• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

বেদনার নীল দেহমন ও অনুভূতিকে অঝোরে কাঁদায়

প্রকাশ:  ০৪ আগস্ট ২০১৮, ০৫:৩০ | আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০১৮, ০৬:০১
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

আগস্ট মাসে গভীর শোকে আচ্ছন্ন থাকি। বিশেষ করে ১৫ আগস্টে একটা বেদনার নীল সারা দেহমন ও হৃদয়ের অনুভূতিকে অঝোরে কাঁদায়। তবু জীবন চলমান। প্রত্যয়ী হই, গত কয়েকটি বছরে যে বিরাট আর্থসামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ঘটেছে, তারই ধারাবাহিতকায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের 'দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর' সম্পদশালী, গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সবাই সর্বশক্তি নিয়োগ করে যেন কাজ করতে পারি।

দেশে ইতিহাস বিকৃতি ঘটেছে। ঘটছে। বিকৃতি ও বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে এখনো। আজকের নিবন্ধে তাই বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে কয়েকটি আলোচনার ওপর কিছু লিখতে চাই। শেখ মুজিবুরের রাজনীতি শুরু বাংলার মাঠে, প্রান্তরে, স্কুলে, কলেজে, হোস্টেলে। সব কিছু ছাপিয়ে তাঁর ছিল মানুষের জন্য ভালোবাসা; দুর্বলের পক্ষে ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। অসাম্প্রদায়িক ছিলেন আজীবন; কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত মুসলমানের প্রতি হিন্দুদের অন্যায্য আচরণ কখনো মেনে নেননি। নীতির প্রশ্নে আপসহীন শেখ মুজিব সামাজিক রীতিনীতি ও ব্যক্তিগত শিষ্টাচারের কারণে ছাড় দিতে পারতেন। তাই তো দেখি, প্রবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সর্বজনাব ওয়াহিদুজ্জামান, আবদুল্লাহ জহিরউদ্দিন লাল মিয়া ও ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া সম্পর্কে অত্যন্ত পরিশীলিত ভাষায় উল্লেখ করেছেন তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। ওয়াহিদুজ্জামানের শ্বশুর ও বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুবউদ্দিনের বাবা গোপালগঞ্জের এমএলএ খন্দকার শামসুদ্দিনের পরিবারের সঙ্গে শেখ পরিবারের আত্মীয়তা ও ঘনিষ্ঠতা ছিল। সে সুবাদে ও বিপদের দিনে পাশে দাঁড়ানোর তাগিদে খন্দকার শামসুদ্দিনের মেয়ে ও শেখ মুজিবের ঘোরতর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সহধর্মিণী বেগম ওয়াহিদুজ্জামানের সম্পত্তি বা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা যাতে বিঘি্নত না হয়, সে জন্য একান্ত সচিব হিসেবে আমার প্রতি সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল। সে সময় বঙ্গবন্ধুর যত বড় রাজনৈতিক শত্রুই হোক না কেন, বহুসংখ্যক কারান্তরালে থাকা অথবা সাময়িকভাবে অসুবিধাগ্রস্ত আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা নেতাদের অনেকেরই পরিবারের প্রতি রাষ্ট্রীয় অর্থানুকূল্য দেওয়া হতো উদার হস্তে।

