• শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

৮৭% ধনীই আয়কর দেন না

প্রকাশ:  ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৭:১২
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

দেশের ৮৭% ধনী এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত নাগরিক আয়কর দেন না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। গত রবিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে প্রাক-বাজেট বৈঠকে এ তথ্য জানানো হয়।

অর্থনীতি সমিতি জানায়, ‘‘দেশে ১৮ লাখ মানুষ কর দেন। তাদের মধ্যে ১০ লাখ সরকারি চাকরিজীবী এবং অন্যান্য চাকরিতে নিয়োজিত আছেন।”

সংগঠনটির হিসাবে, দেশে ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্তদের মধ্যে আয়কর দেওয়া মানুষের সংখ্যা ৯ থেকে ১০ লাখ হবে। এই সংখ্যা হওয়ার কথা ৭৮ লাখ ৩২ হাজার। এর মানে, ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্তদের ৮৭% কোনো ধরনের আয়কর দেন না।

অর্থনীতি সমিতি বলছে, ‘‘কর প্রশাসনের অদক্ষতা এবং কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশ করে তারা এই কর ফাঁকি দিচ্ছেন। এ কারণে কখনোই এনবিআর কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে না।’’

অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমরা গবেষণায় ওই তথ্য পেয়েছি। এদেশে এমনিতেই মানুষের মধ্যে আয়কর দেওয়ার প্রবণতা কম। আর উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের মধ্যে এটা আরো কম। যারা দেয় না, সেই ৮৭% মানুষের কাছ থেকে আয়কর আদায় করতে পারলে রাজস্ব ঘাটতি থাকতো না।’’

এনবিআর কখনোই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করতে পারে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমফ) ঋণের শর্তের মধ্যে অন্যতম হলো রাজস্ব আদায় বাড়ানো এবং কর প্রশাসনের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি।

কিন্তু চলতি অর্থবছরেও এনবিআর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েছে ২০,০০০ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা কমানোয় এখন তা দাঁড়ালো চার লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা।

অর্থ বছরের প্রথম ছয় মাসে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি হয়েছে ২৩,২২৭ কোটি টাকা। এমন প্রেক্ষাপটে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হলেও তা অর্জন করা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ কর মোট করের শতকরা ৩০%। আর বাকি ৭০% পরোক্ষ কর। এই পরোক্ষ করের চাপ সবচেয়ে বেশি দেশের সাধারণ মানুষের ওপর। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রত্যক্ষ কর শীর্ষে থাকা উচিত; সেটা হলো আয়কর, যেটা ব্যক্তির আয়ের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটছে উল্টোটা। আর এখানে কর জিডিপি অনুপাত এখনো ১০%-এর ঘরে; যা এশিয়ায় সর্বনিম্ন।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান বলেন, ‘‘এর আগে অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাত বলেছিলেন, মানুষ সিন্দুকে কোটি কোটি টাকা রেখে দিয়েছে। পরে অভিযান চালিয়ে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এনু-রুপনের বাড়ি থেকে সিন্দুক ভর্তি টাকা উদ্ধার করা হয়। এবার অর্থনীতি সমিতি বলছে ৮৭% ধনী এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত আয়কর দেয় না। সংখ্যাটা কত হবে সেই জরিপ আমি করিনি, তবে আমার অভিজ্ঞতা হলো অধিকাংশই দেয় না।’’

অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. আইনুল ইসলাম বলেন, ‘‘ধনীদের যারা আয়কর ফাঁকি দেন তাদের ব্যাংক হিসাবে অর্থ থাকলেও তা দেখান না। এজন্য ব্যাংক এবং এনবিআরের এক শ্রেণির কর্মকর্তা সুবিধার বিনিময়ে তাদের সহায়তা করেন। আর তাদের আয়ের একটি অংশ তারা ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে রেখে দেশের বাইরে পাচার করেন। কিন্তু এটা চিহ্নিত করা কোনো কঠিন কাজ না। নানা টুলস আছে সেগুলো ব্যবহার করলেই চিহ্নিত করা যায়। এখানে এনবিআর আগ্রহ দেখায় না। আবার যারা ফাঁকি দেয় তারা নানাভাবে প্রভাশালী।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘দেশে যাদের টিআইএন (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার) আছে তাদের সবার কাছ থেকে কর আদায় করতে পারলেও ঘাটতি থাকে না। সেটা না করে এনবিআর পরোক্ষ কর বাড়ায়। নিত্য ব্যবহারের পণ্যের ওপর এই কর দেশের সাধারণ মানুষকে দিতে হয়। আর যারা ধনী তারা রেহাই পেয়ে যান।’’

