• সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

সবাই চান রাকসু, তবুও হয় না নির্বাচন!

প্রকাশ:  ৩০ মার্চ ২০২২, ১২:৪৯
রাবি প্রতিনিধি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (রাকসু) নির্বাচন হয়নি তিন দশকের বেশি সময় হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশে অনুযায়ী প্রত্যেক বছর রাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাকসু নির্বাচন হয়েছে মাত্র ১৪ বার। সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৯-৯০ মেয়াদের জন্য। এরপর যে দল সরকারে ছিল তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে দেওয়া হয়নি রাকসু নির্বাচন।

দীর্ঘদিন রাকসু নির্বাচন না হওয়ায় বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় থাকা দলগুলোর ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা জড়িয়ে পড়েছেন হলের সিট বাণিজ্য, হল দখল, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে। এতে একদিকে যেমন সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কথা বলার কেউ নেই, অন্যদিকে ভালো নেতৃত্বও তৈরি হচ্ছেনা।

তবে ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হওয়ার পরে বেশ কয়েকবার রাকসু নির্বাচনের জোর দাবি উঠেছিলো। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও তখন ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছিল রাকসু নির্বাচন নিয়ে। নির্বাচনের প্রাথমিক প্রক্রিয়া হিসেবে ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছিল তারা। বলা হয়েছিলো, এ সংলাপ থেকে উঠে আসা ছাত্র সংগঠনগুলোর মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরু করবে। তবে, অন্যতম মিনি পার্লামেন্ট খ্যাত এ রাকসু নির্বাচন প্রক্রিয়া শুধু সংলাপেই সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছে।

উপাচার্যসহ প্রশাসনের বেশকিছু দায়িত্বে পরিবর্তন এসেছে ইতিমধ্যে। রাকসু নির্বাচনের দাবিতে নতুন প্রশাসন বরাবরও স্মারকলিপি দিয়েছেন ছাত্র সংগঠনগুলো। কিন্তু এখনো তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

দীর্ঘদিন রাকসু নির্বাচন না হওয়া বিষয়ে ক্যাম্পাসের ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, ফ্যাসিবাদী শাসন টিকিয়ে রাখতে ও ক্যাম্পাসে আধিপত্য হারানোর ভয়ে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সবসময় ছাত্র সংসদ নির্বাচন না দেওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনগুলোর পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে হবে বলে জানান তারা। পাশাপাশি রাকসু নির্বাচন দিয়ে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজেদের শিক্ষার্থীবান্ধব অবস্থান পরিষ্কার করবেন বলেও আশা তাদের।

অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছেন, রাকসু নির্বাচন না হওয়ার পিছনে নির্বাচনকালীন বাজে পরিবেশ সৃষ্টি হওয়াসহ নানা কারণ রয়েছে। তবে বর্তমান প্রশাসন এবিষয়ে আন্তরিক এবং সঠিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করে এবং সুস্থ্য পরিবেশ বজায় রেখে দ্রুত সময়ের মধ্যে রাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন। এক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগবে।

রাকসু নির্বাচনের সার্বিক বিষয়ে রাবি শাখা ছাত্র ফ্রন্টের আহ্বায়ক রিদম শাহরিয়ার বলেন, আমরা সবসময়ই চাই রাকসু নির্বাচন হোক। গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য রাকসু দরকার। রাকসু নির্বাচন না হওয়ায় দীর্ঘদিন সিনেট কমিটিতে ছাত্র প্রতিনিধি নেই। এই কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন কোনো শিক্ষার্থীবান্ধব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হচ্ছেনা। আর এখন তো ফ্যাসিবাদী কায়দায় দেশ পরিচালিত হচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে রাবি প্রশাসন একটা ভয়ের মধ্যে আছে। কারণ বর্তমানে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন যে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে রয়েছে, রাকসু নির্বাচন হলে সেটা আর থাকবেনা। তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইচ্ছেমত বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে পারবেনা।

তিনি আরও বলেন, এর আগের রাবি প্রশাসন রাকসু নির্বাচনের উদ্দেশ্যে সংলাপের আয়োজন করেছিল, সেটা সংলাপ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। তবে আমরা আশা করি, বর্তমান প্রশাসন রাকসু নির্বাচন দেওয়ার মাধ্যমে তাদের শিক্ষার্থীবান্ধব অবস্থান পরিষ্কার করবে।

রাবি শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সুলতান আহমেদ রাহি বলেন, রাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের একটা প্রাণের দাবি। আমরা সবসময়ই চাই, রাকসুসহ সারাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হোক। রাবিতে সিন্ডিকেট, ডিন, শিক্ষক, কর্মচারীসহ অন্যান্য আরো অনেক নির্বাচন হয়, কিন্তু রাকসু নির্বাচন হয়না তিন দশক ধরে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরই সদিচ্ছা নাই বলে আমি মনে করি। ছাত্ররাও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্ব করুক, এটা তারা চাইনা। তবে, আমরা ছাত্রদল সবসময়ই রাকসু নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত আছি।

রাবি শাখা ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মহব্বত হোসেন মিলন বলেন, ১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গঠিত সংলাপ কমিটির নানারকম তালবাহানা আমরা লক্ষ্য করেছি। এজন্য, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রাকসু নির্বাচন দিতে প্রস্তুত দাবি করলেও, আমরা মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই রাকসু নির্বাচন চাইনা। এর কারণ হলো রাকসু নির্বাচন হলে এখনকার মত তখন তারা একচেটিয়া ক্ষমতাচর্চা করতে পারবেনা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাই না রাকসুর নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায় হোক। এজন্য তারা নির্বাচন দিবো দিবো করে, এটাকে দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করছে।

