• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

এবার বাঘে সিংহে কঠিন ব্যালটযুদ্ধ

প্রকাশ:  ১৪ নভেম্বর ২০১৮, ০৩:৫৩ | আপডেট : ১৪ নভেম্বর ২০১৮, ০৪:১১
পীর হাবিবুর রহমান

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে সব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, জল্পনা-কল্পনা ও উত্তেজনার অবসান ঘটেছে। নাটকীয় সংলাপের মধ্য দিয়ে নেপথ্যের কুশীলবরা সব দলের অংশগ্রহণে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের মুখোমুখি দেশকে দাঁড় করাতে পারায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে মানুষ। মানুষ বরাবর দ্বিধাহীন চিত্তে সংঘাত-সহিংসতা নয়, উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচনের গণরায় দেখতে চেয়েছে। দেশের রাজনীতি এখন কার্যত সেই ব্যালটযুদ্ধের উৎসবের পথে হাঁটছে।

সম্পর্কিত খবর

    জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন সাংলাপ চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লিখে যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সময়মতো সেই ক্যাচ মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা লুফে নেওয়ায় নির্বাচনী রাজনীতি সংলাপে গড়িয়েছিল। তখনই আশার আলোর রেখা ফুটে উঠেছিল।

    সংলাপে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, সংসদ ভেঙে দেওয়া, নির্দলীয় সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ যে সাত দফা দাবি দিয়েছিল সে দাবিগুলো সংবিধানসম্মত নয় ও আদালতের এখতিয়ারভুক্ত বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাকচ করে দিলেও তাদের আশ্বস্ত করতে পেরেছেন একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন তিনি করতে চান এবং বিএনপির নেতা-কর্মীদের আর কোনো মামলা-নিপীড়ন বা হয়রানি করা হবে না। শেষ দফার সংলাপেও সংবিধান ও আদালতের বিষয়ে শেখ হাসিনা অনড় থাকলেও দুটো বৈঠকই হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আতিথেয়তা ও আন্তরিক আলোচনার কোনো ঘাটতি ছিল না। বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে বাধা না দেওয়ার অঙ্গীকারও কার্যকর হয়েছে।

    জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিতে গিয়ে নির্বাচন এক মাস পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। সরকার সেখানেও নির্বাচন কমিশন চাইলে তাদের আপত্তি নেই বলে জানিয়ে দিয়েছিল। নির্বাচনের পরিবেশ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত থাকবে বলেও প্রধানমন্ত্রী তাদের আশ্বস্ত করেছিলেন। যদিও বিএনপি এখনো অভিযোগ করছে, তাদের নেতা-কর্মীরা গ্রেফতার ও মামলার শিকার হচ্ছেন।

    নির্বাচন কমিশন সাত দিন পিছিয়ে ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ পুনর্নির্ধারণ করেছে। এ নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মনোনয়ন ফরম বিক্রি শেষ হতে না হতেই বিএনপিসহ অন্যান্য দলের মনোনয়ন ফরমও বিতরণ শুরু হয়। ধানমন্ডি থেকে পল্টন নিজ নিজ দলের নেতা-কর্মীদের আনন্দ-উৎসবে মুখরিতই নয়, রীতিমতো দেশবাসীর দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে। এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যালটযুদ্ধ বা ভোটযুদ্ধ আরেকটি বড় ধরনের উৎসব। জাতীয় রাজনীতিতে সে উৎসব আবার ফিরে এসেছে। এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এবারের মতো চড়া মূল্যে এত মনোনয়ন ফরম অতীতে আর কখনো বিক্রি হয়নি।

    টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের ৪ হাজারেরও বেশি নেতা-কর্মী ৩০ হাজার টাকা দিয়ে যেমন মনোনয়ন ফরম কিনতে কার্পণ্য করেননি, তেমনি কঠিন রাজনৈতিক বিপর্যয়ে পতিত, জেল-মামলা খেটে আসা বিএনপির নেতা-কর্মীরাও ৫ হাজার টাকায় মনোনয়ন ফরম কিনে ২৫ হাজার টাকায় জমা দেওয়ার শর্তে কার্পণ্য করেননি। এরশাদের জাতীয় পার্টি চড়া দামে বিপুলসংখ্যক মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে। এ দৃশ্যপট দেখে সরকারি দল বলতেই পারে, শেখ হাসিনার উন্নয়নের সুফল তারা একা নয়, কমবেশি সবাই ভোগ করেছেন।

