• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

বাংলা ভাষার পাশাপাশি আদিবাসীদের দাবি নিজস্ব ভাষা

প্রকাশ:  ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১১:১২
নওগাঁ প্রতিনিধি

আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা। এই মায়ের ভাষার জন্য রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে সালাম, রফিক,জব্বারসহ নাম না জানা অনেক শহীদরা। আর সেই ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল সংগ্রাম। আমরা শুধু এই ভাষার মাসেই নাড়াচাড়া করি ভাষাকে নিয়ে বাকি সময় তাকে তুলে রাখি শিকায়।প্রত্যেক জাতী গোষ্ঠির রয়েছে নিজস্ব ভাষা। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী/আদিবাসী হারিয়েছে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি। আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষায় কোন বই না থাকায় সময়ের পরিক্রমায় সাদ্রি ভাষা আজ বিলুপ্তের পথে। তাই ভাষার মাসে বাংলা ভাষার পাশাপাশি আদিবাসীদের দাবি নিজস্ব ভাষা অর্থাৎ সাদ্রি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন।

জানা গেছে, আদিবাসীদের/ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য নিজস্ব ভাষায় বই প্রকাশে ২০১০ সালে আইন প্রণিত হয়। সে মোতাবেক বাংলাদেশ সরকার পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ভাষায় বই প্রণয়ন করেন। সে লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ন-ৃগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বর্তমান সরকার নানামূখি উদ্যোগ গ্রহন করছে। বাংলাদেশে প্রায় ৪৮টি ক্ষুদ্র জাতীয় স্বত্ত্বা আছে। এর উত্তরবঙ্গে ২৯টির মতো ক্ষুদ্র জাতীয় স্বত্ত্বা রয়েছে। এরমধ্যে প্রধানত হচ্ছে সাঁওতাল, উরাও, পাহান, মালিমাহালি, ভূইমালি, পাহাড়ি ও রাজোয়ার। ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে সাদ্রি ভাষার বইয়ের চাহিদা ছিল ২শ ২২ টি। জেলার ১১টি উপজেলায় প্রায় পাঁচ লাখ আদিবাসী/ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর বসবাস।

সম্পর্কিত খবর

    আমরা ১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। এরমধ্যে ক্ষুদ্র জাতি স্বত্ত্বার অংশ গ্রহণও ছিল। কিন্তু সেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী/আদিবাসীদের আবারও তাদের মাতৃভাষার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। আদিবাসীরা এখন অনেক সচেতন হয়েছে। তারা তাদের সন্তানদের স্কুলগামী করতে আগ্রহী হচ্ছেন। শিক্ষা জীবনের শুরুতে তাদের মাতৃভাষা সাদ্রি ভাষায় কোন বই না থাকায় বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। বাংলা ভাষা বুঝতে না পারায় স্কুলে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যে ঝরে পড়ছে। নওগাঁর মহাদেবপুরে এমনই একটি আদিবাসী স্কুলে পড়াশুনা করছেন প্রায় দেড়শতাধিক আদিবাসী শিশু। নিজস্ব ভাষায় পাঠ্যপুস্তকে পাঠদান না থাকায় পড়তে হচ্ছে নানা সমস্যায়। আদিবাসী শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা তাদের বাবা মায়ের কাছ থেকে যে ভাষায় শিক্ষা নিয়েছে তা বাংলা বইতে নাই। ফলে পড়তে গিয়ে বুঝতে সমস্যা হয়।

    আদিবাসী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক হিরালাল পাহান বলেন, তার স্কুলে শিশু থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত ১৫১ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। দুইজন আদিবাসী ও দুই জন হিন্দু শিক্ষক আছেন। স্কুলে পাঠদান করতে গিয়ে কিছু সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ সেখানে বাংলা বই পড়ানো হয়। স্কুলে থাকে স্বল্প সময় আর বাড়িতে এই শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সময় কাটায়। খেলাধুলা, পরিবার ও সমাজে তারা তাদের মাতৃভাষায় অর্থাৎ সাদ্রি ভাষায় কথা বলে। কিন্তু স্কুলে পাঠদানের সময় বইয়ের বাংলা ভাষা বুঝতে পারে না। যার কারণে অনেকের অনীহা দেখা যায়। একসময় তারা আর স্কুলে আসতে চায় না। পড়াশুনা ছেড়ে দেয় এবং ঝরে পড়ে যায়।

