• শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ১২ বছর: বিচারের অন্তহীন অপেক্ষা

প্রকাশ:  ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৯:১৩
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যার ১২ বছর রবিবার। একযুগ কেটে গেলেও এখনও তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বা অপরাধের পেছনের উদ্দেশ্য উদঘাটন করতে পারেনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।

এ পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ১০৫ বারের মতো সময় নিয়েছে বিভিন্ন তদন্ত সংস্থা। এ নিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে।

স্বজনদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাবে মামলার কার্যক্রম আটকে আছে। তাদের মতে, সরকার প্রচেষ্টায় “আন্তরিক” না হলে তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন করেও লাভ নেই।

সর্বশেষ গত ২৩ জানুয়ারি মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য তারিখ ধার্য ছিল। কিন্তু ওই দিনও তদন্ত সংস্থা র‌্যাব প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেননি।

এ জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শফি উদ্দিনের আদালত আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন।

সাংবাদিক দম্পতির পরিবারের সদস্যদেরও দাবি, বারবার বিলম্বের মধ্যে তদন্ত সংস্থার ব্যর্থতা স্পষ্ট।

কি বলছে পরিবার

ছেলে হত্যার বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির। তিনি বলেন, “আমি এখন পর্যন্ত আমার ছেলের হত্যাকারী কে সেটাই জানতে পারলাম না। আমার মৃত্যু হওয়ার আগ পর্যন্ত ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে যাবো। আমার ছেলেকে তো আর ফেরত পাবো না, কিন্তু বিচার চাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”

তিনি আরও বলেন, “আমি এখনও জানি না কে আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। আমি আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বিচার চাইব। আমি এখন পর্যন্ত আমার ছেলের কবর জিয়ারত করতে যাইনি। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, যেদিন আমার ছেলের হত্যাকারীদের দেখবো, বিচার দেখে যেতে পারবো, ওইদিন কবর জিয়ারত করবো। এর আগে যদি আমার মৃত্যুও হয় হোক। এরপরও খুনিদের না দেখে আমি ছেলের কবর জিয়ারত করতে যাবো না।”

সালেহা মনির বলেন, “আমার ছেলে এভাবে মারা যাবে, চলে যাবে কল্পনাও করতে পারিনি। আবার মামলা যে এত দেরি হবে এই সরকারের আমলেই, সেটাও কল্পনা করতে পারিনি। র‌্যাব তো সব জানে। প্রতিবেদন জমা দিলেই তো হয়। প্রতিবেদন যদি জমা না দিতে পারে সেটাই তারা প্রকাশ করুক। এভাবে ঝুলিয়ে রাখার কোনো মানে আসে না। এত বড় বড় মামলার সমাধান করছে র‌্যাব, অথচ এই মামলায় ১২ বছরেও একটি প্রতিবেদন জমা দিতে পারলো না। কত খুনের বিচার হচ্ছে, ক্লুলেস কত মামলায় বিচার হচ্ছে। কিন্তু সাগর-রুনির বেলায় এমন হচ্ছে কেন আমার বোধগম্য নয়। এক কথায়, আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখে যেতে চাই।”

মামলার বাদী মেহেরুন রুনির ছোট ভাই নওশের আলম রোমান বলেন, “১২ বছর ধরে মামলাটির প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় চেয়ে নিচ্ছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। এটি একটি লজ্জাজনক বিষয়। প্রতিবেদন জমা না দেওয়ার একটি খারাপ সংস্কৃতি চালু হতে যাচ্ছে। দেশে কোনো অপরাধ করলেও বিচার হয় না– এটাই সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। সরকার চাইলে সত্য ঘটনা বের করতে পারে। সেখানে ১০৫ বার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় চেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা, আর সেই সময় মঞ্জুরও হচ্ছে। অথচ তারা এলিট ফোর্স দাবি করে নিজেদের। দুঃখজনক বিষয়, তারা কত বিষয় নিয়ে বড় করে প্রেস ব্রিফিং করে, অথচ আলোচিত এই ঘটনা নিয়ে তাদের কোনো কাজেই দেখাতে পারলো না। আমাদের এটাই দাবি, প্রকৃত অপরাধী বের হয়ে আসুক আর বাংলাদেশি আইন অনুযায়ী তাদের কঠোর শাস্তি হোক।”

যা বলছেন আইনজীবীরা

ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, “সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলাটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা। অনেক বছর হয়ে গেলো, এখনও প্রতিবেদন দিতে পারলো না তদন্ত সংস্থা। মামলাটির দ্রুত নিষ্পত্তি প্রয়োজন। রিপোর্ট হাতে পেলেই আমরা লক্ষ্য করব। বিচার ত্বরান্বিত করতে।”

