• সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

বস্তির স্বাস্থ্য বুঝতে বিদেশ যেতে চান কর্মকর্তারা

প্রকাশ:  ১৭ নভেম্বর ২০২২, ১০:৪১
নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও বিদেশ ভ্রমণের তোড়জোড় থেমে নেই সরকারি কর্মকর্তাদের। স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি প্রকল্পে বিদেশে প্রশিক্ষণ নিতে চাওয়া হয়েছে ৯ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। শহর এলাকায় স্বল্প আয়ের মানুষ ও বস্তিবাসী বিশেষ করে শিশু, মহিলা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। তবে সংকটের এ সময়ে বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে এত টাকা খরচকে অযৌক্তিক মনে করছেন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা।

প্রকল্পটির সংশোধিত প্রস্তাব থেকে জানা যায়, ১০ সিটি করপোরেশন ও ১৭টি পৌরসভার ছিন্নমূল ও নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ‘আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিস ডেলিভারি’ প্রকল্পে এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।

সম্পর্কিত খবর

    প্রকল্পটির মূল ডিপিপিতে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ খাতে ১০ কোটি ১৮ লাখ টাকা রাখা হলেও সংশোধিত ডিপিপিতে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। ইতোমধ্যেই বৈদেশিক প্রশিক্ষণে প্রকল্পটিতে ৭৮ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। বাকি টাকা আগামী দুই বছরের মধ্যে ব্যয় করতে চান কর্মকর্তারা।

    অথচ সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বৈশ্বিক সংকটের কথা বিবেচনা করে কৃচ্ছ্রসাধনের নির্দেশ দিয়েছেন। খুব প্রয়োজন না হলে কোনো ব্যয় করতে নিষেধ করেছেন। তা আমলে নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ১০ নভেম্বর এক পরিপত্রে উন্নয়ন বাজেট ও পরিচালন বাজেট উভয় ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিদেশ সফর বন্ধ করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে বলা হয়েছে, করোনা-পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও বর্তমান বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষাপটে পুনরায় আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত এক্সপোজার ভিজিট, শিক্ষাসফর, এপিএ এবং ইনোভেশনের আওতামুক্ত ভ্রমণ ও ওয়ার্কশপ বা সেমিনারে অংশগ্রহণসহ সব ধরনের বৈদেশিক ভ্রমণ বন্ধ থাকবে।

    বৈদেশিক প্রশিক্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পটির পরিচালক ও যুগ্ম সচিব এএফএম আলাউদ্দিন খান বলেন, ‘প্রকল্পের প্রস্তাবনায় বৈদেশিক প্রশিক্ষণ প্রয়োজনে থাকতেই পারে। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তা ব্যয় করা হবে। সরকার অনুমতি না দিলে বিদেশে প্রশিক্ষণে যাওয়া হবে না।’

    প্রকল্পটিতে বিদেশে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি দেশে প্রশিক্ষণে মূল ডিপিপিতে ১৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। গত চার বছরে প্রশিক্ষণ খাতের ৫০ শতাংশ খরচ হয়েছে। বাকি অর্থ আগামী দেড় বছরে খরচ করতে চায়।

    প্রকল্পটির উপস্থাপনা থেকে জানা যায়, মূল ডিপিপিতে ছয়তলাবিশিষ্ট ৮টি নগর মাতৃসদন ও তিনতলাবিশিষ্ট ২০টি নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংস্থান ছিল। কিন্তু সংশোধিত ডিপিপিতে নগর মাতৃসদন ঠিক রাখলেও নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা কমিয়ে ১৭টি রাখা হয়েছে। সময় বৃদ্ধি করা হচ্ছে এক বছর তিন মাস। অর্থাৎ মূল প্রকল্পে বাস্তবায়নকাল ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে কাজের অগ্রগতি খুবই কম হয়েছে। জুন পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৩৪ দশমিক ৩০ শতাংশ ও বাস্তব অগ্রগতি ৪০ শতাংশ। তাই বাকি কাজ শেষ করতে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রস্তাব করা হয়েছে।

    এ ছাড়া প্রকল্পটিতে পরামর্শক খাতে খরচ ধরা হয়েছে ৬৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা। মেডিকেল ও সার্জিক্যাল ইকুইপমেন্ট ১৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের লোকবলও বেশি করে ধরা হয়েছে। তাতে থোক বরাদ্দ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ১৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এভাবে কয়েকটি খাতে বেশি করে ব্যয় ধরা হয়েছে। এক হাজার ১৩৫ কোটি থেকে ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছে এক হাজার ২১৯ কোটি টাকা। ব্যয় বাড়ছে প্রায় ৮৩ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ। এর মধ্যে এডিবির ঋণ হচ্ছে ৯৫২ কোটি টাকা, বাকি অর্থ সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় করা হবে।

