• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

মৃত্যুর পর জীবিত হয়ে সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহণ!

প্রকাশ:  ১৪ অক্টোবর ২০২২, ১৩:৫০
জয়পুরহাট প্রতিনিধি

মৃত্যুর ১১ বছর পর সোনালী ব্যাংকের জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল শাখা থেকে ‘ভূতুড়ে’ ঋণ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ব্যাংকটির ওই শাখা বলছে, পরেশ চন্দ্র নামে ওই ব্যক্তিটি ২০০৫ সালের ৩১ অক্টোবর ঋণ ডকুমেন্টে স্বাক্ষর করে ১০ হাজার টাকা ঋণগ্রহণ করেছিলেন। অথচ ক্ষেতলাল উপজেলার আলমপুর ইউনিয়নের পাঁচুইল গ্রামের বাসিন্দা পরেশ চন্দ্র ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন পরলোকগত হোন।

এর আগেও পাঁচুইল গ্রামের কার্তিক চন্দ্রের ছেলে শ্রী নরেশ চন্দ্রের নামেও ১৫ হাজার টাকার ঋণ পরিশোধে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নোটিশে তার ঋণগ্রহণের তারিখ ২০০৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দেখানো হয়েছে।

যে সময়টাতে ঋণ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেই সময়ে সোনালী ব্যাংকের ওই শাখায় কৃষি ও এমসিডি ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছিল বলে দাবি স্থানীয়দের।

পরেশ চন্দ্রের বাবার নাম কৈলাশ চন্দ্র। পরেশ চন্দ্র দুই ছেলে দুই মেয়ের জনক ছিলেন। বড় ছেলে নরেশ চন্দ্র, ছোট ছেলে পলাশ চন্দ্র, মেয়ে অতীতা বালা ও গৌরি বালা। মৃত পরেশ চন্দ্রের স্ত্রী মাখন বালা এখনও জীবিত রয়েছেন।

সম্প্রতি সোনালী ব্যাংক থেকে পরেশ চন্দ্রের নামে ১০ হাজার টাকা এমসিডি ঋণ পরিশোধের জন্য এক নোটিশ পাঠানো হয়। ডাকযোগে পাঠানো ব্যাংকের রেজিস্ট্রি করা চিঠিটি পরেশ চন্দ্রের বড় ছেলে নরেশ চন্দ্র গ্রহণ করেন। চিঠি খুলে তিনি তার বাবার নামে ব্যাংকের ১০ হাজার টাকার এমসিডি ঋণ পরিশোধের নোটিশ দেখতে পান।

নরেশ চন্দ্র বলেন, নোটিশে একনজর বুলিয়ে ভেবেছিলেন, তার বাবা জীবিত থাকতে হয়তো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। তবে এতদিন পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঋণ পরিশোধের নোটিশ দেওয়ায় তার মনে খটকা লাগে। পরে চিঠির নিচের অংশে গিয়ে দেখেন, ২০০৫ সালের ৩১ অক্টোবর তার বাবা ঋণগ্রহণ করেছেন। অথচ তার বাবা পরেশ চন্দ্র ২৮ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন মারা গেছেন।

এমন অদ্ভুত চিঠি পেয়ে নরেশ ছুটে যান সোনালী ব্যাংকের ক্ষেতলাল শাখায়। তবে ব্যাংকের কর্মকর্তারা নথিপত্র ঘেঁটে জানান, ঋণগ্রহণের তারিখ ঠিক আছে। এ সময় নরেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের বলেন, তার বাবা ২৮ বছর আগে মারা গেছেন। তবে ব্যাংক কর্মকর্তারা তাদের দাবিতে অনড় থাকেন। ব্যাংক কর্মকর্তাদের দাবি, ঋণের নথিতে পরেশ চন্দ্রের নাগরিকত্ব সনদ, ছবি, জমির কাগজপত্র ও স্বাক্ষর—সবই আছে।

নরেশের অভিযোগের বিষয়ে জানতে স্থানীয় আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ও সোনালী ব্যাংকের ক্ষেতলাল শাখায় যান এই প্রতিবেদক। ব্যাংকে রক্ষিত ৩২৮ নম্বর এমসিডি ঋণের নথিপত্রে পরেশ চন্দ্রের নাম রয়েছে। ছবি-নাগরিকত্ব সনদ, জমির কাগজ দিয়ে পরেশ চন্দ্র ঋণ ডকুমেন্টে স্বাক্ষর দিয়ে ১০ হাজার ঋণগ্রহণ করেছেন বলে নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যাংকের পাঠানো নোটিশের সঙ্গে তথ্যের মিল পাওয়া গেছে।

