• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

পরিত্যক্ত রোপওয়ে, কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি

প্রকাশ:  ২২ আগস্ট ২০২২, ১৭:১৩
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি

দীর্ঘ প্রায় ৯ বছর ধরে পরিত্যক্ত রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম ছাতক-ভোলাগঞ্জে রোপওয়ে বা রজ্জুপথ। অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে সরকারি কোটি কোটি টাকার সম্পদ। এ অবস্থায় এটিকে সংস্কার ও ক্যাবল কার স্থাপনের মাধ্যমে পর্যটনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হলে তা খুবই লাভজনক হবে বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় বিশিষ্টজনরা।

জানা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের আওতাধীন ছাতক-ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও অবহেলায় দীর্ঘদিন থেকে অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। এলাকাটি সংরক্ষিত হলেও রাতের আঁধারে পাথর চুরির কারণে এটি বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট তথ্যমতে, ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে লাভজনক এ রজ্জুপথ বন্ধ রয়েছে। ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রোপওয়ের ট্রেসেল (খুঁটি) সংখ্যা ১২০টি। স্টেশন চারটি (ছাতক, অ্যাংগেল এক, অ্যাংগেল দুই ও ভোলাগঞ্জ)। বাকেট সংখ্যা ৪২৫টি। ডিসেম্বর ২০১৩ পর্যন্ত চালু ছিল ২৪৬টি বাকেট। প্রতি বাকেটের ধারণক্ষমতা ১২.৯২ ঘন ফুট (৬০০ কেজি)। রোপওয়েটির বার্ষিক পাথর পরিবহন ক্ষমতা ছিল প্রায় ১২ লাখ ঘন ফুট। বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অযত্নে-অবহেলায় বিভিন্ন স্থানে রোপওয়ের কিছু ট্রেসেল হেলে পড়েছে। তার ছিঁড়ে একাধিক বাকেটও পড়ে রয়েছে মাটিতে।

এ ব্যাপারে সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক বলেন, ছাতকের ঐতিয্যবাহী ছাতক-ভোলাগঞ্জের রোপওয়ে দীর্ঘদিন যাবত অযত্নে বন্ধ রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, ছাতকের প্রাইম সিমেন্ট কোম্পানি লি. কর্তৃপক্ষ পাথর পরিবহনের জন্য ২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর ভোলাগঞ্জ রোপওয়ের যন্ত্রপাতি ও পাথর কোয়ারির জমিসহ ৫০ বছরের জন্য লিজ নেয়ার আবেদন করে বাংলাদেশ রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ এতে ইতিবাচক সাড়া দেয়নি।

সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও দৈনিক উত্তরপূর্ব পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক তাপস দাশ পুরকায়স্থ বলেন, আমাদের ছাতকের ঐতিয্যের প্রতীকী ছিল ছাতক-ভোলাগঞ্জের রোপওয়ে। দীর্ঘদিন যাবৎ অবহেলা আর অযত্নে নষ্ট হচ্ছে সরকারের কোটি কোটি টাকা। এটাকে সংস্কার করে তা পর্যটনের কাজে ব্যবহার করলে সরকারের পাশি ছাতকের মানুষ জনের বিকল্প একটা আয়ের দ্বার উন্মুক্ত হতো।

স্থানীয় নাগরিকরা জানায়, সর্বনিম্ন ২০ ফুট থেকে ১৬৭ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন ট্রেসেলের ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ক্যাবল কারে নদী, টিলা ও হাওরের ওপর দিয়ে সাদা পাথর ভ্রমণ ও মেঘালয়ের নীল পাহাড়ের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করা যাবে। তারা বলেন, ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে সাদা পাথর ও ভোলাগঞ্জ বর্ডার হাটের একেবারে লাগোয়া অবস্থিত। এর ফলে সুনামগঞ্জ-ছাতকসহ দেশ-বিদেশি পর্যটকদের সাদাপাথর ঘুরে দেখার আগ্রহ সৃষ্টি হবে। শিল্পনগরী ছাতকের ব্যবসায়ীরাও সহজে ভোলাগঞ্জে যাতায়াত করতে পারবেন। এর মাধ্যমে সরকার বিপুল রাজস্ব আয় করতে পারবে।