    বর্তমানে কাজের অগ্রগতির ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘কিছু কারণে প্রকল্পের অগ্রগতি কম হয়েছে। সব কাজ শেষ করতে সংশোধন করে সময় বাড়ানো হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত অনযায়ী অর্থ কাটছাঁট করা হচ্ছে। গাড়ি কেনার অর্থ কমানো হচ্ছে।’ পরামর্শক ফি বৃদ্ধির ব্যাপারে বলেন, ‘তারা কাজ করলে বেতন তো দিতে হবে।’

    প্রকল্পটি সংশোধনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠানো হলে তা যাচাই-বাছাই করতে গত ১৪ নভেম্বর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কিছু ব্যাপারে আপত্তি থাকায় তা সংশোধন করতে বলা হয়েছে। সংশোধিত ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য তা একনেক সভায় উপস্থাপন করা হবে।

    এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো-শহর এলাকায় বসবাসকারী জনসাধারণ, বিশেষ করে শিশু, মহিলা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার অবস্থার উন্নয়ন সাধন করা। বিশেষ করে প্রকল্পের আওতাভুক্ত এলাকার প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের আর্থিক ও ভৌত সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ। নগরবাসীদের জন্য মানসম্মত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, বিশেষ করে মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য সম্পর্কিত অপরিহার্য সেবা প্রদান প্যাকেজসমূহ নিশ্চিত করা। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহীতার সংখ্যা (বিশেষ করে দরিদ্র মহিলা, নবজাতক এবং শিশু) বৃদ্ধিকরণ। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ। ম্যান্ডেট অনুসারে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে নগর স্থানীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ এবং নগর স্থানীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের মালিকানা ও প্রতিশ্রুতি শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ।

    প্রকল্পের প্রস্তাবনায় বলা হয়, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা হলো মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা, যা স্বাস্থ্যসেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গ্রামাঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে স্বাধীনতার পর থেকে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত কমিউনিটি ক্লিনিক কাজ করছে। তবে গ্রামাঞ্চলে কমিউনিটি ক্লিনিক ছাড়াও ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং পরিবার পরিকল্পনার শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। কিন্তু নগর এলাকার স্বল্প আয়ের মানুষ ও বস্তিবাসীদের জন্য অনুরূপ স্বাস্থ্যসেবার নেটওয়ার্ক ও কার্যক্রমের ঘাটতি রয়েছে। অন্যদিকে নগরায়ণের ফলে শহরবাসী মানুষের স্বাস্থ্যসেবার বর্ধিত চাহিদার তুলনায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের কাঠামো অপ্রতুল।

    স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন-২০০৯, স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন-২০০৯ অনুসারে নগরবাসীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাসমূহের দায়িত্ব। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সাল হতে স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতায় আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার শিরোনামে জুলাই ১৯৯৮ থেকে জুন ২০০৫ মেয়াদে প্রথম পর্যায় ও জুলাই ২০০৫ হতে ২০১২ মেয়াদে দ্বিতীয় পর্যায় প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। অতঃপর আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিস ডেলিভারি প্রজেক্ট (ইউপিএইচসিএসডিপি) নামে জুলাই ২০১২ হতে মার্চ ২০১৮ (প্রথম পর্যায়) এবং এপ্রিল ২০১৮ হতে মার্চ ২০২৩ পর্যন্ত (দ্বিতীয় পর্যায়), যা বর্তমানে চলমান রয়েছে।

    প্রস্তাবনায় বলা হয়, আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিস ডেলিভারি (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্পটি এপ্রিল ২০১৮ হতে মার্চ ২০২৩ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য ১ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে একনেক কর্তৃক অনুমোদিত হয়। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের পরিবর্তনে স্থানীয় মুদ্রায় বরাদ্দ বৃদ্ধি, জিওবি অর্থের ভ্যাট/ট্যাক্স হার বৃদ্ধি ও পার্টনারশিপ এলাকার পরিবর্তনের কারণে ইউপিএইচসিএসডিপি (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশোধন প্রস্তাবে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১ হাজার ২১৮ দশমিক ৯৪ কোটি টাকা এবং বাস্তবায়ন মেয়াদকাল এপ্রিল ২০১৮ হতে জুন ২০২৪ পর্যন্ত। এক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৮২ দশমিক ৯৪ কোটি টাকা (৭.৩০ শতাংশ) এবং মেয়াদ বৃদ্ধি পেয়েছে ১ বছর ৩ মাস।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close