ঢাকা জজ কোর্টের আইন বিশেষজ্ঞ, সিনিয়র আইনজীবী, সাবেক ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর এহসানুল হক সমাজী জানান, “ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭(৫) ধারায় ১২০ কার্যদিবসের মধ্যে কোনো মামলার তদন্ত শেষ করার বিধান রয়েছে। তবে তা বাধ্যতামূলক নয়। এরপরও কোনো মামলার তদন্ত চলতে বাধা নেই। তবে এর মানে এই নয় যে তা বছরের পর বছর চলতে থাকবে। মামলার তদন্ত সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা–এ বিষয়ে আদালতের নজরদারি বাড়াতে হবে। আদালত তদন্ত কর্মকর্তাকে কেস ডায়েরিসহ তলব করতে পারেন। তদন্ত কর্মকর্তার কেস ডায়েরি পর্যালোচনা করে যদি ম্যাজিস্ট্রেট দেখেন, তিনি ইচ্ছাকৃত বিলম্ব করছেন, তবে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন। একই সঙ্গে পরবর্তী ধার্য তারিখের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিতে পারেন।”

আসামি পক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ আবু সাইদ সিদ্দিকী (টিপু) বলছেন, “মামলার তদন্ত প্রতিবেদন পেছানোর কারণে রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষ উভয়ে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। আমাদের আশা, যেন দ্রুত মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়। আর প্রকৃত খুনিরা বেরিয়ে আসুক, নিরপরাধ ব্যক্তিরাও যেন অব্যাহতি পায়। আমাদের প্রত্যাশা, তদন্ত কর্মকর্তা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে দ্রুত প্রতিবেদন দাখিল করুক।”

হত্যা ও মামলা

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় নাবালক ছেলে মাহির সরোয়ার মেঘের সামনেই মাছরাঙা টিভির তৎকালীন বার্তা সম্পাদক সাগর সারোয়ার ও তার স্ত্রী এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ওই সময় মেঘের বয়স ছিল মাত্র পাঁচ।

জোড়া হত্যাকাণ্ডটি দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিশেষ করে সাংবাদিকদের মধ্যে। তারা তখন থেকে নিহত দম্পতির বিচার দাবি করে আসছে।

ওই সময় সরকারের পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা দম্পতির বাসভবন পরিদর্শন করেন। শিশু মেঘের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের পরিবারকে দ্রুত বিচারের আশ্বাস দেন।

তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের বিচারের আওতায় আনার অঙ্গীকার করেছিলেন।

মামলার যে অবস্থা

২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মামলাটি তদন্তের জন্য প্রথম ডিবি উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলম তদন্তভার নেন। এরপরে পর্যায়ক্রমে র‌্যাবের সহকারী পরিচালক মো. ওয়ারেছ আলী মিয়া, আরেক সহকারী পরিচালক সহিদা রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার মো. শফিকুল আলম, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার জাফর উল্লাহ ও সহকারী পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন আহম্মেদ মামলাটি তদন্ত করেন।

২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, ওই বছরের ৭ জুন, ২০১৬ সালের ২ অক্টোবর ও সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২১ মার্চ তদন্তে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। তদন্তে অগ্রগতি সংক্রান্ত প্রতিটি প্রতিবেদনে প্রায় একই ধরনের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

মামলার আট আসামির দুই জন বাড়ির দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল ও কথিত বন্ধু তানভীর রহমান জামিনে আছেন। অপর ছয় আসামি মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু, বকুল মিয়া, কামরুল হাসান অরুন, রফিকুল ইসলাম, এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবির ও আবু সাঈদ কারাগারে রয়েছেন। এ মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার ৮ জনের কেউই এখন পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেনি।

২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সাগর-রুনির ভাড়া বাসার নিরাপত্তা প্রহরী এনামুল হক ও পলাশ রুদ্র পাল ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দেন। ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মো. সাইদ, মিন্টু, কামরুল হাসান অরুণ ও নিহত দম্পতির বন্ধু তানভীর রহমান এই পাঁচজনকে মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণচন্দ্র হত্যার ঘটনায় র‌্যাব ও ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। এ পর্যন্ত ১৫৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে র‌্যাব।

র‌্যাবের তদন্তকারীরা বারবার বলেছেন, তারা কাজ করছেন। তদন্তকারীরা আদালতে সময় চাইলে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেবেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বরাবরই এজেন্সির সময় আবেদন গ্রহণ করে।

গত ২ ফেব্রুয়ারি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, “সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সঠিক সময়সীমা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।”

মন্ত্রী বলেন, “যারা এই অপরাধ করেছে তাদের ধরতে ৫০ বছর লেগে গেলেও তারা অপরাধীদের ধরবে।”

সাংবাদিক,হত্যাকাণ্ড,আইন ও বিচার
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close