• রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

লামায় জুম বাগানে আগুন, ‍ বিশিষ্ট ১৬ নাগরিক ও ইউপিডিএফের নিন্দা

প্রকাশ:  ০৮ মে ২০২২, ১৭:১৭
নিজস্ব প্রতিবেদক

বান্দরবানের লামা উপজেলায় লাংকমপাড়া, রেংয়েনপাড়া ও জয়চন্দ্রপাড়ার জুমের বাগান পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে নিন্দা ও প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তাররা হলেন- লামা রাবার ইন্ড্রাষ্ট্রিজের ম্যানেজার মো. আরিফ হোসেন (৪৫) ও লম্বা খোলা গ্রামের বাসিন্দা মো. দেলোয়ার হোসেন (৪২)। তবে মামলার প্রধান তিন আসামী ঘটনার মূল হোতা লামা রাবার ইন্ড্রাষ্ট্রিজের পরিচালক মো. কামাল উদ্দিন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন (৬২) ও জহিরুল ইসলাম (৬০) রয়ে গেছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তারা প্রকাশ্যে এলাকায় চলাফেরা করছেন।

এদিকে জুম বাগান পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট ১৬ জন নাগরিক এবং ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)।

বিবৃতিতে বিশিষ্ট ১৬ জন নাগরিক লামার তিনটি পাড়ার জুমের বাগান পুড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে জড়িতদের একটি স্বাধীন, দ্রুত ও কার্যকর তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানোর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত ৪০টি পরিবারকে পর্যাপ্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

তারা বলেন, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি কোম্পানির লোকজন পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়ে পাহাড়িদের জুমের বাগান পুড়িয়ে দেয়। আগুনে প্রায় সাড়ে তিনশ একর জুমের ধান, বাঁশ, আম, কলা, আনারসসহ বিভিন্ন ফলদ ও বনজ গাছ পুড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িরা এখন উচ্ছেদ আতঙ্কে ভুগছেন।

বিবৃতি প্রদানকারীরা হলেন মানবাধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, নারী নেত্রী ও নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জমান, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সভাপতি ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, বাংলাদেশ পরিষদের উপদেষ্টা কাজল দেবনাথ, সামাজিক আন্দোলনের সাবেক সহ-সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট তবারক হোসাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, নাগরিক উদ্যোগ-এর প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ব্লাস্টের অনারারি নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং এবং তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা এবং এএলআরডি'র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা।

এদিকে্নােইইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর সিনিয়র কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব চাকমা বান্দরবানে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃক ভূমি বেদখল, পাহাড়ি উচ্ছেদ ও জুমভূমি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক তৎপরতা বন্ধ করতে দ্রুত আইনগত ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।

শনিবার (৭ মে) সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া এক বিবৃতিতে তিনি গত ২৬ এপ্রিল লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কর্তৃক লামার সরই ইউনিয়নের তিন পাহাড়ি গ্রামের সাড়ে ৩০০ একর জুমভূমি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ি পরিবারগুলোকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানেরও দাবি জানান।

বান্দরবানে সবচেয়ে অবহেলিত, পশ্চাদপদ ও বৈষম্যের শিকার ম্রো ও ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর বাস্তুভিটা বেদখল ও তাদেরকে উচ্ছেদ করে কোম্পানীর মুনাফা লাভের চেষ্টা অত্যন্ত ঘৃন্য ও নিন্দনীয় বলে সচিব চাকমা মন্তব্য করেন এবং বলেন স্বাভাবিকভাবে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে উঠছে।

মেরিডিয়ান কোম্পানীর সাথে মিলে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ গত কয়েক বছর ধরে লামায় ম্রোসহ পাহাড়ি জাতিসত্তার লোকজনকে তাদের বংশপরম্পরায় ভোগদখল করে আসা জুমভূমি থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা চালিয়ে আসছে বলে ইউপিডিএফ নেতা অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘উক্ত দুই কোম্পানীর লোকজন এলাকা ছেড়ে চলে যেতে পাহাড়ি পরিবারগুলোকে হামলা, মামলা ও তাদের ঘরবাড়ি ও ক্ষেতখামার আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে আসছিল। ২০১৯ সালে বান্দরবান জেলা প্রশাসক ও লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরও কোন কাজ হয়নি, কোম্পানী দুটি তাদের অপরাধমূলক তৎপরতা বন্ধ করেনি। তাদের হুমকি ও হয়রানির কারণে ডলুছড়ি মৌজার ঢেঁকিছড়া গ্রামের ১৪টি ম্রো পরিবার ইতিমধ্যে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে।’

সচিব চাকমা বলেন, ‘লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ ইতিমধ্যে ম্রোদের ৩০০ একর জমি জবরদখল করেছে। এতেও ক্ষান্ত না হয়ে গত ২৬ এপ্রিল কোম্পানীর লোকজন আরও জমি বেদখলের জন্য ল্যাংকম পাড়া, রেংয়েন পাড়া ও জয়চন্দ্র পাড়ায় পাহাড়িদের সাড়ে ৩০০ একর জমির ফসল আগুনে পুড়িয়ে দেয়। এতে তাদের বনজ, ফলদ ও ঔষধী গাছসহ জুমের ধানক্ষেত নষ্ট হয়, যার মূল্য কয়েক কোটি টাকা।’

তিনি উক্ত হামলাকে অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক ও জঘন্য অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, অবিলম্বে উক্ত ঘটনার সাথে জড়িত লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের গ্রেফতারপূর্বক আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে, রাবার বাগানের নামে ম্রোসহ পাহাড়িদের উচ্ছেদ ও তাদের জমি বেদখল বন্ধ করতে হবে, বেদখলকৃত জমি মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

পাহাড়িদের বংশপরম্পরায় ভোগদখল করা জমি তথাকথিত খাস চিহ্নিত করে কোন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ইজারা প্রদান কিংবা অধিগ্রহণের কোন অধিকার সরকারের নেই বলে সচিব চাকমা দাবি করেন। ‘যেখানে শিক্ষাদীক্ষা, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য উন্নয়নসূচকে পশ্চাদপদ ম্রোসহ অন্যান্য পাহাড়ি জাতিসত্তাগুলোকে ভূমি অধিকারসহ তাদের সার্বিক বিকাশের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, সেখানে উল্টো তাদেরকে নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, যা চরম অন্যায়, অমানবিক এবং সংবিধানের মূলনীতি ও মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।’

সচিব চাকমা সরকারের বিরুদ্ধে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতি পক্ষপাত ও ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণের অভিযোগ করেন এবং বলেন, ‘ঘটনার সময় ম্রো ও ত্রিপুরা গ্রামবাসীদের জানমাল রক্ষায় এগিয়ে না আসা, হামলাকারীদের নিরস্ত না করা এবং ঘটনার এতদিন পরও সরকারী কোন কর্মকর্তা কর্তৃক ঘটনাস্থল পরিদর্শন না করা সেটাই প্রমাণ করে।’

ন্যায়বিচার লাভের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে মন্তব্য করে ইউপিডিএফ নেতা লামায় ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘কোম্পানীর কিংবা সরকারের অন্যায় জবরদখল আর নিরবে সহ্য করবেন না। স্থানীয়ভাবে নিজেরা সংগঠিত হয়ে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। লড়াই সংগ্রাম হলো অধিকার আদায়ের একমাত্র পথ। আপনারা একা নন, ইউপিডিএফ পার্টি আপনাদের সাথে রয়েছে।’

পূর্বপশ্চিম- এনই

লামা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close