অর্থনীতি সমিতি জানিয়েছে, তারা দেশে ট্যাক্স কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। কর সম্পর্কে যারা বোঝেন সেরকম বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ব্যক্তিরা সেখানে থাকবেন। আর লেনদেন যত দ্রুত সম্ভব ডিজিটাল করার পরামর্শ দিয়েছেন। ওই পদ্ধতির সঙ্গে এনবিআর যুক্ত থাকলে সবার আয়-ব্যয়ের খবর তারা পাবেন।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ২০১৮ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে বছরে কোটি টাকা আয় করেন এরকম জনগোষ্ঠীর ৬৭% কর আওতার বাইরে আছে। এরা যে “লার্জ ট্যাক্সপেয়ার ইউনিটের” মধ্যে তা নয়। এরা সারা দেশেই ছড়িয়ে আছেন। কিন্তু এদের করের আওতায় আনা যাচ্ছে না।

এ ব্যাপারে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান বলেন, ‘‘রাষ্ট্রযন্ত্র ফেয়ার না হলে ধনীদের কাছ থেকে আয়কর আদায় সম্ভব নয়। কারণ তারা প্রভাশালী, তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত। তাদেরকে ছাড় দেওয়া হয়। দেশে গ্রাম পর্যন্ত এখন বহু লোক গাড়ি-বাড়ি হাঁকায়, কিন্তু তারা আয়কর দেয় না।’’

তিনি বলেন, ‘‘আমি যখন এনবিআরের চেয়ারম্যান তখন ওয়ান ইলেভেন সরকার। তখন একবার উদ্যোগ নিয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে সেই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হয়নি।”

তিনি আরও বলেন, আমি গুলশান-বনানী-ধানমন্ডি এলাকায় ট্যাক্স বুথ বসিয়ে আয়কর আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। পদ্ধতিটি ছিল, এনবিআর, পুলিশ ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সমন্বয়ে টিম করে বাড়ি বাড়ি যাওয়া। কত বাসা ভাড়া দেন তা জানা। তো এখন থেকে ১৭ বছর আগে যদি কেউ ২০,০০০ টাকা বাসা ভাড়া দিয়ে থাকেন তাহলে তার আয় কত তা বুঝতে অসুবিধা ছিল না। আমি চেয়েছিলাম তাৎক্ষণিক টিআইএন দিতে, কিন্তু আমাকে থামিয়ে দেওয়া হয়।’’

এভাবে যতি সারা দেশে জরিপ করা হয়, তাহলে যারা আয়কর ফাঁকি দেয় তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘‘ওই সময়ে নির্দলীয় সরকার ছিল, তারপরও আমাকে করতে দেওয়া হয়নি। আর এখন তো দলীয় সরকার। তাহলে সেটা কীভাবে সম্ভব?’’

এই দুইজনের মতে, আয়কর ঠিকমতো আদায় হলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি কর আদায় হতো। সেটা না করে যারা কর দেন তাদের উল্টো নানা রকম হয়রানি করা হয়। আর গরিব মানুষের ওপর করের বোঝা চাপানো হয়। এদেশে যাদের সম্পদ বেশি তারা কম কর দেয়। যাদের নেই তারা বেশি কর দেয়।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশ ফেলো অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘প্রত্যক্ষ কর (আয়কর) বাড়ানো গেলে আমাদের এখন যে কর জিডিপি অনুপাত ৮.৫% আছে তা বেড়ে যাবে। তাই অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন ও বাজেট ঘাটতি কমাতে যারা আয়কর দেওয়ার যোগ্য হওয়ার পরও আয়কর দেন না তাদের কর আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। যারা কর ফাঁকি দেন তাদের কর দিতে বাধ্য করতে হবে। এজন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। আইন প্রয়োগ করতে হবে। শাস্তি ও প্রণোদনা দুটোই দিতে হবে। প্রত্যক্ষ করই উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। এটাই সবচয়ে বেশি হওয়া উচিত।’’

তিনি বলেন, ‘‘পরোক্ষ করের চাপ সাধারণ মানুষের ওপর বেশি পড়ে। তাদের আয় কম। ফলে চাপ বাড়ে। তাই এনবিআরের প্রত্যক্ষ কর আদায়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।’’

অর্থনীতি,রাজস্ব,জাতীয় রাজস্ব বোর্ড,আয়কর
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close