• শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

একজন এজাজ মেহেদী ও কিছু স্বপ্নের গল্প

প্রকাশ:  ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮:২৩ | আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮:৫৬
নিজস্ব প্রতিবেদক

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে, বুসান এশিয়ান ফিল্ম একাডেমির (বাফা) ফেলোশিপ প্রোগ্রামে বাংলাদেশ থেকে একমাত্র সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে নির্বাচিত হন এজাজ মেহেদি। ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন তিনি কাজ করবেন শোবিজে, ক্যামেরার পেছেন। সম্প্রতি এই সিনেমাটগ্রাফারের সাথে কথা হয়েছে পূর্বপশ্চিম বিনোদনের সাংবাদিকের। আড্ডার ছলে এজাজ মেহেদি জানিয়েছেন নিজের কিছু অজানা কথা।

পূর্বপশ্চিমঃ ক্যামেরার পেছনে কিভাবে গেলেন?

সম্পর্কিত খবর

    এজাজ মেহেদিঃ ছোটবেলায় স্কুল আর খেলাধুলার মাঝে বাবা-মা আমাকে সিনেমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। আমাদের পুরনো ভিসিআর প্লেয়ারে "হোম অ্যালোন" এবং আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের "প্রিডেটর" বহুবার দেখেছি মনে পরে। একদিন স্কুল থেকে এসে একটি সিনেমা দেখেছিলাম যা আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। সিনেমাটি স্টিফেন কিং এর একটি উপন্যাস অবলম্বনে, রব রাইনারের নির্মিত "স্ট্যান্ড বাই মি"। সিনেমার চরিত্র, গল্প, অভিনয় এবং আমেরিকার ওরিগন স্টেটের গ্রাম অঞ্চলের আদিম প্রান্তরের অদ্ভুত দৃশ্যগুলি ভুলতে পারিনি। সিনেমাটি প্রথমবারের মতো দেখা একটি অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা ছিল।

    ক্যাবল টিভি এবং ইন্টারনেটের স্বর্ণযুগে আমার বেড়ে ওঠা, তখন আমি মুর্শিদুল ইসলামের "দীপু নম্বর টু" এর সাথে পরিচিত হলাম। এই সিনেমাটিও আমাকে অভিভূত করলো। সম্ভবত এই দুটি চলচ্চিত্র ফটোগ্রাফির উপর আমার উপলব্ধি কে প্রভাবিত করেছিল। একটা সময়ে আমার মনে আছে ফ্লিকার নামক একটি জনপ্রিয় ওয়েবসাইটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফি এবং ফটোগ্রাফারদের কাজ দেখে। তখন "টিটিএল - থ্রু দ্য লেন্স বাংলাদেশ" নামে বাংলাদেশী ফটোগ্রাফারদের একটি কমিউনিটি খুঁজে পাই। টিটিএল এর ফটোগ্রাফারদের তোলা ছবি বাংলাদেশের মন্ত্রমুগ্ধকর সৌন্দর্য আমার চোখ খুলে দিয়েছিল।

    ২০১০ সালের শেষের দিকে আমার বাবা-মা আমাকে আমার প্রথম ক্যামেরা উপহার দেয়। ২০১১ তে আমি কয়েক মাস পাঠশালা - সাউথ এশিয়ান মিডিয়া একাডেমিতে ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়াশোনা করেছি। সেখানে পড়াকালীন আমি আনসেল অ্যাডামস, হেনরি কার্টিয়ার ব্রেসন, রবার্ট ফ্রাঙ্ক, রঘু রাই, ডোরোথিয়া ল্যাঞ্জ, জোসেফ কৌডেলকা, রেবেকা নরিস ওয়েব এবং অন্যান্যদের কাজের সাথে পরিচিত হই। ডকুমেন্টারি নির্মাণের কাজে আমার এক ব্যাচমেট কে সহায়তা করার মাধ্যমে চলচ্চিত্র নির্মাণের উপর আগ্রহ জাগে। তারপর বন্ধুদের সাথে বাংলাদেশ ভ্রমনে বেরিয়ে আমার ডিএসএলআর দিয়ে ট্রাভেল ভিডিও তৈরি করতে শুরু করি। ধীরে ধীরে শখটি নেশায় পরিণত হয় যা পরিণত হয় পেশায়। ইউটিউব এবং নো ফিল্ম স্কুল নামের ওয়েবসাইটথেকে ফিল্ম মেকিং শিখি, তার পাশাপাশি বন্ধুদের সাথে কাজ করার সুযোগের মাধ্যমে সিনেমাটোগ্রাফি শিখেছি ।

    পূর্বপশ্চিমঃ কেন পরিচালক কিংবা অভিনেতা হলেন না?

