• বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

ট্রেনে অসুস্থ্য গর্ভবতী নারীর সাহায্যে এগিয়ে গেলেন চিকিৎসক-যাত্রী

প্রকাশ:  ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২৩:৩৯
পাবনা প্রতিনিধি

মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন চিকিৎসক, নার্সসহ একদল মানুষ। ট্রেনের মধ্যে অসুস্থ্য হয়ে পড়া এক গর্ভবর্তী নারীর পাশে দাঁড়ালেন হাতে হাত রেখে। আর তাতে ট্রেনের মধ্যেই সেই নারী অনেকটাই সুস্থ্য হয়ে ওঠেন। তিনি অন্ত:স্বত্তা ছিলেন এবং ট্রেনের মধ্যে রক্তপাত হয়ে তার গর্ভে থাকা চারমাসের নবজাতক মারা যায়। এমন পরিস্থিতিতে তার পাশে দাঁড়ান ট্রেনের যাত্রীরা।

ঢাকা-চিলাহাটীগামী আন্তঃনগর চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনে রবিবার (৩ সেপ্টেম্বর) রাতে এ ঘটনা ঘটে। ট্রেনের মধ্যেই ওই নারীর মৃত বাচ্চা প্রসব করান ট্রেনে থাকা চিকিৎসক ও নার্সরা। ট্রেনের কামরা হয়ে যায় অপারেশন থিয়েটার। এ যেন সিনেমার কাহিনীর বাস্তব চিত্র।

সম্পর্কিত খবর

    ওই ট্রেনে দায়িত্বরত পার্বতীপুর হেডকোয়ার্টারের টিটিই আমিরুল হক জাহেদী বলেন, ট্রেনটি ঢাকা থেকে চিলাহাটী যাচ্ছিল। বরাবরের মতোই ট্রেনের পিছনের কোচ থেকে টিকিট চেকিং শুরু করি। সাথে ছিলেন আরেক টিটিই বেলাল হোসেন। রাত আটটা নাগাদ ট্রেনটি তখন গাজীপুরের মহেড়া স্টেশন পার হচ্ছিল। টিকিট চেক করতে ট্রেনের জ নাম্বার কোচে যাবার পর হঠাৎ করে শাহিন আলম নামের এক যাত্রী জানান ঘ নাম্বার কোচে একজন গর্ভবতী মহিলা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

    সাথে সাথে আমার পেছনে থাকা গার্ড সিফাত হোসেনকে জানাই দ্রুত পিএ অপারেটরকে ট্রেনের মাইকে একটা ঘোষণা করতে যে ‘ট্রেনের মধ্যে যদি কোন ডাক্তার থাকেন তাহলে জরুরী ভিত্তিতে ঘ কোচে তাকে বিশেষ প্রয়োজন, একজন গর্ভবতী মা ভীষণ অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন।’ মাইকিং করার পর একজন ডাক্তারকে (ঢাকার ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সানাউল্লাহ) জ কোচ থেকে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। এরপর চ কোচ থেকে ৫ম বর্ষের একজন শিক্ষানবিশ মহিলা ডাক্তারও (রংপুর কমিউনিটি হাসপাতালের ৫ম বর্ষের শিক্ষার্থী ডা. আফসানা ইসলাম রোজা) আসলেন। মাইকিং শুনে দু’জন নার্সও দ্রুত ঘ কোচে ছুটে গেলেন।

    এরপর চিকিৎসক গর্ভবতী ওই নারীর রক্তপাত দেখে জরুরীভাবে হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। এর মধ্যে ৯৯৯-এ কল দিলেন এক যাত্রী। সিদ্ধান্ত হলো টাঙ্গাইল স্টেশনে ট্রেন থামানো হবে। ভাগ্য সহায় হলো চিলাহাটি এক্সপ্রেসের ক্রচিং পড়েছে সেখানে। ৯৯৯ থেকে অ্যাম্বুলেন্সের নম্বর দেয়া হলো। অ্যাম্বুলেন্সের চালকের সাথে কথা হলো, তারাও রেডি।

    এদিকে গর্ভবর্তী মহিলা যাত্রীর রক্তপাত যেন থামছেই না, গর্ভে থাকা চারমাসের নবজাতক গর্ভেই মারা গেলো। মহিলা ডাক্তার, নার্সরা ওই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে কাজ করে যাচ্ছিলেন। ঘ কোচের মহিলা যাত্রীরা নিজেদের কাছে থাকা কাপড় দিয়ে ঘিরে রেখেছিলেন পুরো জায়গাটা। তিন আসনের চেয়ারের সারিটা যেন সেই মুহূর্তে হয়ে যায় অপারেশন থিয়েটার।

