• রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

সংসারে হাসি ফোটাতে বিদেশে গিয়ে ফিরছেন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে

প্রকাশ:  ২২ মার্চ ২০২৪, ১৪:২৮
নিজস্ব প্রতিবেদক

সোনিয়া আক্তার। গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন। স্বামীর ফেলে রাখা সন্তানকে নিয়ে অভাবে দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। সোনিয়া স্বপ্ন দেখতেন একটু স্বচ্ছল জীবনযাপনের। এর মধ্যেই এক পরিচিতজনের মাধ্যমে জানতে পারেন সৌদি আরবে অল্প খরচে নারী কর্মী নেওয়ার খবর। তিনিও ভিড়লেন সে দলে। কষ্টে জমানো ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে দালালের মাধ্যমে উড়াল দিলেন সৌদে আরবে। পাঁচ মাসের ব্যবধানে ধূসর হলো তার স্বচ্ছল জীবনের স্বপ্ন। নিপীড়ন-নির্যাতন শিকার সোনিয়া গত ২০ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরলেন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে।

তাকে দেখতে যখন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালে যাওয়া হলো, তখন শুরুতেই সতর্ক করলেন কর্তব্যরত নার্স। জানালেন কাউকে দেখলেই তার দিকে তেড়ে যাচ্ছেন সোনিয়া আক্তার। বলছেন, ‘'তুই খারাপ, তুই আমার খাবার দিস নাই, তোরে পুলিশে দিমু।’’ থুতু দেওয়ার ভয়ও দেখাচ্ছেন। সোনিয়ার ভাই শরিফুল ইসলাম তার কাছে গেলেই দু-চারটা চড়থাপ্পড় মারছেন। পাশ থেকে সোনিয়ার বৃদ্ধ মা তার নাকে মেয়ের দেওয়া খামচির দাগ দেখিয়ে বলেন, ‘‘সারাক্ষণ জানের ভয়ে থাকতে হয়, নিজের পেটের মাইয়্যা, ফালাইয়া তো দিতে পারি না।’’

শুধু সোনিয়া নয়, বিগত কয়েক বছর যাবত স্রোতের মতো হাজারো নারী শ্রমিক মানসিক, শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরেছেন দেশে।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন কারণে সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ২,৯০২ জন নারী শ্রমিক ফেরত এসেছেন। সর্বশেষ ডিসেম্বরেও ফিরেছেন ২৪৯ জন নারী। এর মধ্যে অন্তত তিনজন নারী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায়। ১৯৯১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় সাত লাখ নারী কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে দুই লাখই গেছেন সৌদি আরবে। নির্মমতার মুখে ২০২৪ সালে প্রতি মাসে গড়ে ২০০ করে নারী শ্রমিক সৌদি থেকে দেশে ফিরছেন। তারপরও ১০ মার্চ পর্যন্ত বিগত পাঁচ মাসে সৌদিতে ৩০ হাজার নারী গৃহশ্রমিক পাঠিয়েছে বিভিন্ন অ্যাজেন্সি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সৌদি আরবে বেশিসংখ্যক নারী শ্রমিক যাচ্ছেন বলে এ দেশটি থেকেই বেশিসংখ্যক ফেরত এসেছেন। তবে মোট কতজন নারী মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় দেশে ফিরেছেন, সে বিষয়ে সরকারি কোনো তথ্য নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারী শ্রমিকদের সৌদি আরবে পাঠানো হয় দুই বছর চুক্তিতে। এই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সৌদি আরব থেকে নারী শ্রমিক ফেরত এলে বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ওই দেশের মালিককে আরেকজন নারী শ্রমিক পাঠাতে হয়। তা না হলে নারী শ্রমিক নেওয়ার জন্য মালিক যে টাকা দিয়েছিলেন, তা পরিশোধ করতে হয়। ফলে নারী শ্রমিকেরা কোনো বিপদে পড়লে তখন আর রিক্রুটিং অ্যাজেন্সিকে পাশে পাওয়া যায় না। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও এখন পর্যন্ত বিপর্যস্ত হয়ে ফেরত আসা নারী শ্রমিকদের জন্য শেল্টার হোম বা তেমন কোনো পুনর্বাসন উদ্যোগ নেই।

