• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক সৈনিক আবদুর রাজ্জাক

প্রকাশ:  ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭, ১২:১২
বাহালুল মজনুন চুন্নু

আবদুর রাজ্জাক এমন একজন কীর্তিমান পুরুষ যিনি বঙ্গবন্ধুর স্নেহছায়ায় থেকে মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন, ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি আমৃত্যু অবিচল। কর্মনিষ্ঠা এবং আদর্শের প্রতি একনিষ্ঠ কর্মী হয়ে নিরলস শ্রমের মাধ্যমে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনা ধারণকারী জনকল্যাণকামী একজন নেতা হিসেবে। এ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি হয়ে উঠেছিলেন নির্লোভ, সৎ, ত্যাগী, সাহসী, স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী এমন একজন সফল রাজনৈতিক, যার চেতনায় সর্বদাই বিরাজ করত দেশ ও সমাজের কল্যাণ। আদর্শবাদ, সততা ও মানবতার ধারা বজায় রেখে সমগ্র জীবনপথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। সমাজহিতৈষী নির্মোহ রাজনীতিবিদ রাজ্জাক ভাই ছিলেন সৌম্য-শান্ত-নম্র অথচ দৃঢ়চেতা মনোভাবের এক মূর্ত প্রতীক, যিনি সময়কে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন আপন কীর্তি দ্বারা। তাই তো তিনি আমাদের মাঝে স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে থাকবেন আজীবন।

আবদুর রাজ্জাক কেবল যে বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন ছিলেন তা নয়, তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নপূরণে ছিলেন এক বিশ্বস্ত যোদ্ধা। তিনি সব সময় বলতেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর একজন শিষ্য, এটাই আমার একমাত্র পরিচয়।’ বাষট্টি সাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকে সারা দেশে জনপ্রিয় করতে সীমাহীন পরিশ্রম করেছিলেন। এ জন্য তাকে কারাগারেও যেতে হয়েছিল। অসম্ভব মেধাবী এবং নেতাকর্মীদের কাছে জনপ্রিয় নেতা আবদুর রাজ্জাক দুবার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অসামান্য হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন বলেই সারা বাংলার ছাত্র সমাজের নয়নমণি হয়েছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য তার এক বিশ্বস্ত সৈনিক হিসেবে রাজপথ থেকে শুরু করে জেলজীবনে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে করতেই এক সময় রাজ্জাক ভাইয়ের উত্তরণ ঘটে জাতীয় নেতা হিসেবে। বৃদ্ধি পায় তার কর্মপরিধি, ব্যস্ততা। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পায় ব্যক্তিগত জীবনচাহিদার ত্যাগের পরিধিও। রাজনীতির মাঠ কাঁপিয়ে, সারা দেশ চষে বেড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক সারা দেশের মানুষকে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করাই ছিল যেন তার জীবনের একমাত্র ব্রত।

সম্পর্কিত খবর

    দীর্ঘ সংগ্রাম পরিক্রমার চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যখন স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ শুরু হয়, তখন তিনি নিজ জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। ওই সময় গঠিত মুজিব বাহিনীর একজন সংগঠক ও রূপকারও ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের মেঘালয়ে মুজিব বাহিনীর সেক্টর কমান্ডারের (মুজিব বাহিনীর চার সেক্টর কমান্ডারের একজন) দায়িত্ব পালন করেছেন। দেরাদুনে ভারতের সেনাবাহিনীর জেনারেল উবানের কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়া এই বীরযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা প্রশিক্ষকও ছিলেন। যুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শুরু করেছিলেন দেশ গড়ার কাজ। যে আদর্শ নিয়ে স্বাধীন দেশে পথচলা শুরু করেছেন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার যে শপথ নিয়েছিলেন, সেই পথে তিনি সংগঠিত করেছিলেন সাংগঠনিকভাবে দলকে। কিন্তু সব রক্ষা হয়নি। দলের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা খুনির দল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে ইতিহাসের চাকাকে ঘুরিয়ে দেয়। স্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। আবদুর রাজ্জাককে জেলখানায় আটকে রাখা হয় টানা সাতাশ মাস। বঙ্গবন্ধুর দীক্ষা তাকে দুঃসাহসী করেছিল। নিশঙ্ক চিত্তে তিনি শত নির্যাতন, শত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করেছেন। জেলখানায় বসেও দল চালাতেন। তারই নির্দেশে নেওয়া হয়েছিল দল পরিচালনার নানা কর্মপরিকল্পনা।

