• শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

ফুটওভার ব্রিজ ঘিরে সক্রিয় দুষ্কৃতকারীরা, সন্ধ্যা নামতেই বহুরুপে হানা

প্রকাশ:  ১৭ মার্চ ২০২২, ১১:৪৭ | আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২২, ১১:৫৯
নিজস্ব প্রতিবেদক

বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা। ল্যাম্পপোস্টের আলো পড়েছে রাস্তায়। বাংলামোটর হয়ে পরীবাগ ফুটওভার ব্রিজ পার হচ্ছেন আরমান। মাঝপথেই থামতে হলো তাকে। কারণ, একটু সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকজন নারী। সঙ্গে যুক্ত হলো আরও দু’তিনজন। তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে এলেন আরমানের দিকে। বললেন, কাজ করবেন কাজ? উত্তর দেওয়ার আগেই ব্যাগ থেকে কনডম বের করে আরমানের দিকে এগিয়ে দিলেন নারী দলের একজন। বললেন, এটা পরে নেন। রিস্ক নেই। কিছুটা বিব্রত এই পথচারী বৃহস্পতিবার (১৭ মার্চ) এভাবেই নিজের এমন অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছিলেন এ প্রতিবেদককে।

সরেজমিনে এনজিওকর্মীর পরিচয়ে ঘটনাস্থলে গেলে রাত ৯টার দিকে দেখা মেলে পদচারী সেতুটি ঘিরে ভবঘুরে মানুষের উপস্থিতি। তৈরি করা হয়েছে কাপড় আর প্লাস্টিকের কাগজ বেষ্টিত অস্থায়ী ঘর। ঠিক মাঝে কয়েকজন নারীও দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ, কারও হাতে আবার হ্যান্ডব্যাগ। জামাকাপড়ে কিছুটা ময়লা। কপালে কারও লাল আবার কারও কালো টিপ। মুখে গাঢ় মেকাপের ছাপ। শরীর ঢেকে রাখা বোরকা-হিজাবে। শুধু দেখা যায় মুখের কিছুটা অংশ।

প্লাস্টিকের কাগজ বেষ্টিত ঘরে উঁকি দিতেই চার জনের উপস্থিতি। তাদের তিনজন পুরুষ একজন নারী। পুরুষ তিনজন জড়ো হয়ে নিচ্ছেন মাদক। প্রতিবেদক এনজিওকর্মীর পরিচয় দিলে বেরিয়ে আসেন মেয়েটি। জানান, তার নাম মুন্নি। এখানেই থাকেন। স্থানটি ঘিরে এমন অসামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে জানতে চাইলে কিছুটা বিরক্তের সুরে বলেন- ‘এসব আমরা করি না। বাহির থেকে অনেকেই এসে করে।’

যদিও ফুটওভার ব্রিজটির ফুলবাগান, সিঁড়িসহ আশপাশে এমন অসামাজিক কার্যক্রমের দৃশ্য স্পষ্টই চোখে পড়ে। সঙ্গে পড়ে থাকতে দেখা যায় অসংখ্য ব্যবহৃত কনডম। আর ঠিক নিচ থেকেই নাকে আসছে প্রস্রাবের উৎকট গন্ধ। মানুষের প্রস্রাবে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে আশপাশ।

দিনেও স্থানটি ঘুরে দেখা মিলেছে একই দৃশ্যের। ব্রিজের নিচে ইনজেকশন সিরিঞ্জ দিয়ে মাদক নিচ্ছেন দুই মধ্যবয়সী পুরুষ। তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করছেন রমনা (ডিএমপি) ট্রাফিক পুলিশ সদস্য জামাল উদ্দিন। এ সময় তার কাছে মাদকের এমন ছড়াছড়ির বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘ওরা এখন আর ভয় পায় না পুলিশ দেখলে। এদের সংখ্যা এত বেশি, কয়জনকে না করব?

