• সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

রাজনৈতিক পরিচয়ই ভিসি নিয়োগে যোগ্যতার মাপকাঠি

প্রকাশ:  ৩১ জানুয়ারি ২০২২, ০১:২৪
বিশেষ প্রতিনিধি

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগ দেয় সরাসরি সরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি নেই। উপাচার্য হওয়ার জন্য একজন শিক্ষকের প্রধান যোগ্যতা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক পরিচয়, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বা আনুগত্য। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অনেক কর্মকাণ্ড নানা সময় যে বিতর্ক সৃষ্টি করছে, সেজন্য ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রভাবকে বড় কারণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

শিক্ষার্থীদের মান সম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করাই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রধান দায়িত্ব। তবে অনেকের বিরুদ্ধেই অভিযোগ আছে পাঠদানের চেয়ে রাজনীতি চর্চাই তাদের কাছে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। রাজনৈতিক পরিচয়ে নানা রঙে শিক্ষদের বিভক্তির দিকে চোখ রাখলেই এর প্রমাণ মিলে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নীল দল হলো আওয়ামী লীগপন্থীদের৷ বিএনপি- জামায়াতের সমর্থক শিক্ষকদের দল সাদা৷ বামপন্থীরা আছেন গোলাপী দলে। আবার চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক শিক্ষকদের দল হলুদ৷

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সাম্প্রতিক সময়ে বার বার আলোচনায় ওঠে আসা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অবশ্য রঙ দিয়ে বিভক্তি টানেননি। সেখানে আছে আওয়ামী লীগ সমর্থক শিক্ষকদের দুইটি গ্রুপ, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তচিন্তা চর্চায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ৷ বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকরা আছেন মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মূল্যবোধে শ্রদ্ধাশীল শিক্ষক ফোরামে৷

দেশে বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৪৮টি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার মান নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন ওঠছে।বিশ্লেষকরা মনে করেন; উচ্চশিক্ষার মান পড়ে যাওয়া, আন্তর্জাতিক মর্যাদাক্রমে (র‍্যাংকিংয়ে) বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম না থাকা, দু-একটি নাম থাকলেও তা তলানিতে চলে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যোগ্য উপাচার্য না থাকা। বিশ্লেষণে দেখা যায়, ​বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যোগ্য অধ্যাপকদের উপাচার্য করা হচ্ছে না। যোগ্যদের অনেকে আবার ওই পদে যেতেও চান না। অনেকের ইচ্ছা থাকলেও রাজনৈতিক দৌড়ে পিছিয়ে পড়েন। আর এসব কিছু মিলিয়ে উপাচার্য পদ অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য বা অতিমাত্রায় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের কাছে চলে যাচ্ছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র চারটি ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের মাধ্যমে পরিচালিত হয়৷ ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়৷ বাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটির জন্য আলাদা আইন আছে৷

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একজন উপাচার্য জানান, ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ করার কথা সিনেটে ভোটের মধ্য দিয়ে তিনজনের প্যানেল থেকে একজনকে৷ আর অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের প্যানেল করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়৷ কারণ শিক্ষা মন্ত্রণালয় আচার্যের (রাষ্ট্রপতি) সেক্রেটারিয়েট হিসেবে কাজ করে৷ রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিয়ে উপাচার্য নিয়োগ দেন৷ কিন্তু অধ্যাদেশভুক্ত একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো সিনেটের মাধ্যমে প্রস্তাব যায়৷ বাকি তিনটিতে সেটা আর হয় না৷ কিন্তু সিনেট যে তিনজনের প্যানেল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায় সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিয়ে একজনকে নিয়োগ দেন৷ ফলে যা হয়েছে, কে ভিসি হবেন তা পুরোপুরিই সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে৷ তাই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য না থাকলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়া সম্ভব নয়৷

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ৪৮টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মধ্যে ৩৯ জনই সরাসরি সরকার দলীয় শিক্ষক সংগঠন বা দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন আগে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের সদস্য ছিলেন৷ আর বর্তমানে ওই দলের সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠন বা ক্যাম্পাস ভিত্তিক সরকার সমর্থক প্যানেলের সদস্য৷ যেমন: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন৷ ভিসি হওয়ার পরও তিনি যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন৷ তিনি ভিসি থাকা অবস্থায় ওই পদ ছেড়ে যুবলীগের চেয়ারম্যান হওয়ারও আগ্রহ প্রকাশ করেন৷

সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত এক ডজন ভিসিকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে৷ কেউ পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন৷ কেউ আবার ছুটি নিয়ে ঢাকায় থেকে মেয়াদ পূর্ণ করে বিদায় নিয়েছেন৷ তাদের মধ্যে কয়েকজন আছেন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন৷ বর্তমানেও আছেন যারা সরাসরি ছাত্র রাজনীতি করতেন৷

