• রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

হালদা নদীতে যে কোনো মুহুর্তে ডিম ছাড়তে পারে কার্পজাতীয় মা মাছ

প্রকাশ:  ০৫ মে ২০২৪, ১৯:৫১
নেজাম উদ্দিন, রাউজান প্রতিনিধি

বঙ্গবন্ধু মৎস্য হ্যারিটেজখ্যাত এশিয়ার অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে কার্পজাতীয় মা মাছের প্রজনন মৌসুম শুরু হয়েছে । এই প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রে প্রজনন মৌসুমে অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে অমাবস্যা ও পূর্ণিমার তিথিতে বজ্রপাতসহ পর্যাপ্ত বৃষ্টির ফলে পাহাড়ী ঢল নেমে পানিতে তীব্র স্রোত সৃষ্টি হলে নদীর উজানে মেজর কার্প জাতীয় রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ মা-মাছ ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার সময় নিষিক্ত ডিম আহরণ করতে হালদাপারের ডিম সংগ্রহকারীদের মাঝে বিরাজ করে উৎসাহ-উদ্দীপনা। সারা দেশজুড়ে বিগত এক মাসের অধিক সময় ধরে তীব্র তাপপ্রবাহের পর গত কয়েকদিনে স্বস্তির বৃষ্টিতে মা মাছের ডিম ছাড়ার একটা সম্ভাবনা বিরাজ করছে।

ফলে প্রজনন মৌসুমকে ঘিরে ব্যস্ত সময় পার করছেন হালদা নদীর ডিম সংগ্রহকারীরা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে যে কোনো মুহুর্তে নদীতে কার্প জাতীয় মা মাছ পুরোদমে ডিম ছাড়তে পারে তাই ডিম সংগ্রহের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন ডিম সংগ্রহকারীরা।

গত কয়েকদিন ধরে হালদা নদীর আজিমের ঘাটসহ কয়েকটি পয়েন্টে ঘুরে ডিম সংগ্রহকারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পূর্ণ প্রজনন মৌসুমে নদীর আজিমেরঘাটসহ বেশ কিছু স্থানে মা মাছের আনাগোনা দেখা গেছে । বজ্রসহ বৃষ্টির ফলে পাহাড়ি ঢল সৃষ্টি হলে নদীতে মা মাছ ডিম ছাড়বে। ডিম সংগ্রহ করতে জাল, নৌকা, নোঙ্গর নিয়ে হালদা নদীসহ শাখা খালসমূহে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছেন ডিম সংগ্রহকারীরা।

স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারী সাধন জলদাশ, বাচা, সুখন দাশ জানান, কয়েকদিন বৃষ্টিপাত হওয়ায় নদীতে ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ তৈরী হচ্ছে। ভারী বৃষ্টি আর বজ্রপাতে পাহাড়ি ঢল নামলে মা মাছ ডিম ছাড়বে। তাই নৌকা, জাল নিয়ে তারা অপেক্ষায় আছেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, হালদা নদীর

রাউজান অংশে সরকারি তিনটি হ্যাচারির মধ্যে

দুটো সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হওয়ায় কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হ্যাচারিগুলোর কোনো সুফল পাচ্ছেননা ডিম আহরণকারীরা। যার ফলে ডিম নষ্ট হওয়ার আশংকার পরও মান্ধাতা আমলের মাঠির কুয়ার উপর নির্ভর থাকতে হচ্ছে বেশীরভাগ ডিম সংগ্রহকারীদের। ইতিমধ্যে মাটির কুয়া ও পাকা কুয়াগুলো সংস্কার করে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

হালদা নদীর ডিম সংগ্রহকারী রোসাঙ্গীর আলম বলেন, কাগতিয়া হ্যাচারি সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হওয়ার কারণে মান্ধাতার আমলের মাটির কুয়ায় সংগৃহীত ডিম রাখতে হবে। তাই মাটির কুয়া সংস্কার করে রেখেছেন।

উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১৮ মে দিবাগত রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে নদীতে পুরোদমে মা মাছ ডিম ছাড়ার পর তিন শতাধিক নৌকাযোগে ছয় শতাধিক ডিম সংগ্রহকারী নদীর আমতুয়া, নাপিতের ঘাট, আজিমের ঘাট, সোনাইমুখ, অংকুরিঘোনা পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে ১৪ হাজার ৬৬৪ কেজি ডিম সংগ্রহ করে। আহরিত ডিম থেকে ৪৩৬.৯৩কেজি রেণু উৎপাদিত হয়।

রাউজান উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, চলতি বছরে মা মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুম শুরু হওয়ায় সার্বিক প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম জোরদার করেছে উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা মৎস্য অফিস। ইতিমধ্যে হালদা নদীর মা মাছ রক্ষায় নদীতে নিয়মিত ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বিগত বছরের চাইতে বেশি পরিমাণ ডিম সংগ্রহের সম্ভাবনা আছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

হালদা গবেষক, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের

বিভাগীয় প্রধান ড.মো. শফিকুল ইসলাম বলেন,

জলবায়ু পরিবর্তন ও মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের নেতিবাচক প্রভাবে বিগত কয়েক বছর হালদা থেকে সংগৃহীত ডিমের পরিমাণ ব্যাপকহারে কমেছে। হালদার জলজ বাস্তুতন্ত্র মা মাছের ডিম ছাড়ার উপযোগী কিনা জানতে গত ১লা মে বুধবার হালদা নদীর স্পনিং গ্রাউন্ড সাত্তারঘাট থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত বিভিন্ন অংশ থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে সরাসরি হালদা নদীতে ও বাসার নিজস্ব হালদা ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখা যায় পানির বিভিন্ন ভৌত ও রাসায়নিক প্যারামিটারের (দ্রবীভুত অক্সিজেন, পিএইচ, কার্বনডাই-অক্সাইড, ক্যালসিয়াম, ট্র্যান্সপারেন্সি, টিডিএস, ইলেকট্রিক্যাল কনডাকটিভিটি, লবণাক্ততা, খরতা, ও ক্ষারকত্ব ইত্যাদি) আদর্শ মানের মধ্যে রয়েছে।

তবে কার্পজাতীয় মাছের প্রজননের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার পানির তাপমাত্রা আদর্শ মান: ২০-৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে ৩ ডিগ্রী বেড়ে ৩৩ ডিগ্রীতে উন্নীত হয়েছে। মেজর কার্প জাতীয় মাছের প্রজনন আচরণ পানির তাপমাত্রার সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। মেজর কার্পজাতীয় মাছের জন্য অত্যানুকুল পানির তাপমাত্রা হচ্ছে (২২-৩০) ডিগ্রী সেলসিয়াস তবে এরা অল্প সময়ের জন্য সর্বোচ্চ ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। বৃষ্টিপাত হলে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট এই তাপমাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে৷ যদি পরিবেশ অনুকুলে থাকে অর্থাৎ বজ্রপাতসহ পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢল নেমে আসে তাহলে চলতি মাসের অমাবস্যার জোঁ (০৬মে - ১০মে) অথবা পূর্ণিমার জোঁ'তে (২০ মে- ২৫মে) হালদা নদীতে মেজর কার্পজাতীয় মা মাছের ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

সচেতন মহলের মতে, হালদা নদীতে প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদকে ঘিরে যে বিপুল সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে সেগুলোকে যথাযথ ও বাস্তবমূখী পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগানো হলে হালদার মৎস্য সম্পদ রক্ষার পাশাপাশি এই নদীর মৎস্য সম্পদ জাতীয় অর্থনীতিতে রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

হালদা নদী,মা মাছ

সারাদেশ

অনুসন্ধান করুন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close