    এদিকে ওই নারীর স্বামী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। একজন যাত্রী জানান তার পকেটে মাত্র ১২০০ টাকার মতো আছে। তাৎক্ষণিক সব যাত্রীরা যে যার মতো টাকা সংগ্রহ করা শুরু করলেন। প্রায় ৫ হাজারের মতো টাকা রোগীর স্বামীর হাতে তুলে দেয়া হলো।

    টিটিই আমিরুল হক জাহেদী বলেন, আল্লাহর রহমতে ওই নারীর মৃত বাচ্চাটিকে বের করে ফেলা হলো ডাক্তার-নার্স সহ সবার সহযোগীতায়। ডা. সানাউল্লাহ সবাইকে আশ্বস্ত করলেন, রোগী এখন অনেকটা আশংকামুক্ত। কিন্তু রক্তপাত বন্ধ করতে হবে। ট্রেনের নারী যাত্রীরা ব্যাগ থেকে কাপড় ও অন্যান্য যাবতীয় জিনিস দিয়ে সহযোগীতা করলেন। রোগীকে স্যালাইন খাওয়াতে হবে। সেই সেলাইন, হেক্সিসল, ডেটল যাত্রীরা যার কাছে যা ছিল তা দিয়ে সাহায্য করলেন। পরে অবশ্য তাকে আর হাসপাতালে নিতে হয়নি।

    সব কিছু যখন অনেকটা স্থিতিশীত, এখন দুশ্চিন্তা শুরু হলো জরুরী ভিত্তিতে কিছু ওষুধ প্রয়োজন। ডাক্তার সাহেব ওষুধ লিখে দিলেন। তখন ঈশ্বরদীর টিটিই আব্দুল আলীম বিশ্বাস মিঠু কে ফোন করে বিস্তারিত জানানো হলো। ঈশ্বরদীতে তখন মুষলধারে বৃষ্টিপাত চলছে। তবুও তিনি মোবাইলে প্রেসক্রিপশন পেয়ে নিজেই ওষুধের দোকানে গিয়ে সব ওষুধ কিনে রিক্সাওয়ালাকে দিয়ে ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশন মাস্টারকে দিয়ে পাঠালেন। পরে ট্রেন স্টেশনে থামলে ওষুধ নিয়ে চিকিৎসকের হাতে পৌঁছে দেয়া হয়। তিনি রোগীর স্বামীকে ওষুধ খাওয়ানোর নিয়ম বুঝিয়ে দেন।

    পরে রাত সাড়ে তিনটা নাগাদ ওই নারী ও তার স্বামী দিনাজপুরের ফুলবাড়ি স্টেশনে নামেন। আর চিকিৎসক সানাউল্লাহ সারাটা রাত, সারাটা পথ ওই রোগীর পাশে বসেছিলেন। চিকিৎসকের সাথে সহযোগিতা করেন শিক্ষানবিস চিকিৎসক আফসানা ইসলাম রোজা, নার্স ফারজানা আক্তার, মুন্নি খাতুন, নার্সিং ইন্ট্রাক্টর রেবেকা সুলতানা, খাদিজা খাতুন নিশা, রুমি ইসলাম। এভাবেই একদল মানবিক মানুষের সহযোগিতায় বেঁচে যান একজন নারী।

    এ বিষয়ে টিটিই আমিরুল হক জাহেদী বলেন, ‘আমার চাকরী জীবনে ট্রেনের মধ্যে বেশকিছু মানবিক ঘটনা দেখেছি। তবে এই ঘটনাটি অভূতপূর্ব। ট্রেনের মাইকে ঘোষণা শুনে ডাক্তার, নার্স সহ অন্যরা যেভাবে একজন অসুস্থ্য নারীর পাশে সহযোগিতা বাড়িয়ে দিলেন তা অনন্য। স্যালুট জানাই ওইসকল মানবিক মানুষদের।’

    ডা. সানাউল্লাহ বলেন, ‘আমার বাড়ি দিনাজপুরে। গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলাম। ট্রেনের মধ্যে মাইকে ঘোষণা শুনে একজন চিকিৎসক হিসেবে বসে থাকতে পারিনি। যদিও ট্রেনের মধ্যে কাজটি ঝুঁকিপূর্ন ছিল। ঢাল-তলোয়ার কিছু ছিল না, যেকারণে চ্যালেঞ্জ ছিল। তার মধ্যেই সবার সহযোগিতায় নারীর প্রসব করানো সম্ভব হয় এবং তিনি বেঁচে যান। বড় কোনো বিপদ হয়নি। আমরা প্রথমে টাঙ্গাইল স্টেশনে অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে পাঠানো পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু পরে দেখলাম তিনি স্বাভাবিক আছেন। এ যেন সিনেমার কাহিনীর মতো। আমার জীবনে একটি অনন্য ঘটনার স্বাক্ষী হলাম।’

    সারাদেশ

    অনুসন্ধান করুন
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close