• শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

দুই সিবিএ নেতার কাছে জিম্মি রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান গাজী ওয়্যারস

প্রকাশ:  ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৫:৫৮ | আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৬:০৮
জুবাইর হোসাইন সজল
পিতা গোলাম মোস্তফা ও পুত্র মাসুদের রহমান

চট্টগ্রামের রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান গাজী ওয়্যারস কর্মচারি-শ্রমিক ইউনিয়নের (সিবিএ) সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা ২০১৭ সালে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। ৫ বছর আগে চাকরি শেষ হলেও তিনি এখনও সিবিএ’র দায়িত্ব পালন করছেন। তার ছেলে মাসুদের রহমান একই সিবিএ’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারিদের অভিযোগ, জাল সার্টিফিকেটে চাকরি নিয়েছেন তিনি। পিতা-পুত্রের দুজনেই সিবিএ’র প্রভাব খাটিয়ে চুরি, সনদ জালিয়াতি, চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন- এমন অভিযোগও করেছেন তারা। এসব অভিযোগ বেশ কিছু প্রমাণিতও হয়েছে। তবে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও ব্যবস্থা নিতে পারছে না প্রশাসন। কর্মকর্তা-কর্মচারি-শ্রমিকরা বলছেন, পিতা-পু্ত্রের কাছে পুরো প্রতিষ্ঠানটিই এখন জিম্মি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জাল সার্টিফিকেট দিয়ে ১৬ বছর ধরে চাকরি করছেন চট্টগ্রামের রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান গাজী ওয়্যারসের সিবিএ নেতা মাসুদের রহমান। এ ঘটনা অনুসন্ধানে গঠিত তদন্ত কমিটিতে সার্টিফিকেটটি ভুয়া প্রমাণিত হলে ফৌজদারী মামলাও করে প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ। তবে এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন, সার্টিফিকেট যাচাইয়ে শিক্ষা বোর্ডকে ৫ মাস আগে দেয়া চিঠি থানায় এখনো পৌছেনি। ফলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারছেন না পুলিশ।

সম্পর্কিত খবর

    খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে এইচএসসি পাসের যোগ্যতা দেখিয়ে গাজী ওয়্যারসে জুনিয়র করণিক হিসেবে যোগ দেন মাসুদের রহমান। পরে তার বাবা ও প্রতিষ্ঠানটির সিবিএ সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফার প্রভাবে সিবিএ’র যুগ্ন সম্পাদকের দায়িত্বও পান। পরে দুটো পদোন্নতিও পান তিনি। তবে ২০২০ সালের ২৪ আগস্ট বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনে তার সার্টিফিকেট জালিয়াতি নিয়ে অভিযোগ ওঠে। এরপরই শুরু হয় অনুসন্ধান। ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সার্টিফিকেটটিকে ভুয়া বলে উল্লেখ করা হয়।

    মাসুদের রহমানের চাকরির আবেদনপত্রে দেখা যায়, ১৯৯৮ সালে এইচএসসি পাস করেছেন তিনি। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, কুমিল্লা’র একটি এইচএসসি পাসের সনদ চাকরির আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দেয়া হয়। যার রেজিস্ট্রেশন নং ১১৪৩৪০, রোল নং- বেগমগঞ্জ-১, ৭৫১৫৩৭। অভিযোগ উঠলে সার্টিফিকেটটি যাচাইয়ে বোর্ডের কাছে পাঠায় এ ঘটনায় গঠিত গাজী ওয়্যারসের তদন্ত কমিটি। গাজী ওয়্যারসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর বোর্ড থেকে পাঠানো চিঠিতে সার্টিফিকেটটি ভুয়া বলে জানানো হয়।

    এ ঘটনায় ২০২১ সালের ১০ আগস্ট গাজী ওয়্যারসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির উর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবু সাঈদ পেনাল কোড ৪২০, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১, ৩৪ ধারায় মামলা করেন। একই মাসের ৩০ আগস্টকে সনদ যাচাইয়ে বোর্ডকে চিঠি দেন মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা চান্দগাঁও থানার উপ-পরিদর্শক আশরাফ হোসেন। তবে ওই যাচাইয়ের চিঠি বিগত পাঁচ মাসেও থানায় পৌছেনি।

