাকাটা দেখে না। অনেকে আবার বৈষম্যটাই শুধু দেখে, এগিয়ে যাওয়াটা দেখে না। মেয়েরা রাষ্ট্রপ্রধান হচ্ছেন, আবার ‘মঙ্গল দোষ’ আছে এই কারণ দেখিয়ে গাছের সঙ্গে বা কুকুরের সঙ্গে মেয়েদের বিয়েও দেওয়া হচ্ছে। দুটোই সত্য। এই দুই সত্যের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভারত নিয়ে মন্তব্য করা সহজ নয়।

    তারপরও মেয়েরা কোথায় কেমন আছে এ নিয়ে এরকম সমীক্ষার খুব প্রয়োজন। যত বেশি আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দেওয়া হবে যে এই তোমার ভুল, লুকিয়ে রাখা নোংরাগুলো যত বেশি পৃথিবীসুদ্ধ মানুষকে দেখিয়ে দেওয়া হবে, তত বেশি লজ্জা হবে দেশগুলোর। লজ্জায় মুখ ঢাকবে আর চেষ্টা করবে ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার। আইন করে যে চরিত্র বদলানো যায় না, লজ্জা দিয়ে অনেক সময় সে চরিত্র বদলানো যায়। এটা ঠিক, বেশির ভাগ লোকের কোনও লজ্জা নেই। তাদের দেশে মেয়েরা নির্যাতিত হচ্ছে, এই খবরটি তাদের মোটেও বিচলিত করবে না, কারণ নির্যাতন মেয়েদের প্রাপ্য নয়, এ তারা ভাবতেও পারে না। প্রথমেই তাই এটা তাদের বিশ্বাস করানো জরুরি, পুরুষ ও নারী দুজনেই একই প্রজাতির মানুষ, ভিন্ন লিঙ্গ হওয়া সত্ত্বেও পুরুষ ও নারীর অধিকার সমান হওয়া অত্যন্ত জরুরি। মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলে তাদের কিছু কম সুবিধে সুযোগ পেতে হবে, তাদের কিছু বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হবে, ঘানিটা বেশি টানতে হবে, লভ্যাংশটা কম খেতে হবে,—এ কোনও সভ্য লোক মানবে না।

    জাতীয়তাবাদীদের কাজই হলো নিজের রাষ্ট্রের এবং সমাজের ভূয়সী প্রশংসা করা। এদের একটিই কথা, ‘আমার দেশ সকল দেশের সেরা’। এরা যে ভুলত্রুটি সংশোধন করে নিজের দেশটিকে আরও বাসযোগ্য, আরও উন্নত, আরও সভ্য করবে, তা নয়। জাতীয় পতাকাকে কী করে সম্মান করতে হয় তা মানুষকে শেখাতে এরা ব্যস্ত। দেশের গুণগান কী করে গাইতে হয়, তা শেখাতে ব্যস্ত। অন্যায় অনাচারের দিকে, দেশের দারিদ্র্য দুর্নীতির দিকে, বৈষম্য বিপর্যয়ের দিকে এরা নজর দিতে চায় না। এরা বিশ্বাস করে মানুষের পেটে খাবার না থাকুক, মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকুক, শিক্ষা স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা না থাকুক, তাতে কিছু যায় আসে না, যে করেই হোক জাতীয় সংগীতটা মানুষের মুখস্ত করতে হবে, দেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম ধাম মুখস্ত রাখতে হবে, তা না হলে তারা দেশপ্রেমিক নয়, দেশপ্রেমিক নয় মানে তারা দেশের শত্রু। উগ্র জাতীয়তাবাদীদের মতে, দেশের শত্রুদের জেলে ভরো, মেরে ফেলো, অথবা দেশ থেকে তাড়িয়ে দাও। দেশপ্রেমের এমন সংজ্ঞা সত্যিই ভয়াবহ।

    আমি তো মনে করি দেশপ্রেম তাঁদেরই বেশি যাঁরা দেশের মানুষের দারিদ্র্যে কাতর হন, সামাজিক অব্যবস্থাগুলোর বিরুদ্ধে চিৎকার করেন, দুর্নীতি আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে ওঠেন। রাষ্ট্র চালানোর দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের দোষ ধরেন। জাতীয় পতাকা ওড়াতে ওড়াতে জাতীয় সঙ্গীত গাইলেই দেশপ্রেমিক হওয়া যায় না। দেশপ্রেম আরও বড় কিছু। দেশের মানুষকে লিঙ্গ বর্ণ ধর্ম জাত নির্বিশেষে একই কাতারে রাখতে হয়। ধনী দরিদ্র, নারী পুরুষ, ব্রাহ্মণ শূদ্র, হিন্দু মুসলমান—সবাইকে মানুষ হিসেবে একই রকম মূল্য দিতে হয়। তা না দিতে পারলে দেশপ্রেমিক হিসেবে গৌরব করার কোনও অর্থ হয় না। আমি ভারতে বাস করছি আজ এগারো বছর। আমি হলফ করে বলতে পারি, ভারতীয় দরিদ্রের দুর্দশা দেখে, ভারতীয় মেয়েদের কষ্টে অনেক ভারতীয়র চেয়ে আমি বেশ আহত হই। ভারত আমার দেশ নয়। আমি দেশপ্রেমিক নই। আমি মানবতায় বিশ্বাস করি। মানবতায় বিশ্বাস করলে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মানুষের জন্য নয়, পৃথিবীর নির্যাতিত যে কোনও মানুষের জন্য তুমি দাঁড়াবে। আফগানিস্তানের, সোমালিয়ার, সৌদি আরবের, সিরিয়ার, পাকিস্তানের, ইয়েমেনের, আমেরিকার মেয়েদের আমি আলাদা করে দেখি না। তাঁরা সবাই আমার চোখে মানুষ, তাঁদের সবারই অধিকার আছে পিতৃতন্ত্রের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীনভাবে বাঁচার, শিরদাঁড়া সোজা করে, শক্ত করে বাঁচার।

    লেখক : নির্বাসিত লেখিকা। সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close