    আমরা বরাবর বলে এসেছি, সব দলের অংশগ্রহণ বলতে দেশের জনপ্রিয় প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল এরশাদের জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য ছোট দলের অংশগ্রহণ বোঝায়। নির্বাচনে নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতে ইসলামী স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যদিকে দেশের সব রাজনৈতিক দল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটের পাল্লায় উঠেছে। আরেকদিকে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দল সংবিধান-প্রণেতা ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পাল্লায় উঠেছে। কার্যত এবার ভোট হবে; ভোটের লড়াই হবে জোটের লড়াইয়ে।

    সংলাপের মধ্য দিয়ে ভোট রাজনীতির ওপেনিং ম্যাচে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেন দুর্দান্ত ইনিংস খেলে গোটা দেশকে ভোটের ময়দানে নিয়ে এসেছেন। এখন গণরায় পর্যন্ত পুরো ইনিংসটি কতটা চমৎকার, উপভোগ্য এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে নন্দিত হবে তা নির্ভর করছে নির্বাচন কমিশন কতটা নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও সাহসিকতার সঙ্গে আম্পায়ারিং করে এবং সব দল কতটা বিধি-বিধান মেনে উৎসবের ভোটে লড়াই করে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন কতটা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে নির্বাচনকালে তাদের অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। বাদবাকি নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত সবার ওপর রয়েছে। এ মুহূর্তে নির্দ্বিধায় বলা যায়, যে রাজনৈতিক মেরুকরণ নির্বাচন ঘিরে ঘটে গেছে, তাতে ব্যালটের লড়াই বা ভোটের লড়াই কঠিন লড়াইয়ে পরিণত হচ্ছে। এবার ব্যালটযুদ্ধ হবে বাঘে-সিংহে। গণরায়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিজয়ী হোক বা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বিজয়ী হোক দেশের মানুষের জন্য সুখের সংবাদ হচ্ছে, এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা একটি শক্তিশালী, কার্যকর সংসদীয় শাসনব্যবস্থা পেতে যাচ্ছি। শক্তিশালী সরকারের পাশাপাশি শক্তিশালী বিরোধী দল সংসদকে সব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু করে জবাবদিহি আদায় করে মহান সংসদকে বিতর্কের ঝড়ে প্রাণবন্ত করে রাখবে। দুই পক্ষের সামনেই চ্যালেঞ্জ রয়েছে জনরায় নেওয়ার। বিশেষ করে আড়াই কোটি নতুন ভোটারের সমর্থন আদায় করার। এ ভোটারের সিংহভাগ রাজনৈতিক সচেতন হলেও রাজনৈতিকভাবে কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। তবে তারা মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করে এবং তাদের বুকে গভীর দেশপ্রেম রয়েছে।

    বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১০ বছরের শাসনামলে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের খুুনিদেরই নয়, যুদ্ধাপরাধীদেরও ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ দমনে বিশাল সাফল্য অর্জন করেছেন। সুশাসন প্রশ্নবিদ্ধ হলেও ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি ও বিদেশে দেশের অর্থ পাচার নিয়ে বিতর্কের ঝড় থাকলেও দেশে-বিদেশে সবাই বিস্ময়ের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। শেখ হাসিনা দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে গেছেন। পদ্মা সেতুর মতো বিশাল ব্যয়বহুল প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে সমাপ্ত করতে যাচ্ছেন। দেশজুড়ে যোগাযোগব্যবস্থাসহ বিভিন্ন খাতের ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছেন। বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ডই গড়েননি, দেশের তথ্য-প্রযুক্তির বিপ্ল­ব ঘটিয়েছেন। সীমান্তচুক্তিসহ অনেক অমীমাংসিত ইস্যুর সমাধান এনেছেন। নারীর ক্ষমতায়নে যেমন প্রসার ঘটিয়েছেন, তেমন মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছেন। যদিও দলের একদল উন্নাসিক, দাম্ভিক, লুটেরা নেতা-কর্মী শেখ হাসিনার আকাশছোঁয়া উন্নয়নকে ধূসর করে দেন। দুই বছর আগে থেকে শেখ হাসিনা বলে আসছেন, এবার কঠিন ভোটযুদ্ধ হবে। যারা সংশোধন করেছেন নিজেদের তাদের জন্য এখন শুভবার্তা। যারা সংশোধন করেননি তাদের বিপর্যয় ঘটছে। অনেকেই মনে করেছিলেন, শেখ হাসিনার উন্নয়নের গণজোয়ারে তারা ভেসে যাবেন সংসদে নৌকায় চড়ে। তারা এখন দেখছেন দলের জন্য শেখ হাসিনার উন্নয়ন ও নেতৃত্বের ইমেজই তাদের ভোটজয়ে তুরুপের তাস। যদিও লড়াই অনেক কঠিন।

    আগামীতে নির্বাচনে জয়লাভ করলে শেখ হাসিনা দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে, সুশাসন নিশ্চিত করতে, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালীকরণে কী অঙ্গীকার করেন; দেশের উন্নয়নের জন্য কী কী প্রতিশ্রুতি দেন তা দেখার জন্য নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

    অন্যদিকে বিএনপির সর্বশেষ শাসনামল রাজনৈতিক হত্যা, দুর্নীতি, গ্রেনেড, বোমা মিলিয়ে অভিশপ্ত হয়ে উঠেছিল। কারাবন্দী হওয়ার আগে বিএনপি চেয়ারপারশন বেগম খালেদা জিয়া ভিশন ২০৩০-এর নামে রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শন উপস্থাপন করেছিলেন। যেখানে প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি না করা, কার্যকর সংসদীয় শাসনব্যবস্থা, আইনের শাসন নিশ্চিত ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজেদের কঠোর অবস্থান তুলে ধরেছিলেন। আর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য জাতির মেধাবী সন্তান হিসেবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এসে নিজের প্রজ্ঞা ও মেধায় বিকশিতই করেননি, দল থেকে বেরিয়ে আসার পর তার প্রতিষ্ঠিত গণফোরামকে শক্তিশালী করতে না পারলেও সৎ মানুষের রাজনীতি, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ, দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান, আইনের শাসন ও সুশাসনের পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তারা ক্ষমতায় এলে নির্বাচনব্যবস্থা কী হবে, কীভাবে দুর্নীতি বন্ধ করবেন, সুশাসন নিশ্চিত করবেন, সংসদকে কীভাবে কার্যকর করে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবেন, তা জানার জন্য তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বিএনপির শাসনামলে বিনা বিচারে মানুষ হত্যার যে ধারা শুরু হয়েছিল তা এখনো চলছে। এ নিয়ে আগামীতে সরকারের পদক্ষেপ কী হবে তাও দুই পক্ষ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে তুলে ধরবে।