বঙ্গবন্ধু একজন জেদি এমনকি একগুঁয়ে ব্যক্তি ছিলেন বলে জনশ্রুতি। তবে যুক্তিসংগত দ্বিমত অথবা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্নমত তিনি অনেকবার গ্রহণ করেছেন। ১৯৪০ সালে গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলের ফুটবল ক্লাবের নেতৃত্বে খেলোয়াড় ও ক্রীড়া সংগঠক শেখ মুজিব বনাম গোপালগঞ্জ অফিসার্স ক্লাবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক শেখ মুজিবের বাবা শেখ লুৎফর রহমান, এ দুটি ক্লাবের মধ্যে ফাইনাল খেলা পরপর পাঁচবার ড্র হয়। পরদিন সকালে ষষ্ঠবারের মতো খেলায় উৎসাহী শেখ লুৎফর রহমানের দল। তবে দু-এক দিন বিরতি নিয়ে খেলার পক্ষে শেখ মুজিব। অবশেষে প্রধান শিক্ষক শ্রী রসময় সেনগুপ্তের অনুরোধে শেখ মুজিব পরদিন সকালেই খেলতে রাজি হলেন ক্লান্তিতে পর্যুদস্ত তাঁর টিম হেরে যাবে জেনেও। ১৯৬৯ সাল। শেখ মুজিব আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তথা স্বাধীনতাসংগ্রামের আরেকটি অধ্যায় সূচনার দায়ে কারাবন্দি। দলের প্রবীণ নেতাদের কেউ কেউ ভুল পরামর্শ দিলেন যেন প্যারোলে আইয়ুব আহুত রাওয়ালপিন্ডি গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেন। বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব যিনি অতন্দ্র প্রহরায় ও বঙ্গবন্ধুকে বস্তুনিষ্ঠ পরামর্শ দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনে বিরাট অবদান রেখেছেন, তাঁর পরামর্শ ছিল, প্যারোলে যাওয়া ঠিক হবে না, স্বৈরশাসক নিজের প্রয়োজনেই এবং দেশের বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি সামাল দিতে শেখ মুজিবকে সসম্মানে মুক্তি দিয়ে হলেও পিন্ডি সম্মেলনে নিতে চাইবে। শেখ মুজিব শুনলেন সে কথা। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্সের মহাসমাবেশ। প্রচণ্ড চাপ বঙ্গবন্ধু যেন স্বাধীনতার সরাসরি ঘোষণা দেন। মওলানা ভাসানী এরই মধ্যে 'আসসালামু আলইকুম' বলে ফেলেছেন। ছাত্রলীগ অনঢ়। কিন্তু যুক্তির কাছে পরিস্থিতির পূর্বাপর বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু ঠিক করে ফেললেন, স্বাধীনতা চাই; কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদীর বদনামের বোঝা মাথায় বয়ে নয়। সৃষ্টি হলো শ্রেষ্ঠ রাজনীতির কবিতা। প্রত্যক্ষভাবে উচ্চারণ করলেন না স্বাধীনতা শব্দটি, কিন্তু কিছু বাদও রাখলেন না।

সুপুরুষ, দীর্ঘদেহী, বিশাল অবয়ব আর বৃহত্তর হৃদয়ের অধিকারী বঙ্গবন্ধুকে দেশ স্বাধীন করার রাজনীতিতে বারবার কুচক্রীরা বিতর্কে ফেলার চেষ্টা করেছে। স্বাধীনতার পর ৯৫ হাজার সদস্যের পাকিস্তানি পরাজিত সশস্ত্র বাহিনী ও ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দিকে ফেরত দেওয়ার ত্রিদেশীয় চুক্তি কেন করলেন সিমলায়, তা নিয়ে মহাবিতর্ক। অথচ সে সময় দুই বৃহৎ পরাশক্তির বিরোধিতার মুখে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রায় বিচ্ছিন্ন; বিশ্বব্যাপী আরো মিত্রের প্রয়োজন তীব্র। স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি তথা জাতিসংঘ সদস্যপদ যাতে না পাওয়া যায় তার জন্য দেশের কতিপয় 'বড়মাপের নেতা' পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ভেঙে হিন্দুস্তান বানানোর কথিত অভিযোগ প্রচারে আদাজল খেয়ে বদ প্রচারণায় লিপ্ত। আর বাংলাদেশের অনেক শ্রেষ্ঠসন্তানসহ লক্ষাধিক নাগরিক পাকিস্তানে আটক। তাই সিমলা চুক্তি করা ছাড়া আর কী বিকল্প ছিল তখন?

