নীলা-হীরার আংটি, এক অন্য ভালবাসা
ডেভিড, আমার রোগী। ভিয়েতনামযুদ্ধ ফেরত, অবসরপ্রাপ্ত, এক শ্বেতকায়, আমেরিকান সৈনিক। যুদ্ধ কবেই শেষ হয়েছে। কিন্ত এর ভয়াবহ স্মৃতি দু:স্বপ্ন হয়ে ওকে সর্বদা তাড়া করে। প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা, অস্থিতিশীলতা, ক্রোধ আর মদে আসক্তির কারণে পরপর দুই স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যায়। একটি কন্যা বাদে বাকি ৩ সন্তানও ওকে ত্যাগ করে। দীর্ঘ সময় ধরে ডেভিড একাকী জীবনযাপন করছিল। এমন সংকটকালে ডেভিডের ২৫+ বয়সের কন্যাটি আকস্মিকভাবে মারা যায়।
প্রচণ্ড শোকে, ডিপ্রেশনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ও আত্মহত্যার চেষ্টা করলে তাকে মানসিক রোগ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনার এক বছর আগে ডেভিডের গলায় ক্যান্সার ধরা পড়ে। সার্জারী আর রেডিয়েশনের পর কন্ঠস্বর বদলে যাওয়াতে প্রথম দিকে ওর কথা বুঝতে আমার অসুবিধা হতো। ক্ষীণকায়, দুর্বল মানুষটি হুইল চেয়ারে চলাফেরা করে।
সম্পর্কিত খবর
এ অবস্থায় ডেভিড আমার রোগী হয়ে এসেছিল। ছয় মাস একটানা চিকিৎসার পরে মানসিকভাবে ও তখন অনেকটা সুস্থ। ও নতুন করে সুসময়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। আবার ডেটে যাবে, লজ্জিত মুখে বলতো সে কথা। একদিন ভিজিটে এসে কথার মাঝখানে ও বললো, তুমি আমার একটা কথা রাখবে? বললাম --রাখবো, বলো।
ডেভিড পকেট থেকে আংটির ছোট বাক্স খুলে টেবিলে রাখলো। বাক্সের ভিতরে নীলা আর ছোট ছোট হীরা বসানো একটা সোনার আংটি। ডক, আমি এই আংটিটা তোমাকে উপহার দিতে চাই। আমি আঁতকে উঠলাম, --মানে? --তুমি না বলো না, প্লিজ। ডেভিডের কন্ঠে অকৃত্রিম আকুতি।
আমি হতচকিৎ, কুঞ্চিত ভ্রু। সামান্য আতঙ্কগ্রস্তও। আমি উত্তর দেবার আগেই আবার ডেভিড, তুমি এটা নিলে আমি খুব সম্মানিত বোধ করব, ডক্টর আফরোজ। ট্রেসির ২৫তম তথা শেষ জন্মবার্ষিকী তে এটা আমি ওকে উপহার দিয়েছিলাম। ওর মৃতদেহ সনাক্ত করার পর ওর আঙুল থেকে আংটিটা আমি খুলে নিয়েছি,....ডেভিডের কন্ঠ বুজে আসছে। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, ওর চোখ মেঝের দিকে, পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমি ওর প্রিয় কন্যা ট্রেসির অকাল মৃত্যুর কথা আমি জানতাম।
--কিন্ত ডেভিড, এটা নিলে medical code of ethics ভঙ্গ করা হবে, আমি দুঃখিত! আমি এটা নিতে পারি না। তাছাড়া এটার অনেক দাম, তোমার কাজে লাগবে, রেখে দাও। ডেভিড কানে নেয়না এসব বাক্যাড়ম্বর।
--আমি জানি তোমার অনেক মুল্যবান গহনা আছে, সে সবের কাছে এটা খুব সামান্য। তুমি ব্যবহার করলে খুশি হব, না করলেও তোমার কাছে আছে জেনেই আমি আর আমার মেয়ে দুজনেই শান্তি পাবো। জানবো, এটা সম্মানে, যত্নে আছে। তুমি আমার জীবন বদলে দিয়েছো, ডক।
--তোমার কোন আত্মীয় না হলে কোন বন্ধুকে দাও, আমি বললাম। সিক্ত, বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে ডেভিড বললো --ট্রেসির সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছি আত্মীয়দের, এটা অবশিষ্ট, ওকে দেয়া আমার শেষ উপহার। তোমার জন্য রেখেছি। তুমি না নিলে খুব কষ্ট পাবো। ওর শান্তির কথা ভেবে আমি আংটিটা নিয়েছিলাম।
সেই থেকে আংটিটা আমার কাছেই আছে। কত বছর পার হয়ে গেল। এরপর যতবার ডেভিডকে দেখেছি, মনে করিয়ে দিয়েছি, যে কোন সময় বিনা দ্বিধায় আংটি ফেরত নিতে পারার শর্তের কথা। উত্তরে ওর উজ্জ্বল হাসিটা আমার অন্তরে ছড়িয়ে পড়ে আমার কর্মক্লান্তি মুছিয়ে দিত।
একটা আংটা লাগিয়ে সাইজ ছোট করে নিয়েছি। সুযোগ পেলে আংটিটা আমি পড়ি। আমার আর সব মুল্যবান অলংকার এটার কাছে দ্যুতি হারায়। এক দু:খী, বিদেশী যোদ্ধার কাছে পাওয়া সম্মান ও ভালবাসামাখা এই আংটি আমার জীবনে বিশাল এক স্থান করে নিয়েছে, শিখিয়েছে ভালবাসার ভিন্ন রূপ।
(লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া)