    শেখ হাসিনার একটি বড় সাফল্য আর যাই হোক অর্থনীতিবিরোধী হরতাল-অবরোধের রাজনীতিকে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন। আগামী নির্বাচনে যারাই বিজয়ীই হোন না কেন হরতাল-অবরোধের রাজনীতি যে আর ফিরে আসবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায়। দেশের মানুষ সুমহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি সামনে রেখে এবারের নির্বাচনকে গুরুত্বের সঙ্গেই নেয়নি, ৪৭ বছরের লালিত স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশাও করছে। কেবল সব দলের অংশগ্রহণের একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই চাইছে না; চাইছে নির্বাচন-পরবর্তী সংসদীয় শাসনব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। চাইছে আদর্শিক মূল্যবোধের রাজনীতি। রাজনীতিবিদরাই রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। আর প্রশাসন দলবাজির দলীয়করণমুক্ত হয়ে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে আইন, বিধি-বিধানের আলোকে অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে। রাজনীতিতে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধনই চাইছে না; চাইছে সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণ, আইনের শাসন ও সুশাসন নিশ্চিতকরণ, কার্যকর ও প্রাণবন্ত সংসদ যেখানে উভয় পক্ষ দায়িত্বশীলতার মধ্য দিয়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত হবে এবং আইনের ঊর্ধ্বে যেমন কেউ বাস করতে পারবেন না, তেমনি আইন সবার জন্য সমান হবে। দরিদ্রতা হটিয়ে দেশকে নির্মাণ করা হবে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে, যেটি সুমহান মুক্তিযুদ্ধের আশা-আকাক্সক্ষা লালন করে একটি দুর্নীতিমুক্ত অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে সম্মান অর্জন করবে। ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সব নাগরিক সমান অধিকারই ভোগ করবে না, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নজির স্থাপন করবে। শিক্ষাঙ্গনগুলোয় সব শিক্ষার্থী স্বাধীনভাবে বিচরণ করবে এবং তারা ছাত্র সংসদ নির্বাচনের অধিকার লাভ করবে। নিয়োগ বাণিজ্য, ভর্র্তি বাণিজ্য, তদবির বাণিজ্যের পথ রুখে দিয়ে বাজিকরদের হাত থেকে দেশটি মুক্ত হবে। সরকার ও বিরোধী দল সবার রাজনীতিই হবে গণমুখী, কল্যাণকর এবং অর্থনীতিবান্ধব। দেশ-বিদেশের ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে স্বস্তি ও আনন্দ পাবেন এমন পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে।

    নির্বাচন এলে দলের দুঃসময়ের হাল ধরা পথে পথে আন্দোলন-সংগ্রামে থাকা, জেল-জুলুম খাটা নেতা-কর্মীদের পেছনে ফেলে একদল সুযোগসন্ধানী ও ব্যবসায়ী মনোনয়ন নিয়ে যান। এতে দলের প্রতি অনুগত কমিটেড, ত্যাগী, আদর্শবান কর্মীরা রাজনীতির প্রতি হতাশ হয়ে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেন। আদর্শবান নেতা-কর্মীদের জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে তুলে আনা নেতৃ-ত্বের ওপর যেমন দায়িত্ব তেমনি বিতর্কিত গণবিরোধী কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত এমপি যাদের অতীত আমলনামা সুখকর নয় তাদের বাদ দেওয়াও নেতৃত্বের কাছে নৈতিক দাবি রাখে। ভোটের ময়দান থেকে বিতর্কিতদের, দুর্নীতিগ্রস্তদের মনোনয়নদানের ক্ষেত্রে দুই পক্ষ কতটা ভূমিকা রাখছে, তা জনগণ পর্যবেক্ষণ করছে।

    পশ্চিমা দুনিয়ায়ও অভিনয়জগৎ থেকে রাষ্ট্র পরিচালনায় গণরায় নিয়ে অনেকেই এসেছেন। পাশের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে দীর্ঘকাল ধরে নির্বাচনে বড় দলগুলোতে যুক্ত হয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মনোনয়ন নিয়ে লোকসভা থেকে রাজ্যসভায় ঠাঁই পাওয়ার ঘটনার অনেক নজির রয়েছে। বাংলাদেশে এবার অনেক নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা রাজনৈতিক কর্মীদের পেছনে ফেলে মিডিয়া কাভারেজের সুবাদে মনোনয়ন ফরম কেনায় এগিয়ে রয়েছেন। এ ক্ষেত্রে রাজনীতি যাতে হোঁচট না খায় তা বিবেচনায় রেখেই এদের মধ্য থেকে দলীয় রাজনীতির প্রতি পরীক্ষিত মূল্যায়ন করা জরুরি। গায়িকা মমতাজ সংসদে গান শুনিয়েছেন। অশ্লীল ছবির নায়িকা ময়ূরী বিএনপির মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। তথাকথিত হিরো আলম জাপার মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। একটি টিভিও তাকে লাইভে এনেছে আর গণমাধ্যমের ব্যক্তিরা তাকে প-িতের মতোন প্রশ্ন করেছেন। মহান সংসদ জাতির ভাগ্যনির্ধারক। এটা এত সস্তা নয় যে, গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে যে-সে এমপি হতে চাইবে। সেনাশাসনের সময় ছক্কা ছয়ফুর, কৃষক মোহাম্মদ সাদেকরা ভোট করে অনেক ভাঁড়ামি করেছেন। সংসদ নিয়ে এ ধরনের রসিকতা যাতে না হয়, এ ব্যাপারে সব দলের সতর্ক থাকা জরুরি।

    জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক নড়াইল এক্সপ্রেস খ্যাত মাশরাফি বিন মর্তুজাকে মনোনয়ন দিতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। দলমতনির্বিশেষে সবার প্রিয় মাশরাফি বিন মর্তুজা নড়াইল সদর থেকে নির্বাচন করতে যাচ্ছেন। এখানে আওয়ামী লীগ দাবার চালে কিস্তিমাত করেছে। ভদ্র-বিনয়ী মাফরাফি নড়াইলে সামাজিকভাবে সম্পৃক্ত। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানই নন, নিজের গণমুখী চরিত্রের স্বাক্ষরও রেখেছেন। মাঠ কাঁপানোর পাশাপাশি মানবিক হৃদয় নিয়ে এলাকার মানুষের জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী অনেক কাজও করেছেন। নিজে পাঁচ কোটি টাকার গাড়ি না নিয়ে নড়াইলের হাসপাতালের জন্য দুটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে তার নির্লোভ, মানবিক হৃদয় মেলে ধরেছিলেন। তার জন্য শুভ কামনা যেমন করছি, তেমনি বিশ্বনন্দিত অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে দলে না টেনে খেলার মাঠে মনোযোগী হতে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা যে তাগিদ দিয়েছেন তার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

    শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ভোটযুদ্ধের লড়াইয়ে জনপ্রিয়, শক্তিশালী, পরিচ্ছন্ন, ক্লিন ইমেজের প্রার্থী মনোনয়নে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন এমনটাই মানুষের প্রত্যাশা। দুই পক্ষেই এখন পর্দার অন্তরালে আসন বণ্টন চূড়ান্তকরণের কাজ চলছে। মহাজোটগত ও ঐক্যফ্রন্টগতভাবে দুই পক্ষই একই দিনে প্রার্থী ঘোষণা করার চিন্তা ভাবনা করছে। এটি বাস্তব উদ্যোগ। কারণ মহাজোট-ঐক্যফ্রন্টগতভাবে মনোনয়নপত্র দাখিলের আগেই প্রার্থী চূড়ান্ত না করলে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত যে কদিন হাতে থাকবে, সে কদিন দুই পক্ষের শরিক দলের প্রার্থীদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে। পরবর্তীতে কাউকে প্রত্যাহার করতে বললে মনে কষ্ট নিয়ে প্রত্যাহার করলেও নিজেদের মান-অভিমান কাটিয়ে উঠতে উঠতে নির্বাচন শেষ হয়ে যাবে। আর শুরুতেই মনোনয়নপত্র দাখিলের আগেই মহাজোটগত ও ঐক্যফ্রন্টগতভাবে একক প্রার্থী ঘোষণা করে দিলে একাধিক প্রার্থীর মধ্যে পরবর্তীতে মানসিক দূরত্ব ততটা তৈরি হবে না। শরিক দলের মাঠকর্মীদের মধ্যেও হতাশা ও বিভক্তি কাজ করবে না। সবচেয়ে বড় বিষয় সব দলের অংশগ্রহণে যে আনন্দঘন পরিবেশে ভোটযুদ্ধের সূচনা হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশে তার সমাপ্তি আসুক। ব্যালটের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জাতীয় জীবনে কার্যকর ও প্রাণবন্ত সংসদ, সরকার ও বিরোধী দল দেশ ও মানুষের কল্যাণে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখুক এটাই সবার প্রত্যাশা। [সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন]

    লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close