    এ বিষয়ে আশরাফ হোসেন পূর্বপশ্চিমকে বলেন, পুলিশ মামলা রুজু করে সনদ যাচাইয়ের জন্য বোর্ডকে চিঠি দিয়েছে, তবে এর উত্তর এখনও পায়নি। তার দাবি, বোর্ড চিঠির উত্তর না দেয়াই তিনি মামলার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে পারছেন না।

    তবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, কুমিল্লা’র পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড মো: আসাদুজ্জামান পূর্বপশ্চিমকে বলেন, ‘সার্টিফিকেট যাচাইয়ে এত বিলম্ব হবার সুযোগ নেই। কী কারণে এমনটা হয়েছে, খতিয়ে দেখছি।’

    শুধু সার্টিফিকেট জালিয়াতি নয়, দুই সিবিএ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে নিয়োগ বাণিজ্যেরও। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৮ সালে ২২ জন, ২০১৯ সালে ২৬ জন শ্রমিক-কর্মচারিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ আছে, এসব নিয়োগে দুই সিবিএ নেতা জনপ্রতি দুই থেকে তিন লাখ টাকা করে নিয়েছেন। নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে শ্রমিক হিসেবে গোলাম মোস্তফার ভাই গোলাম মর্তুজা, গোলাম সারোয়ার, রেকর্ড কিপার পদে ভগ্নিপতি খলিল উল্লাহ, ভাগিনা হাসানও রয়েছেন।

    এদিকে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, গোলাম মোস্তফার আরেক সন্তান ফয়ছাল রহমানও ভুয়া সনদ দিয়ে রেকর্ড কিপারের চাকরি পেয়েছেন। তিনি নাজিরিয়া নাঈমিয়া মাহমুদিয়া সিনিয়র মাদরাসা থেকে অষ্টম শ্রেণি প্রর্যন্ত পাস করেছেন। তবে অভিযোগ উঠেছে, এই সনদও জাল।

    অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ২০০১ সালে ১০ লাখ টাকার তামার তার চুরির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ওই সময় এ নিয়ে থানায় অভিযোগও দেয়া হয়। অভিযোগের কপি এ প্রতিবেদকের নিকট রক্ষিত আছে। ওই অভিযোগে বলা হয়, ওই বছরের ১৮ অক্টোবর তামার তার ভর্তি ৫-৬ টন মালামাল ইউনিয়ন নেতারা নিয়ে যান। এসব অভিযোগ তদন্তে ওই সময় কমিটি গঠন করা হয়। তবে ওই তদন্তের কোনো কুল কিনারা হয়নি।

    এ বিষয়ে জানতে গাজী ওয়্যারসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাব্বির আওয়ালকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও সাড়া দেননি। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সিবিএ সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা দাবি করেন, তিনি ব্যস্ত আছেন। কথা বলতে পারবেন না। এসব বিষয়ে তার ছেলের সঙ্গে আলাপ করতে বলেন।

    তার ছেলে ও সিবিএ’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সকল অভিযোগ অস্বীকার করে পূর্বপশ্চিমকে বলেন, বাবা ২০১৭ সালে অবসর গ্রহণ করলেও শ্রম আইন অনুসারেই সিবিএতে দায়িত্ব পালন করেন। তার দাবি, শ্রম আইনের ১৮০ ধারা অনুসারে সিবিএ’র ১০ ভাগের এক ভাগ কর্মচারি নিয়মিত শ্রমিক-কর্মচারীর বাইরেও নির্বাচন করতে পারবেন।

    তিনি দাবি করেন, ২০২০ সালের অক্টোবরে গঠনতান্ত্রিক নিয়ম মেনে নির্বাচন করে সিবিএ’র দায়িত্ব পেয়েছেন। জাল সনদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এইচএসসি পাস না করার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমি এসএসসি সনদের কপি দিয়ে চাকরি পেয়েছি। এইচএসসি সনদ জমাই দিইনি। যে সনদের কথা বলা হচ্ছে, এই সনদ গাজী ওয়্যারসের মেশিন কেনা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তৈরি করে জমা দিয়েছে। আমি এসবের সঙ্গে জড়িত না।

    মাসুদের রহমান দাবি করেন, দুর্নীতির বিরোধিতা করার তাকে ফাঁসাতেই এই সনদ দাখিল করে ভুয়া কাগজপত্র বানানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, চুরি, নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগও ভুয়া বলে তিনি দাবি করেন।

    এ বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে বলেও জানান তিনি।

    পূর্বপশ্চিমবিডি/জেএস

    গাজী ওয়্যারস
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close