• শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

আত্মহত্যার হুমকি মৎস্যজীবীদের

দুই মাসেও ঝিনাইদহের বলুহর বাঁওড় বুঝে পাননি মৎস্যজীবীরা

প্রকাশ:  ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৮:৪৩
অনলাইন ডেস্ক

ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর বলুহর বাঁওড় কয়েক দশক ধরে মৎস্যজীবি সমিতির নামে একটি মহল ভোগ দখল করে আসছে। এতে প্রকৃত হালদার সম্প্রদায়ের শত শত মৎসজীবিরা জলমহাল থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ‘জাল যার জলা তার’ নীতিতে মাছ চাষ হলেও প্রায় ৪০ বছর কয়েকশত মৎসজীবি পরিবারকে বলুহর বাওড়ের জলার ধারে কাছেও ভিড়তে দেয়নি ওই মহলটি। নানা দুর্নীতি ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় ২০২২ সালের ২০ মার্চ সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বাঁওড়টি মৎস্য বিভাগের কাছে নবায়ন না করে ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলে বিষয়টি সামনে আসে। ১৯৭৯ সাল থেকে ‘জাল যার জলা তার’ সরকারের এমন নীতির উপর ভর করে একটি মহল গুটিকয়েক মৎস্যজীবীদের সামনে দিয়ে বলুহর বাঁওড়টি দখলে রেখেছিলেন। ফলে দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর ধরে বঞ্চিত হয়ে আসছিলেন বাঁওড়পাড়ের পাঁচ শতাধিক জেলে পরিবার।

সম্পর্কিত খবর

    অপরিকল্পিত মৎস্য চাষ, বাঁওড়ের ভূমি বেদখল, বাঁওড় ম্যানেজার ও হ্যাচারীর সহকারী ম্যানেজারের দুর্নীতির কারণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ায় সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসন ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে বাঁওড় ইজারা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেয়ে জেলা প্রশাসন টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু করে। বলুহর বাঁওড়টি পেতে তিনটি মৎসজীবি সমিতি টেন্ডারে অংশ নেয়। টেন্ডারে অংশ নেওয়া কোটচাঁদপুর মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি ২ কোটি ৩৭ লাখ, বাজেবামনদাহ মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি ১ কোটি ৭০ লাখ এবং বলুহর মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি বাৎসরিক ৬৭ লাখ টাকা দরে ইজারা নেওয়ার জন্য কাগজপত্র জমা দেন।

    এরপর ১৫ ডিসেম্বর কোটচাঁদপুর মৎসজীবি সমবায় সমিতি বাৎসরিক ২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা সর্বোচ্চ দরদাতা হিসাবে কাগজপত্র জমা দেওয়ায় ছয় বছরের জন্য বলুহর বাঁওড়টি মাছ চাষের জন্য ইজারা দিতে সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠায় জেলা প্রশাসন। তবে সর্বোচ্চ দরদাতা কোটচাঁদপুর মৎসজীবি সমবায় সমিতিকে এখনো বাঁওড়টি হস্তান্তর করা হয়নি। এরমধ্যে ৬৭ লাখ টাকা দর জমা দেওয়া বলুহর মৎসজীবি সমিতি দীর্ঘ ৪০ বছর বাঁওড় ম্যানেজারের সাথে যোগসাজস করে ভোগদখল করে আসছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

    সমিতিটি সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থ বছরে মৎস আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ২০০ মেট্রিকটন থাকলে ও তারা অর্জন দেখিয়েছেন মাত্র ৪৫.৪০ মেট্রিক টন। এখান থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৯০ লাখ টাকা থাকলেও তারা সরকারের কোষাগারে জমা দিয়েছেন মাত্র ২০ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। জেলার বাকি চারটি বাঁওড় লক্ষ্যমাত্রার শতভাগ অর্জন করলেও ব্যতিক্রম বলুহর বাওড়টি। তারা অজ্ঞাত কারণে লক্ষ্যমাত্রার ধারে কাছেও যেতে পারেনি। তবে বাঁওড় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাওড় ম্যানেজার ও বলুহর মৎস্যজীবি সমিতির যোগসাজসে লুটপাটের কারণে এমনটি হয়েছে। যদিও এর আগের বছর ২০১৯-২০ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার ৯০ লাখ টাকার শতভাগই অর্জন দেখিয়ে সরকারের কোষাগারে জমা দেন।

    চলতি বছর ইজারার মাধ্যমে বাঁওড় বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্তের ফলে প্রতিবছর এখান থেকে সরকারের কোষাগারে ভ্যাট ও করসহ প্রায় ৩ কোটি টাকা জমা হবে। যা বাঁওড়টির রেকর্ডে সবথেকে বেশি আয়। তবে ইজারা পাওয়া মৎস্যজীবি সমিতির সদস্যরা অভিযোগ করেছেন এতদিন বাঁওড় ভোগদখল করে রাখা চক্রটির ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। সরকারের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় আগামী ছয় বছরের জন্য আমরা পেলেও এখনো বাওড়টি বুঝে পায়নি। ইতোমধ্যে সর্বচ্চ দরদাতা হিসাবে কোটচাঁদপুর মৎস্যজীবি সমিতি ২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা সরকারের কোষাগারে জমাও দিয়েছি। কিন্তু একটি মহলের ষড়যন্ত্রের ফলে সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষ বাঁওড় বুঝিয়ে দিতে গড়িমসি করছে।

