জলে ভাসা ঈদ
‘যেখানো ঘর নাই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নাই, আমরার আবার কিতার (কিসের) ঈদ। কোনো রকমে ঘর বানাইয়া ফিরতে পারলেউ আমরার অইবো আসল ঈদ।’ এই মন্তব্য সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে হাইটেক পার্কের আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানকারী মরিয়ম বেগমের।
সিলেটে বন্যা শুরু হওয়ার পর সন্তানদের নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে ওঠেন মরিয়ম। প্রায় ২৫ দিন ধরেই তিনি কোম্পানিগঞ্জের হাইটেক পার্কের আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছেন। তার মতো এমন অসংখ্য বানভাসি মরিয়ম বেগম অবস্থান করছেন সিলেটের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে। যাদের নিদারুণ কষ্টে ঈদ কাটছে আশ্রয়কেন্দ্র কিংবা আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে।
সম্পর্কিত খবর
সরকারি হিসেব অনুযায়ী শনিবার (৯ জুলাই) পর্যন্ত সিলেটে মোট ২৬৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন ২০ হাজার ১২৫ জন। এবারের বন্যায় এই জেলায় ৪ লাখ ৮৪ হাজার ৩৮৩টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মোট ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ২৯ লাখ ৯৯ হাজার ৪৩৩ জন। বন্যায় মোট ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি ৪০ হাজার ৯১টি।
সরকারি হিসেবে এই পরিসংখ্যান হলেও বাস্তবের চিত্র আরো করুণ। আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে অবস্থান করছেন কয়েক হাজার মানুষ।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও জকিগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় এখনো বন্যার পানি নেমে যায়নি। তলিয়ে আছে রাস্তাঘাট। চরম দুর্ভোগে রয়েছেন লক্ষাধিক মানুষ।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ রনিখাই ইউনিয়নের লোভা হাওরের পিপড়াখাইয়ের বাসিন্দা বাতাসুন বিবি। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর শিশু ছেলেকে নিয়ে বাবার বাড়িতে একটি ঘর বানিয়ে বসবাস করছিলেন তিনি। বন্যার পানিতে ঘর তলিয়ে যাওয়ায় চলে আসেন আশ্রয়কেন্দ্রে। পানি কমার পর বাড়িতে গিয়ে দেখেন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। বানের পানিতে ভেসে গেছে তার ঘর। ভিটে ছাড়া আর কিছুই নেই। সর্বগ্রাসী বন্যায় বাতাসুন বিবির সবকিছু তছনছ করে দিয়ে গেছে।
লোভার হাওরের কেবল বাতাসুন বিবি নয়, একই গ্রামের মৃত ফরিদ উদ্দিনের স্ত্রী রহিমা বেগম, মৃত মবেশ্বর আলীর ছেলে কামরুল ইসলামেরও একই দশা। তারা সবাই এখন আশ্রয়কেন্দ্রের বাসিন্দা।
কোম্পানীগঞ্জের চাতালপাড় গ্রামের বাসিন্দা মঈন উদ্দিন। পাকাঘর ঘর ছিল তার। বানের স্রোতে ঘরের পাকা দেয়াল ভেঙে পুরো ঘরটি যেন লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন। বাড়ি ফিরে উঠেছেন চাচাতো ভাইয়ের ঘরে।
মঈন উদ্দিন জানান, ‘যাদের ঘরে আছি তারাও ছিলেন আশ্রয়কেন্দ্রে। পানি নেমে যাওয়ায় একসঙ্গে ফিরেছি। গোলাভরা ধান সব নষ্ট হয়ে গেছে। ঘর বানানো দূরের কথা খেয়ে বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে।’
তিনি জানান, ‘সবাই ঈদ করলেও আমাদের সেই অবস্থা নেই। সন্তানদের নতুন জামা কাপড় কিনে দিতে পারেন নি। খাবার পেলেও রান্না করার ব্যবস্থা নেই। যেখানে নিজের ঘরই নেই, সেখানে আবার আনন্দ কিসের।’
দীর্ঘ ২৫ দিন পর ঘর থেকে বন্যার পানি নেমেছে দক্ষিণ সুরমার বোয়াল গাঁওয়ের বিভিন্ন ঘর বাড়ি থেকে। সানজিদা নামের এক বাসিন্দা জানান, ‘সিলেট নগরীতে বাবার বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। ইচ্ছে ছিলো নিজ বাড়িতে ঈদ করার। কিন্তু বন্যার পানি নামলেও এখনো ঘরে বসবাসের উপযোগী হয়নি।’
গোয়াইনঘাটের দরাকুল গ্রামের বাসিন্দা বশির উদ্দিন। তিনি জানান, ‘বাড়ি ফিরলেও বাড়ি আর আগের মতো নেই। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে ছিলাম। আশ্রয় নিয়েছিলাম একটি স্কুলে। এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। টিনসেড ঘরের কিছুই আর আগের মতো নেই।’
এদেকে ঈদে বানভাসি মানুষদের মুখে হাসি ফোটানোর উদ্যোগ নিয়েছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সংগঠনের কর্ণধার আবুল হোসেন রোববার (১০ জুলাই) বলেন, ‘রান্না করা খাবার নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা বানভাসদের কাছে যাবো।’
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, ‘আশ্রয়কেন্দ্রগুলোত উন্নত মানের খাবার পরিবেশন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাদের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের আর্থিক সহায়তা করা হচ্ছে ঘর মেরামতের জন্য। পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চলছে।’
প্রসঙ্গত, গত ১৪ জুন থেকে সিলেটে বন্যা দেখা দেয়। ১৬ জুন থেকে সিলেট পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে। ফলে তলিয়ে যায় যায় সিলেট নগরীর অধিকাংশ এলাকা। এখনো বিভিন্ন এলাকায় বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে রাস্তাঘাট।
পূর্বপশ্চিম/ম