দেশে ফিরে আসা অভিবাসী নারী শ্রমিকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে একটি গবেষণা করেছিল বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)। ২০২১ সালে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫৫% নারী শ্রমিক শারীরিকভাবে অসুস্থ, ২৯ শতাংশের মানসিক অসুস্থতা রয়েছে, ৮৫ শতাংশ নারী শ্রমিক মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় দিন পার করছেন। ৮৭% শ্রমিক মানসিক অসুস্থতার কোনো চিকিৎসা পাননি। এই নারীরা সামাজিকভাবেও হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছেন। চট্টগ্রাম, যশোর ও ফরিদপুরের ৩২৩ জন ফেরত আসা অভিবাসী নারী শ্রমিকের ওপর জরিপ চালিয়েছিল সংস্থাটি। জরিপ বলছে, ৬১% নারী বিদেশে খাদ্য ও পানির অভাবে ভুগেছেন, ৭ শতাংশ যৌন এবং ৩৮ % শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

বিদেশগামী এবং বিদেশ থেকে ফেরত আসা কর্মীদের জন্য সাময়িক আবাসস্থল তৈরি করেছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। ২০২২ সালের ১৮ মার্চ হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টার নামের এ কেন্দ্র চালু করা হয়। নারী কর্মীরা সেখানে স্বল্পমূল্যে থাকা-খাওয়াসহ বিভিন্ন সুবিধা পাচ্ছেন। তবে তা সাময়িক।

মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় যেসব নারী ফিরছেন তাদের সমাজে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি কর্মসূচি হাতে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘‘নির্যাতনসহ বিভিন্ন কারণে ফেরত আসা কর্মীদের কার কী প্রয়োজন, সেভাবে আলাদা করে সরকারের কোনো কর্মসূচি বা কৌশল নেই। দেশে সার্বিকভাবেই নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি অবহেলিত। বিদেশ থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে ফেরত আসাদের বেলায় এটি আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে।’’

তিনি বলেন, ‘‘নির্যাতনের কারণে দেশে ফিরে আসা নারী গৃহশ্রমিক দিনে দিনে বাড়ছে। তারা যে নির্যারতনের শিকার হচ্ছে না তা কে বলতে পারে! তবে এখন পর্যন্ত সৌদি আরবে ঘটা একটি নির্যাতনেরও বিচারের ব্যবস্থা করতে পারেনি বাংলাদেশ। ফলে সৌদি সরকার হয়তো ধরেই নিয়েছে আমাদের গৃহ শ্রমিকদের নির্যাতন করাই যায়।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘আমাদের উচিত সৌদি আরবে গৃহ শ্রমিক হিসেবে নারীদের পাঠানো এখনই বন্ধ করা। জর্ডান, লেবানন, কাতারসহ বিভিন্ন দেশে গার্মেন্টস শ্রমিক হিসেবে নারীদের পাঠানো যেতে পারে। এ দেশগুলোতে নারী শ্রমিকরা অপেক্ষাকৃত ভালো রয়েছে।’’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘এখানে আসা বেশিরভাগ প্রবাসীর সমস্যা হচ্ছে- শারীরিক নির্যাতন আর তীব্র মানসিক চাপ। মেডিকেলে একে বলা হয় ‘ব্রিফ সাইকোসিস্ট’। যেসব রোগী আমরা পাচ্ছি-তারা বেশিরভাগই তীব্র মানসিক চাপের ওপর ছিল। ফিজিক্যাল যে অ্যাবিউজগুলো দেখা গেছে, বেশিরভাগের খুব সিগনিফিকেন্ট নয়। মানসিক চাপটা অত্যন্ত বেশি থাকে। মানসিকভাবে একটা ভীতি, উৎকণ্ঠা, ত্রাস, আতঙ্কের মাঝে দিন কাটাতেন-বেশিরভাগ কর্মীই এমনটা জানিয়েছেন। এসব দীর্ঘদিন চললে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়। একসময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তারা।”

তিনি আরও বলেন, ‘‘নারীরা বিদেশ যাওয়ার আগেই ওই দেশটির ভাষা, খাদ্যাভ্যাসসহ সার্বিক ধারণা নিয়ে গেলে, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে কীভাবে ভালো থাকবেন, মানিয়ে চলবেন অর্থাৎ তাদের মানসিক সক্ষমতা বাড়িয়ে পাঠানো গেলে এ সমস্যাটা কমে আসবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবপক্ষগুলোকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।’’

সূত্র- ঢাকা ট্রিবিউন

অভিবাসন,প্রবাসী
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close