ভিসি নিয়োগে রাজনৈতিক পরিচয় গুরুত্ব দেওয়া প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, আগে উপাচার্যদের যে অবস্থান, সম্মান, মর্যাদা, আত্মসম্মানবোধ ছিল সেটা কমে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, গাড়িতে তারা যখন থেকে পতাকা লাগাতে শুরু করলেন, বোঝা গেল তারা ভিন্ন অবস্থানে চলে যাচ্ছেন। একজন উপাচার্যকে তো মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা সংসদ সদস্যের সঙ্গে তুলনা করার কোনো কারণ নেই। তারা তো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, কিন্তু উপাচার্য তো অ্যাকাডেমিক ব্যক্তিত্ব।

তিনি বলেন, আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে রাজনীতি ঢুকে গেছে। রাজনীতির কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়াও দুর্বল হচ্ছে। এক সময় যোগ্যতাই ছিল একমাত্র মাপকাঠি, কিন্তু এখন দলের প্রতি আনুগত্যটাও গুরুত্ব পায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতিকরণ শিক্ষকদের মর্যাদা অনেকটাই ক্ষুণ্ণ করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক সাবেক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, সরকার রাজনৈতিকভাবে বশংবদ শিক্ষকদের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছে৷ তাদের মেধা, মনন বিবেচনা করা হচ্ছে না৷ ফলে অন্তত এক ডজন ভিসির বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে৷ ক্যাম্পাস অশান্ত হয়ে উঠছে৷ ৭৩-এর অধ্যাদেশেও ত্রুটি আছে৷ সারাবছর শিক্ষকদের নির্বাচন করতে হয়৷ তাহলে শিক্ষকেরা পড়াবেন কখন৷ আর সেখানে শিক্ষকদের জবাবদিহিতা কোথায় তা নিশ্চিত করা হয়নি৷ ফলে তারা অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কাজ করেন৷

এ পরিস্থিতিতে ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগে সার্চ কমিটির প্রস্তাব করেন যা পাশের দেশ ভারতে আছে৷ তবে এই সার্চ কমিটি হতে হবে সরকারের প্রভাবমুক্ত শিক্ষাবিদদের নিয়ে৷ তারাই সার্চ করে ভিসি নিয়োগ দেবেন৷ সরকার যেভাবে করছে তাতে যোগ্য ভিসি পাওয়া সম্ভব নয়৷

ভিসি নিয়োগ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সচিব ফেরদৌস জামান বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগে ইউজিসির কোনোই ভূমিকা নাই৷ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগে ট্রাস্টি বোর্ড তিনজনের প্যানেল পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে৷ শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমাদের কাছ থেকে মতামত নেয় মাত্র৷

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে তারা বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তদন্তও করেছেন জানিয়ে ফেরদৌস জামান জানান বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য বিদায়ী ভিসি যে অবৈধভাবে বড় ধরনের নিয়োগ দিতে যাচ্ছেন বিদায়ের আগে আমরা সরকারকে জানিয়েছিলাম৷ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দুর্নীতির তদন্ত করেছি৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতির তদন্ত করেছি৷ তবে তেমন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷

তিনি বলেন, ভিসি নিয়োগে আমাদের উচ্চশিক্ষা কমিশনের প্রস্তাব আছে৷ যেটা ইউজিসির মাধ্যমেই করার কথা আমরা বলছি৷ আমরা ভিসি হওয়ার যোগ্যদের তালিকা করব৷ তাদের ডাটা সংরক্ষণ করব৷ সরকার সেখান থেকেই নিয়োগ দেবে৷ কিন্তু তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না৷

সম্প্রতি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে শিক্ষার্থীরা। উপাচার্যের দায়িত্ব পালনকালে স্বেচ্ছাচারিতা, একগুঁয়েমি, বেপরোয়া আচরণ ও বিতর্কিত নানা মন্তব্যের অভিযোগ ওঠে। বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী ছাত্রী হলের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় নজিরবিহীনভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে পুলিশি অ্যাকশনের ফলে তা শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীর তুমুল আন্দোলন গড়ে ওঠলেও তিনি ছিলেন অনড় অবস্থানে। গণমাধ্যমের কাছে তিনি বলেছেন, কেবল সরকার চাইলেই তিনি পদত্যাগ করবেন।

দ্বিতীয় মেয়াদে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দায়িত্ব পালন করা অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ নিয়োগ পেয়েছেন রাজনৈতিক পরিচয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক আওয়ামী লীগ সমর্থক নীল দলকে নের্তৃত্ব দিয়েছেন দীর্ঘদিন। ২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি পদে নীল দলের প্রার্থী হিসেবে অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত পর পর তিনবার সরকার সমর্থিত নীল দলের প্রার্থী হিসেবে ঢাবি শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে জয়ী হয়ে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১তম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে। বর্ত️মানে তিনি ২য় মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বে আছেন।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে শাবির শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে গেলেও তিনি নিজ পদে অনড় অবস্থানে রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও আনুগত্যের কারণেই।

পূর্বপশ্চিম-এনই

ভিসি নিয়োগ,শাবিপ্রবি,শাবি,শাবিপ্রবি ভিসি
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close