    পঁচাত্তর-পরবর্তী ক্ষমতা দখলকারীরা নানা প্রচেষ্টা চালিয়েও আবদুর রাজ্জাককে তাদের অনুগত করতে পারেনি। শত নিপীড়নেও তিনি কাবু হননি। সুবিধাভোগী বা সুযোগসন্ধানী হওয়ার অভিলাষের কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করেননি। সামরিক জান্তাদের শাসন-শোষণ-নিপীড়নে যখন কর্মীরা অসহায়, তখন জেল থেকে মুক্ত হয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সামরিক স্বৈরাচারীরা দেশকে পাকিস্তানের করতলগত করার জন্য সংঘাত, সংক্ষুব্ধ, গুম, খুনসহ অরাজক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাওয়ার যে কূটকৌশল চালিয়েছিল, রাজ্জাক ভাই সর্বদাই ছিলেন এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তীব্র প্রতিবাদী এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। রাজ্জাক ভাই ছিলেন দূরদর্শী-বিচক্ষণ এক রাজনীতিবিদ, তাই তিনি বুঝেছিলেন এই বাংলায় আওয়ামী লীগের ঐক্য ধরে রাখার জন্য, আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার জন্য বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারী শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। তাই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি বানাতে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, স্বৈরাচারী সামরিক সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জননেত্রীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে সাফল্যমমণ্ডিত করে স্বৈরাচারী সামরিক সরকারের পিলে চমকে দিতে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও রাজ্জাক ভাইয়ের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক মহান ধারক। ছিলেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামী একজন নেতা। নব্বই দশকের শুরুতে শহীদ-জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ব্যানারে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণআন্দোলনের তিনি ছিলেন অন্যতম এক সক্রিয় সৈনিক।

    ব্যক্তিত্ব, রুচিবোধ, সততা, নিষ্ঠা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞায়, সৌজন্যে এবং উদারতায় আবদুর রাজ্জাক রাজনীতির জগতে এক অনুপম ও অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত। এক জীবনে দিয়েছেন যা, আদর্শ হয়ে তা চিরজাগরূক। বৃহত্তর পরিধিতে দেশ, সমাজের কথা ভেবেছেন এবং দেশ ও সমাজের উন্নতির জন্য কাজও করেছেন। পরিশ্রম এবং আত্মত্যাগের ব্রত ছিল পুরো জীবনভর। শোষিত, বঞ্চিত মানুষের সুখ-দুঃখ, কল্যাণ এবং মঙ্গলে থেকেছেন পাশে পাশে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে থেকেছেন, সাধারণের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা ভেবে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। দুঃশাসনের বিরুদ্ধে, সামরিক জান্তার শাসনের বিরুদ্ধে একাগ্রচিত্তে লড়াই করেছেন। চরিত্র, আচার-আচরণ, কর্মকা- ও আদর্শ সব মিলিয়ে আবদুর রাজ্জাক পরিণত হয়েছিলেন জননেতায়। শ্রম, কর্মনিষ্ঠা, কর্মকুশলতা সর্বোপরি আদর্শের প্রতি একনিষ্ঠ হয়ে নিরলস শ্রমের মাধ্যমে নিজেকে জনগণের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।

    জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শিক সৈনিক, তার স্নেহধন্য এবং চিন্তা-চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের অন্যতম এক শীর্ষযোদ্ধা, মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম বীর সেনানী, দুর্দিনে আওয়ামী লীগের হাল ধরা অনন্য সাংগঠনিক দক্ষতাসম্পন্ন নাবিক, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এবং জনগণের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের আজীবন সাহসী যোদ্ধা জাতীয় নেতা আবদুর রাজ্জাক আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তার কর্মময় স্মৃতিগুলো। রয়ে গেছে তার দেশপ্রেম এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল থাকার অমরগাথা। আজকে তার মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

    লেখক: সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close