    ইজারা পাওয়া মৎস্যজীবি সমিতির সদস্যরা বলছেন, আমরা ঘরের ছাগল গরু বিক্রি করে, বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণসহ বাড়ির সব সম্পদ বেচাকেনা করে ইজারার টাকা জমা দিয়েছি। এখন বাঁওড় বুঝে না পেলে আমাদের আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় থাকবে না।

    মৎস্যজীবীরা জানান, সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঝিনাইদহের পাঁচটি বাওড় রয়েছে। বাওড়গুলো হচ্ছে ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার কাঠগড়া, ফতেপুর, কোটচাঁদপুরের বলুহর, জয়দিয়া ও কালীগঞ্জের মর্জাদ বাঁওড়। এ সব বাঁওড়ের মোট জলাকার হচ্ছে ১১৩৭ হেক্টর। এসব বাওড় এলাকায় ৮০০ পরিবারের প্রায় ৫ হাজার সদস্য বাঁওড় থেকে আয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এরমধ্যে ফতেপুর ও কাঠগড়া বাঁওড়ে ১৫০ জন মৎস্যজীবী, বলুহর ও জয়দিয়া বাঁওড়ে ৪৭২ জন, মর্জাদ বাঁওড়ে ১৪৫ জন ও বেড়গোবিন্দপুর বাঁওড়ে ২১০ জন মৎস্যজীবী মাছ চাষ ও ধরা সমিতির সদস্য।

    কোটচাঁদপুর মৎসজীবি সমবায় সমিতির সদস্য বকুল রানী জানান, আমরা দীর্ঘদিন জলাশয়ের অধিকার থেকে বঞ্চিত। এখন সরকারের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সবকিছু বেচাকেনা করে এবং সুদে ঋণ নিয়ে ইজারার টাকা জমা দিয়েছি। সবথেকে বেশি দরদাতা হিসাবে আমরা বাঁওড়ের ইজারা পেয়েছি। আমরা চাই বাঁওড়টি আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হোক।

    কোটচাঁদপুর মৎসজীবি সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক উত্তম কুমার বিশ্বাস জানান, আমরা হালদার সম্প্রদায়ের প্রকৃত মৎস্যজীবি হলেও দির্ঘ ৪০ বছর হলো একট মহল আমাদের বাঁওড়ের পানিতে নামতে দেয়নি। এখন সরকারের ওপেন টেন্ডারে আমরা সর্বোচ্চ দরদাতা হিসাবে বাঁওড়টি পেয়েছি কিন্তু এখনো বাঁওড় বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। দ্রুত আমাদের বাঁওড়টি বুঝিয়ে দেওয়ার দাবি করেন।

    কোটচাঁদপুর মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি শিতল কুমার মন্ডল জানান, আমরা প্রকৃত মৎসজীবি হলেও একটি মহল হাতে গোনা কয়েকজন মৎস্যজীবিকে সামনে রেখে ভোগদখল করে রেখেছে। তাদের ষড়যন্ত্রে আমরা দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলাম। সম্প্রতি সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের নিদের্শে ওপেন টেন্ডারের আহবান করা হয়। সেখানে আমার কোটচাঁদপুর মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি সর্বোচ্চ দরদাতা হিসাবে বলুহর বাওড়ের ইজারা পায়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আমাদের এখনো বাঁওড় বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। আমরা সমিতির সদস্যদের সহায় সম্বল বিক্রি করে এবং এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ইজারার ২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা জমা দিয়েছি।

    বলুহর মৎসজীবি সমবায় সাধারণ সম্পাদক মহানন্দ হালদার জানান, আমরা টেন্ডারে অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমরা ৬৭ লাখ টাকা বাৎসরিক দর দিয়ে কাগজপত্র জমা দিই। এতে আরো দুইটি সমিতি অংশগ্রহন করে। শুনেছি অন্য একটি সমিতি বেশি দর দেওয়ায় তারা বাঁওড় পেয়ে গেছে। যে কারণে ঝিনাইদহ-৩ আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল আজম খান চঞ্চলের কাছে গিয়েছিলাম। আমাদের এত টাকা নেই। তাই এমপি সাহেবের দিয়ে টেন্ডার প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়েছে। এখন দেখা যাক কি হয়।

    বলুহর বাঁওড়ের ম্যানেজার সিদ্দিকুর রহমানের সাথে এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, বিষয়টি জেলা প্রশাসন দেখছে, এখানে আমি কিছু বলতে পানি না।

    ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মনিরা বেগম জানান, আপনারা জানেন জেলায় ৫টি বাঁওড় রয়েছে। জলমহাল নীতিমালা ২০০৯ অনুযায়ি ২০ একরের বেশি জলমহালগুলো ওপেন টেরন্ডারের মাধ্যমে ইজারা দেওয়ার কাজ সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। উন্নয়ন প্রকল্পের আওতাধীন জলমহালগুলোর টেন্ডার প্রক্রিয়া জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হলে সুপারিশ আকারে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তারপর সেখান থেকে সর্বোচ্চ দরদাতাতে ইজারা দেওয়া হয়। জেলা কোটচাঁদপুর উপজেলার বলুহর বাঁওড়ের টেন্ডার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে সম্পন্ন করে পাঠানো হয়েছে। এখন আমরা ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।

    মৎসজীবি

    সারাদেশ

    অনুসন্ধান করুন
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close