তবে স্থানীয় আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে নরেশের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। আলমপুর ইউনিয়নের ১৯৮৭ সালের ফেরুয়ারি মাসে মৃত্যু রেজিস্টারে ওই মৃত্যু রেজিস্টারের ৩৮ নম্বর পাতার ৪৩ নম্বর সিরিয়ালে পাঁচুল গ্রামের শ্রী পরেশ চন্দ্রের নাম রয়েছে। তার মৃত্যুর তারিখ ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন। তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে বুকের ব্যথার কথা উল্লেখ রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা, ইউপি চেয়ারম্যান, ওয়ার্ডের ইউপি সদস্যরাও জানালেন ১৯৯৪ সালের ওই তারিখে পরেশ চন্দ্রের মারা যাওয়ার কথা। আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ২০২১ সালের ৯ মার্চ মাসে নরেশ চন্দ্রকে তার বাবার মৃত্যুর সনদ দেওয়া হয়েছে। তাতেও তার মৃত্যুর তারিখ ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন উল্লেখ রয়েছে।

নরেশ চন্দ্র বলেন, দশ হাজার টাকা বড় কথা নয়। আমার বাবা মৃত্যুর ১১ বছর পর কীভাবে ব্যাংকে গিয়ে ঋণগ্রহণ করলেন তাতে আমরা আশ্চর্য হয়েছি। আমার বাবা মৃত পরেশ চন্দের ১২-১৪ বিঘা জমি রয়েছে। আমার বাবা জীবিত থাকা অবস্থায়ও কোনো ঋণ নেননি বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। আমরা আগে কখনও আমার বাবার নামে থাকা ঋণ পরিশোধের নোটিশ পাইনি।

আলমপুর ইউপি সদস্য আব্দুল হালিম জানান, আমার ওয়ার্ডের পাঁচুইল গ্রামের পরেশ চন্দ্র ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন মারা গেছেন। সেই ব্যক্তি ২০০৫ সালে সোনালী ব্যাংক থেকে কীভাবে দশ হাজার টাকা নিলেন তা জেনে হতবাক হয়েছেন।

সোনালী ব্যাংকের ক্ষেতলাল শাখায় সেই সময় কৃষি ও এমসিডি ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছিল দাবি করে তিনি জানান, পাঁচুইল গ্রামের কার্তিক চন্দ্রের ছেলে শ্রী নরেশ চন্দ্রের নামেও ১৫ হাজার টাকার ঋণ পরিশোধে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নোটিশে তার ঋণগ্রহণের তারিখ ২০০৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দেখানো হয়েছে।

আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আনোয়ারুজ্জামান তালুকদার নাদিম জানান, পাঁচুইল গ্রামের পরেশ চন্দ্রের মৃত্যুর তারিখ ইউপি কার্যালয়ের মৃত্যু রেজিস্টারে উল্লেখ রয়েছে। ইউপি কার্যালয় থেকে পরেশ চন্দ্রের মৃত্যুর সনদ দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুর ১১ বছর পর কীভাবে ব্যাংক ঋণ পেলেন তা জেনে খুবই আশ্চর্য হয়েছি। ক্ষেতলাল সোনালী ব্যাংকে এক সময় কৃষি ও এমসিডি ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছিল। তখন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছিল বলে জানিয়েছেন তিনি।

সোনালী ব্যাংক ক্ষেতলাল শাখার একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০০৪ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রায় চার কোটি টাকার কৃষি, এমসিডি ঋণ দেওয়া হয়েছিল। এরই ৮০ শতাংশ অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ দেওয়া হয়েছে। সেই সময়কার ব্যাংকের কয়েক জন কর্মকর্তার ওপর এসব ঋণের দায় বর্তানো হয়েছে। এরমধ্য কয়েক জন কর্মকর্তা অবসরে গেছেন। ঋণ অনাদায়ী থাকায় তাদের কারও ১৬ লাখ, ৯ লাখ, ২৭ লাখসহ বিভিন্ন অংকের টাকা ব্যাংক কেটে নেওয়া হয়েছে।

সোনালী ব্যাংক ক্ষেতলাল শাখার ব্যবস্থাপক সিনিয়র প্রিন্সিপাল কর্মকর্তা মো. আহসান হাবিব জানান, ব্যাংকে রক্ষিত ঋণ ডকুমেন্টে দেখা গেছে, উপজেলার পাঁচুইল গ্রামের শ্রী পরেশ চন্দ্র ২০০৫ সালে কাগজপত্র ও স্বাক্ষর দিয়ে ব্যাংক ঋণ নিয়েছেন। ঋণটি পরিশোধ হয়নি। এখন ঋণটি শ্রেণিকৃত হয়েছে। একারণে ঋণের আসল টাকা পরিশোধের জন্য নোটিশ করা হয়েছে।

মারা যাওয়া ব্যক্তি কীভাবে ঋণ নিলেন এমন প্রশ্নে তিনি জানান, তখন এখানে শাখা ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে ছিলাম না। এ কারণে সেটি আমার জানার কথাও নয়।

ঋণগ্রহণ,মৃত্যু,জীবিত,সোনালী ব্যাংক

সারাদেশ

অনুসন্ধান করুন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close