    এজাজ মেহেদিঃ আমি এ মুহূর্তে ওমান ও আরব আমিরাতে কাজ করছি। একজন সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি, আমি মাঝে মাঝে টিভি বিজ্ঞাপনে এবং মিউজিক ভিডিওতে পরিচালক হিসাবে কাজ করি তাই পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে। গল্প বলার নৈপুণ্য এবং প্রবৃত্তির প্রতি আমার আবেগ সবসময় এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে আমার অবস্থানকে নির্দেশ করে যে ক্যামেরার পিছে কাজ করতে বেশি সাচ্ছন্দ বোধ করে। প্রতিনিয়ত প্রতিভাবান অভিনেতা দের সাথে করার সুযোগ হয়। আমার ধারণা ক্যামেরার সামনে অভিনয় করা অত্যন্ত কঠিন কাজ, এ শিল্প আমার প্রতিভা এবং সামর্থ্যের বাইরে। আমার শৈল্পিকতার পরিচয় হল নির্মাতা ও অভিনেতাদের সাথে কাজ করা, লেন্সের মাধ্যমে তাদের অভিনয় ক্যাপচার করা এবং একজন পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গি কে জীবন্ত করে তোলা।

    পূর্বপশ্চিমঃ মশারি সিনেমার সাথে কিভাবে যুক্ত হলেন?

    এজাজ মেহেদিঃ নুহাশ হুমায়ুনের সাথে আমার পরিচয় সম্ভবত ২০১৬ তে। তখন আমরা একটি প্রজেক্ট করার ব্যাপারে কথা বলছিলাম। কোন এক কারণে প্রোজেক্টেটি আর হয়নি, আমি দেশের বাহিরে চলে যাই কিন্তু আমাদের দৈনিক যোগাযোগ ছিল।

    ২০১৯ সালের শেষের দিকে একটি মিউজিক ভিডিও শুট করতে দেশে আসি। তখন নুহাশ আমাকে একটি হরর শর্ট ফিল্ম স্ক্রিপ্ট পাঠায়। আমি গল্পটি পড়ে এবং এটির লেন্সিং, লোকেশন ও ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং এর সম্ভাবনার দ্বারা খুব আগ্রহী হই কারণ আমি দক্ষিণ এশিয়া থেকে এ ধরনের গল্প বলার সুযোগ আগে দেখিনি। এরকম একটা গল্প বলার সুযোগ পেয়ে বেশ উত্তেজনা অনুভব করি, নুহাশকে ফোন করে জিজ্ঞেস করি "আমরা কবে এটার শুটিং করছি ?"

    পূর্বপশ্চিমঃ বিশেষ আর কি কি কাজ করেছেন?

    এজাজ মেহেদিঃ গ্লোবাল ফেস্টিভ্যাল সার্কিটে মোশারির বিশাল সাফল্যের পর, ২০২২ এ আমি নুহাশের পরবর্তী শর্ট ফিল্ম "ফরেনার্স ওনলি " তে কাজ করার সুযোগ পাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুটি বড় স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম হুলু এবং ডিজনি+ এর অর্থায়নে প্রথম বাংলাদেশী চলচ্চিত্র। আমাদের পুর টিমের জন্য একটি বিশেষ গর্বের মুহূর্ত ছিল যখন এ বছর "ফরেনার্স ওনলি" ফ্যান্টাসিয়া ফিল্ম ফেস্টিভালে সেরা এশিয়ান শর্ট এর জন্য অডিয়েন্স এওয়ার্ড এবং হলিশর্টস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বেস্ট হরর শর্ট এর পুরস্কার জিতল। ২০২২ সালে, মশারি একই পুরস্কারগুলো জিতেছিল। সম্প্রতি বিজন ইমতিয়াজ পরিচালিত একটি বিশেষ প্রজেক্টে কাজ করেছি। এই প্রজেক্ট এর গল্প বিজন ও নুহাশের লেখা। আর চিত্রনাট্য করা নুহাশের। ছবিটি বর্তমানে পোস্ট-প্রোডাকশনে রয়েছে।

    ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে, বুসান এশিয়ান ফিল্ম একাডেমির (বাফা) ফেলোশিপ প্রোগ্রামে বাংলাদেশ থেকে একমাত্র সিনেমাটোগ্রাফি ফেলো হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি। ফেলোশিপ কালে "দ্য লাস্ট নাইট ইন কোরিয়া" ছবিতে কাজ করেছি। এটি দক্ষিণ কোরিয়াতে শুটিং করা হয়েছে এবং ২০২৩ সালের অক্টোবরে বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ার হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে একটি ফিচার ফিল্মে কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছি, ২০২৪ সালের প্রথম দিকে এটির কাজ শুরু হবার কথা।

    পূর্বপশ্চিমঃ কার কাজ আপনাকে অনুপ্রাণিত করে?

    এজাজ মেহেদিঃ তালিকাটি বেশ বড়। এশিয়া থেকে ঋত্বিক ঘটক, হায়ও মিয়াজাকি আর আকিরা কুরসাওয়ার কাজ আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করে। পশ্চিমের মিখাইল কালাটোজভ, উইলহেম মুরনাউ, ফ্রেডরিকো ফেলেইনি, টেরেন্স ম্যালিক, উইম ওয়েন্ডারস এবং জুলিয়ান শ্নাবেলের চলচ্চিত্রের বিরামহীন প্রশংসা করি। মাঝে মধ্যেই এই পরিচালকদের নির্মিত "সয় কিউবা" , সানরাইজ, দ্য থিন রেড লাইন, প্যারিস টেক্সাস, এট ইটারনিটিস গেট এবং আরও কিছু ছবি আমি বারবার দেখি। ফটোগ্রাফির জগতে, আমি রবার্ট ফ্রাঙ্ক, রেবেকা নরিস ওয়েব, রিচার্ড মিসর্যাক এবং ফ্যান হো এর মত ফোটোগ্রাফারদের কাজের একজন ভক্ত।

    পূর্বপশ্চিমঃ কাজের ক্ষেত্রে কোন মজার গল্প আছে কি?

    এজাজ মেহেদিঃ আমি যখন মশারির জন্য ভিজুয়াল নিয়ে গবেষণা করছিলাম, তখন আমি আমার প্রিয় একজন ফটোগ্রাফার- রিচার্ড মিসর্যাক এবং তার দুটি বইয়ের কাজ থেকে ব্যাপক অনুপ্রেরণা নিয়েছিলাম। তিনি এই প্রজন্মের সবচেয়ে প্রভাবশালী আমেরিকান ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফারদের একজন। বহু বছর আগে পাঠশালায় তার কাজের সাথে পরিচয়। তার একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রোজেক্টে ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফি দ্বারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ু পরিবর্তনের ফলস্বরূপ প্রভাব চিত্রিত করে। এই ছবিগুলোর মূল বাণী হল জনশুন্নতা ও প্রাকৃতিক ক্ষয়।