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর করণীয় কী- এমন প্রশ্নে এই পুলিশ সদস্য জানান, তিনি আজই প্রথম এ এলাকায় দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে কখনোই এখানে দায়িত্ব পালন করেননি। তবে তার দাবি- এই দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশের নয়।

শুধু পরীবাগ নয়, এমন চিত্র রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ফুটওভার ব্রিজের। সরেজমিনে কলাবাগান, শ্যামলী, মিরপুর-১, মিরপুর-১২, কাকরাইল ফুটওভার ব্রিজ ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। তারা জানিয়েছেন, দিনে মানুষের পদচারণায় মুখরিত থাকলেও রাত নামতেই ব্রিজগুলোর চিত্র পাল্টে যায়। পতিতা ও ছিনতাইকারীদের দখলে যায় ব্রিজগুলি। অনিরাপত্তার কারণে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার কমিয়ে দেন পথচারীরাও। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আরও ভুগতে হবে নগরবাসীকে- এমনটাই দাবি করেন তারা।

শ্যামলীতে কথা হয় রাকিব নামে এক দোকানির সঙ্গে। বলেন, এখানকার চিত্রও ভিন্ন নয়। শ্যামলী সিনেমা হল এবং ফুটপাতের ওপরে বেশকিছু মেয়দের উপস্থিতি দেখবেন। এদের দেখলেই চেনা যায়। মূলত খদ্দের (ক্রেতা) খুঁজতেই তারা ভিড় করেন।

এদিকে, মিরপুর-১ ফুটওভার ব্রিজটিতে দেখা যায়- সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় কিছু বখাটের আড্ডা চলছে। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা পতিতাদের দ্বারা পথচারীরা অশালীন ভঙ্গি ও আহ্বানের শিকার হচ্ছে। এ সময় তাদের ছবি তুলতে চাইলে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা বখাটের দলটি এসে পতিতাদের পক্ষ নিতে দেখা যায়।

আরিফুর নামে এক পথচারী বলেন, ‘এদের সাথে বাক-বিতণ্ডায় না জড়ানোই ভালো। এরা বড় এক সিন্ডিকেট। বখাটে ছেলেগুলোও ওদেরই লোক। কিছু বললে তেড়ে আসে। টাকা-পয়সা, মোবাইলসহ সব খোয়াতেও হতে পারে।’

ক্রমাগত অপরাধ বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, সর্বত্র ধর্ষণ, আত্মহত্যা, খুন, শিশু নির্যাতন, সন্ত্রাসবাদ, মাদক, মারামারি আর হানাহানির খবর। সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ নৈতিক অবক্ষয়। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সীমাবদ্ধতার কারণে আইনের শাসনে সঠিক প্রয়োগ নেই।

ড. নেহাল করিম বলেন, সামাজিক অবক্ষয়, নির্যাতন, ধর্ষণসহ যৌনতা বৃদ্ধির মূলে রয়েছে আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সীমাবদ্ধতা। যেখানে সবচেয়ে বেশি কাজ করে রাজনৈতিক প্রভাব। রাজনৈতিকভাবে অপরাধীরা প্রায়শই প্রশ্রয় পেয়ে যায়।

সর্বত্র বেড়ে যাওয়া যৌনতা কমাতে করণীয় কী জানতে চাইলে অধ্যাপক নেহাল করিম বলেন, ধর্ষণের ঘটনা বন্ধ করতে মানুষের যৌন চাহিদা মেটানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। যৌন চাহিদা মেটানোর ইচ্ছা সব মানুষের সহজাত চাহিদা। এ চাহিদা মেটানোর ব্যবস্থা না থাকলে অনেকে ভিন্ন পথে যাবেই। দেশের শিল্প এলাকায় ও বড় বড় শহরে জৈবিক চাহিদা মেটানোর ব্যবস্থা (যৌনালয় বা পতিতালয়) থাকতে হবে। যা থাকতে হবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়। প্রতিটি দেশেই এমন ব্যবস্থা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি অরও বলেন, আমাদের দেশে ধর্মের কথা বলে এ সকল বিষয় চাপিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়।

পূর্ব পশ্চিম/জেআর

অপরাধ
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close