    সহকারী শিক্ষক সনিতা রানী মন্ডল বলেন, স্কুলের সবাই আদিবাসী শিক্ষার্থী। তারা তাদের মাতৃ ভাষায় কথা বলে। প্রথমে যখন স্কুলে যোগদান করি তখন তাদের ভাষা বুঝতে পারতাম না। কিন্তু সময়ে পরিক্রমায় এখন অনেকটাই বুঝতে পারছি। বইয়ের ভাষার পাশাপাশি যদি আদিবাসীদের মাতৃভাষার বই থাকে তাহলে পড়া অনেক সহজ হবে এবং মূল পরিবেশের সাথে তারা তাল মিলিয়ে চলতে পারবে।

    মহাদেবপুর উপজেলা আদিবাসী পরিষদের উপদেষ্টা আজাদুল ইসলাম বলেন, আদিবাসী শিশুরা শিক্ষার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। আর পিছিয়ে থাকার অনেকগুলো কারণও আছে। তারমধ্যে অন্যতম একটি হলো ভাষাগত সমস্যা। যেহেতু তাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়, যার কারণে তারা সহজে বাংলা ভাষা বুঝতে পারেনা। বেশির ভাগ এ অঞ্চলের আদিবাসীরা সাদ্রি ভাষায় কথা বলে। একারণে তারা স্কুলে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যে ঝরে পড়ে। আর এ ভাষাগত সমস্যা যদি সমাধান করা যায় তাহলে আদিবাসী শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া সহজ হবে। আদিবাসীদের স্বতন্ত্র জাতী হিসেবে টিকিয়ে রাখতে হলে এ সংস্কৃতিগুলোর চর্চা এবং বিকাশের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাষ্ট্রিয় ভাবে গ্রহণ করতে হবে।

    বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের নওগাঁ জেলার সমন্বয়ক জয়নাল আবেদীন মকুল বলেন, বাংলাদেশে অসংখ্য ক্ষুদ্র জাতিস্বত্ত্বার বসবাস। আমরা মনে করি বাংলাদেশে আদিবাসীদের ভাষার যে বিকাশ এজন্য আদিবাসী ভাষার চর্চার প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে প্রাক-প্রাথমিক থেকে আদিবাসীদের ভাষায় বর্ণমালা প্রকাশ করে শিক্ষার ব্যবস্থা করা। পরবর্তিতে সেই শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে আসা। প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আদিবাসীদের শিক্ষার সংকট থেকে মুক্তি এবং তাদের ভাষার বিকাশ সম্ভব।

    নওগাঁ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বদরুজ্জেহা বলেন, জেলায় সাদ্রি ভাষার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আছে। বইয়ের চাহিদা অনুযায়ী সাদ্রি ভাষার ২শ ২২ টি বই জেলার সাপাহার এবং বদলগাছী উপজেলায় দেয়া হয়েছে। বইয়ের প্রতি তারা খুবই আগ্রহী। নিজস্ব ভাষায় যে বইগুলো তারা পেয়েছে এতে তাদের মেধা ও প্রতিভা বিকশিত করতে সহযোগীতা করবে। আদিবাসী শিশুরা যদি নিজেদের ভাষায় বই পড়তে পারে, তাহলে স্কুলে আসার আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। আগামী বছরের জন্য সাদ্রি ভাষার বইয়ের চাহিদা পাঠানো হয়েছে ২৯৫টি।

    সারাদেশ

    অনুসন্ধান করুন
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close