তিনি আরও বলেন, তারা বারবার বলে যে ছাত্র সংগঠনগুলো নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত না, কিন্তু আমরা ছাত্র ফেডারেশন সবসময়ই রাকসু নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত আছি এবং আমরা এককভাবে প্যানেল দিতেও প্রস্তুত। বাকি ছাত্র সংগঠনগুলোরও একই অবস্থা। আর রাকসু নির্বাচনের দাবিতে শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করে কিছুদিনের মধ্যেই আমরা আবারও একটা আন্দোলনে যাবো।

বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী রাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক রনজু হাসান বলেন, শিক্ষার্থীদের মতামত তুলে ধরার অন্যতম মাধ্যম হলো ছাত্র সংসদ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা থাকেন, তারা শিক্ষার্থীদের মতামতকে ভয় পায়। এই কারণেই তারা কূটকৌশলে রাকসুসহ সকল ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ রাখতে তৎপর থাকে। আমরা দীর্ঘদিন থেকেই রাকসু নির্বাচনের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছি। আমরা চাই, খুব শীঘ্রই ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা সকলেই জানি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ব থেকে এপর্যন্ত হওয়া রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, কোটা আন্দোলনসহ সকল আন্দোলনে শিক্ষার্থীরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এজন্য, সকল সরকারই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ বা রাজনীতিকরণ করার মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর গণতন্ত্র চর্চা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টাকে ক্ষুণ্ণ করে এগুলোকে একেকটা রাজনৈতিক শাখা বানিয়ে রাখার চেষ্টা করে।

রাজনৈতিক সংগঠনসমূহের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের যৌক্তিক অধিকার আদায় করে নিবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

রাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া বলেন, রাকসু নির্বাচন আমাদের সকলেরই একটা প্রাণের দাবি। আমরা সকল প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনই চাই রাকসু নির্বাচন হোক এবং এবিষয়ে আমরা বারবার একত্রিত হয়েছি। আমাদের দিক থেকে কোনো সমস্যা আছে বলে আমার মনে হয়না। কিন্তু রাকসু নির্বাচন কেনো হচ্ছেনা, এবিষয়ে আসলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই ভালো বলতে পারবে।

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময়ে আমাদের যে দাবিগুলো থাকে, তার প্রথম দাবিটাই থাকে রাকসু নির্বাচন। এজন্য আমরা বারবার পদক্ষেপ নিয়েছি। আমাদের সকল সংগঠনের দাবির প্রেক্ষীতে এর আগের প্রশাসন একটা উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু কেনো সেই উদ্যোগটা থেমে গেলো, এটা আমিও জানিনা। তবে, এটা বলতে পারি যে রাবি শাখা ছাত্রলীগ সবসময় প্রস্তুত আছে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য।

রাকসু নির্বাচন বিষয়ে রাবি উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, নানা কারণেই রাকসু নির্বাচন বন্ধ হয়ে আছে। এক্ষেত্রে বর্তমানের তুলনায় পূর্বের কারণই বেশী বিবেচ্য। পূর্বে রাকসু নির্বাচন নিয়ে যে বাজে পরিস্থিতির তৈরি হতো, সেটিই এর বন্ধ থাকার পিছনে মূল কারণ। তবে ছাত্র সংসদ নির্বাচনতো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমেই ছাত্র নেতৃত্ব গড়ে উঠবে, যারা ভবিষ্যতে দেশকে নেতৃত্ব দিবে। এটা বন্ধ থাকার কারণে যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে উঠছে না। এজন্য অযোগ্য ব্যক্তিরা বিভিন্ন পদে আসীন হচ্ছে। যেটা দেশের জন্য মঙ্গলজনক না।

তিনি আরও বলেন, বর্তমান রাবি প্রশাসন চাই, সঠিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করে এবং সুস্থ্য পরিবেশ বজায় রেখে দ্রুত সময়ের মধ্যে রাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে। তবে, এজন্য সময় লাগবে। করোনার কারণে ক্লাস-পরীক্ষাসহ আমাদের কিছু কাজ জমা হয়ে গিয়েছিল। আমরা এগুলো অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সবার সহযোগিতায় সম্পন্ন করছি। ইতিমধ্যে রেজিস্ট্রার গ্রাজুয়েটের বিষয়টা নিয়ে কাজ শুরু করেছি।

সিন্ডিকেট কমিটি, শিক্ষক সমিতিসহ সকল নির্বাচন হচ্ছে, কিন্তু রাকসু নির্বাচন কেনো হচ্ছেনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অগ্রাধিকারের জায়গাটা খেয়াল রাখতে হবে। ইতিমধ্যে আমাদের ক্লাস, পরীক্ষা, শিক্ষার্থী মৃত্যুসহ অনেক কিছুর জন্যই সময় ব্যয় করতে হয়েছে। আর শিক্ষক সমিতিসহ বাকিগুলোর পরিসর অনেক ছোটো, কিন্তু রাকসু নির্বাচনের ক্ষেত্রে ৩০ হাজারের অধিক শিক্ষার্থীকে কাজটা করতে হবে, যেটা তুলনামূলক কঠিন ও সময়সাপেক্ষ একটা কাজ।

এছাড়া, আগের প্রশাসন একটা সংলাপের ব্যবস্থা করেছিল, তারা এখন আর না থাকায়, বর্তমান প্রশাসন সকলের সাথে কথা বলে একটা ব্যবস্থা নিবেন বলেও আশ্বস্ত করেন উপ-উপাচার্য।

পূর্বপশ্চিমবিডি/এইচএ/জেএস

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close