    আমরা শর্ট ফিল্মটির আউটডোর সিনগুলোর জন্য রিচার্ডের ছবির মত পোস্ট-আপকালিপটিক লোকেশনই খুঁজছিলাম। অত্যন্ত সৌভাগ্যের বসে আমরা এই ধরনের কিছু লোকেশন খুঁজে পেয়েছি আর ছবিটির শুটিং এই লোকেশানগুলতেই হয়েছে। মশারি কার্ল যাইজ লেন্সে শুট করা হয়েছিল। কিছুদিন আগে এই লেন্স নির্মাতা কোম্পানি তাদের লেন্সপায়ার ব্লগ নামের একটি অনলাইন সেগমেন্টের জন্য আমার সাক্ষাৎকার নেয়। লেন্সপায়ার ব্লগে এর পূর্বে গেম অফ থ্রন্স, স্কুইড গেম, ট্রয়অ্যাঙ্গেল অফ স্যাডনেস এর মত জনপ্রিয় ছবিগুলোর সিনেমাটোগ্রাফারদের সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে। আমার সাক্ষাত্কারটি প্রকাশিত হওয়ার দুই দিন পরে এক ব্যক্তি আমাকে একটি ইমেইল করে। তিনি উল্লেখ করেন যে তিনি আমার সাক্ষাৎকার পড়ার পরে মশারি দেখেছেন। তিনি বলেন ছবিটির সিনেমাটোগ্রাফি অবিলম্বে তাকে রিচার্ডের ফটোগ্রাফির কথা মনে করিয়ে দেয় এবং তিনি এই কিংবদন্তি ফটোগ্রাফারের সমস্ত কাজের সাক্ষী হয়ে বড় হয়েছেন। ইমেইল শেষে তিনি প্রকাশ করেন তিনি রিচার্ড মিসর্যাকের ছেলে। আমার প্রথমে একদম বিশ্বাস হয়নি বেপারটা। বেশ কয়েকবার ইমেলটি পরলাম তারপর বিশ্বাস হল। এই ছবিতে কাজ করে এরকম একটি ইমেইল পাওয়া ছিল আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি, এই ঘটনাটি আমি আজীবন মনে রাখব।

    পূর্বপশ্চিমঃ আগামীর ভাবনা কি?

    এজাজ মেহেদিঃ বাংলাদেশে আরও শর্ট ফিল্ম এবং ফিচার ফিল্মে কাজ করতে চাই। তাছাড়া এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশে কাজ করার আশা রাখি। নবীন ও প্রবীণ পরিচালক যারা ড্রামা, থ্রিলার, হরর এবং রহস্য জন্রার গল্প নিয়ে কাজ করছেন তাদের সাথে কাজ করতে আমি আগ্রহি। তাছাড়া লক্ষ রাখি দক্ষিণ এশীয় প্রবাসীদের গল্প নিয়েও কাজ করার। যে গল্পগুলো বাংলাদেশী সিনেমাকে বিশ্ব চলচ্চিত্র অঙ্গনে আমাদের পরিচয় তুলে ধরার সম্ভাবনা রাখে সেগুলো বলতে সাহায্য করার প্রত্যাশা রাখি।

    পূর্বপশ্চিমঃ দেশের চলচ্চিত্র নিয়ে আপনার ভাবনা কি?

    এজাজ মেহেদিঃ আমি মনে করি আমরা একটি উত্তেজনাপূর্ণ যুগে বাস করছি , বিশ্ব অঙ্গনে বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের উত্থান প্রত্যক্ষ করছি আমরা। বিগত কয়েক বছর ধরে, আমাদের চলচ্চিত্রগুলি বুসান, লোকার্নো, কান, সাউথ বাই সাউথ ওয়েস্ট, বিএফআই এবং রেইনড্যান্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী চলচ্চিত্র উৎসবে ধিরেধিরে নির্বাচিত হচ্ছে, পুরস্কার জিতেছে, সারা ফেলছে।

    মর্যাদাপূর্ণ উৎসবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের শৈল্পিক, গল্প বলার দক্ষতা এবং আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের একটি সক্রিয় অবস্থাকে প্রতিফলিত করে। গত বছর অস্ট্রেলিয়ার একটি ফুল-হাউস সিনেমা থিয়েটার বাংলাদেশী সিনেমা হাওয়া দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশী সিনেমা দেখে খুব ভালো লেগেছ। এই বছর ২৪তম বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সমাপনী রাতে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি আমি। এশিয়ার এই সর্ববৃহৎ চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র "বলি" নিউ কারেন্টস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। আমি এমন একটি ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদী যেখানে বাংলাদেশের সিনেমা দর্শকদের মুগ্ধ করবে এবং বিশ্ব মঞ্চে আমাদের স্থায়ী পরিচয় রাখবে।

    এএম/পূর্বপশ্চিম

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close