ছাতক প্রেসক্লাব সভাপতি সৈয়দ হারুন অর রশীদ বলেন, অকেজো রোপওয়েটিকে সংস্কার করে তা পর্যটনের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। তারা বলেছেন, রোপওয়েটিকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো ক্যাবল কার স্থাপন করা যেতে পারে। তারা বলেছেন, ভোলাগঞ্জ সাদর পাথর পর্যটন কেন্দ্র দেখার জন্য প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক লোক ভিড় করেন।

ছাতক সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মঈন উদ্দিন আহমদ, ছাতক চুনাপাথর আমদানিকারক ও সরবরাহ গ্রুপের সভাপতি আহমদ শাখাওয়াত সেলিম চৌধুরী, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সৌমেন কুমার দে, বালু-পাথর ব্যাবসায়ী মো: বাবলু মিয়া,কোম্পানীগঞ্জ প্রেসক্লাব সেক্রেটারি আবিদুর রহমান ও সিলেটস্থ ছাতক সমিতির সাবেক সেক্রেটারি আফজাল হোসেন বলেন, অযত্নে-অবহেলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সরকারি বিপুল অর্থের সম্পদ। ছাতক-ভোলাগঞ্জ রোপওয়েকে পর্যটন খাতে ব্যবহার করা গেলে এটি হবে অপার সম্ভবনাময় ও লাভজনক। এ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি দেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের এগিয়ে আসতে হবে।

প্রসঙ্গত, ভারতের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে নেমে আসা ধলাই নদীর সাথে প্রতি বছর বর্ষাকালে নেমে আসে প্রচুর পাথর। ধলাই নদীর তলদেশেও রয়েছে পাথরের বিপুল মজুত। এই পাথর দিয়ে ৫০ বছর চালানো যাবে- এই হিসাব ধরে ১৯৬৪-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সময়কালে সোয়া ২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে প্রকল্প। ব্রিটিশ রোপওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পের আওতায় ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত সোয়া ১১ মাইল দীর্ঘ রোপওয়ের জন্য নির্মাণ করা হয় ১২০টি টাওয়ার এক্সক্যাভেশন প্ল্যান্ট। মধ্যখানে চারটি সাব স্টেশন-যেগুলো স্থানীয়ভাবে ‘এঙ্গেল’ নামে পরিচিত। দুই প্রান্তে ডিজেলচালিত দুটি ইলেকট্রিক পাওয়ার হাউস, ভোলাগঞ্জে রেলওয়ে কলোনী, স্কুল, মসজিদ ও রেস্ট হাউস নির্মাণও প্রকল্পের আওতাভুক্ত ছিল। একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত রোপওয়েটিকে পুনরায় সংস্থার করা হয়। এক্সক্যাভেশন প্ল্যান্টের সাহায্যে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাথর উত্তোলন করা হলেও বর্তমানে এ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। এলাকাটি দেখতে অনেকটা ব-দ্বীপের মতো। ভারতের ওমঘাট নদী বাংলাদেশে ধলাই নামে প্রবেশ করে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে প্ল্যান্টের চারপাশ ঘুরে আবার একীভূত হয়েছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সদরের কাছে ধলাই নদী মিলিত হয়েছে- পিয়াইন নদীর সাথে। যে কারণে এ স্থাপনাটি পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণীয়।

ছাতকের বাংলাদেশ রেলওয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার জুবায়ের হোসেন সরকার দীর্ঘদিন থেকে রজ্জুপথটি বন্ধ থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, এটি সংস্কারের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবেন। অপর এক প্রশ্নের জবাবে এ কর্মকর্তা বলেন, তিনি ছাতকে নতুন যোগদান করেছেন। কাজেই, এ সংক্রান্ত সামগ্রিক বিষয়টি তার জানা নেই।

পূর্বপশ্চিমবিডি/শংকর/এআই

সুনামগঞ্জ,পরিত্যক্ত রোপওয়ে

সারাদেশ

অনুসন্ধান করুন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close