জাতির জনককে কেউ কেউ ভারততোষণের অত্যন্ত অসত্য ও অন্যায্য অপবাদ দিতে চেষ্টা করেন। মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলার দামাল ছেলেমেয়ে-বিচ্ছুরা প্রধানত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করলেও ভারতীয় প্রজাতন্ত্র, সে দেশের জনগণ, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাহসী ও সঠিক নেতৃত্বে বিশ্ববিবেক জাগ্রত না হলে স্বাধীনতা পিছিয়ে যেত। আর যৌথবাহিনীর নেতৃত্ব ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে না থাকলে আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাকিস্তান বাহিনীকে পরাজিত করতে হয়তো কয়েক বছর লেগে যেত। স্বাধীন বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুর দুয়ার থেকে মুক্তি পেয়ে ৯ জানুয়ারি ১৯৭২ লন্ডনে পৌঁছেন। সৌজন্য সাক্ষাতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি একটি প্লেন চান। বঙ্গবন্ধুকে বলা হলো, একটি পাকিস্তানি বিমান তাঁকে হিথরো নিয়ে এসেছে আর একটি ভারতীয় বিমান তাঁকে দিল্লি হয়ে ঢাকায় নিয়ে যেতে প্রস্তুত। ঘোর জাতীয়তাবাদী বঙ্গবন্ধুর পীড়াপীড়িতে রাজকীয় ব্রিটিশ সরকারের একটি বিমানেই তিনি দিল্লি যান। সেখানে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সৌজন্যমূলকতার ফাঁকে ফাঁকে কথা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ থেকে অচিরেই ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের অঙ্গীকার আদায় করেন বঙ্গবন্ধু। সম্ভবত বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় অবস্থানের প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। স্বদেশ ফেরত উদার পশ্চিমা গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসী বঙ্গবন্ধু স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে প্রধানমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব্ব গ্রহণ করেন। কী কপাল, সেখানেও অনেক ভাষ্যকার এ পরিবর্তনের কৃতিত্ব অন্য কাউকে দিতে চান। সিদ্ধান্ত হলো, দেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্নির্মাণের পূর্বশর্ত হিসেবে অবকাঠামো মেরামত ও সম্প্রসারণের পাশাপাশি মহান মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ফেরত নেওয়া হবে। আবারও ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সরলপ্রাণ মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশ সদস্য তাদের অস্ত্র জমা দিলেও বড় বড় বাহিনীর নেতারা নামেমাত্র সামান্য অস্ত্র বঙ্গবন্ধুর হাতে সমর্পণ করে সিংহভাগ রেখে দেন তাঁদের প্রভাব বিস্তার ও দখলের হাতিয়ার হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসী মনে এই কূটচাল ধরা পড়েনি।

অসাম্প্রদায়িক বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত জীবনে খাঁটি সোনার মতোই চরিত্রবান ছিলেন। ছিলেন একজন সাচ্চা মুসলমান। ধর্মকর্ম তিনি লোকচক্ষুর আড়ালে করতেন। মদ্যপান নিষিদ্ধ করলেন; বন্ধ করে দিলেন জুয়া খেলা ও রেসকোর্সের ঘোড়দৌড়। প্রতিষ্ঠা করলেন ইসলামী ফাউন্ডেশন ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, তবে রাজনীতিতে ধর্মের বেসাতি বন্ধ করতে ধর্মভিত্তিক দলের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলেই কেবল ধর্ম ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ছিল। স্থাপন করলেন আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুন্যাল। নাগরিকত্ব হরণ করা হলো পাঁচ ব্যক্তির, যারা প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তান বাহিনীর যোগসাজশে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। চালু করা হয় কলাবরেটর আইনের অধীনে দেশদ্রোহিতার মামলা। জেলে নেওয়া হলো কয়েক হাজার অপরাধীকে। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন সাধারণ ক্ষমা- চারটি সুনির্দিষ্ট অপরাধ, যথা হত্যা, ধর্ষণ, ডাকাতি, লুণ্ঠন ও অগি্নসংযোগকারীরা এ ক্ষমা পাবে না, তা আইনেই সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ আছে। তবু অন্যায় সমালোচনা, তিনি নাকি যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। এখন আবার কিসের বিচার! নাগরিকত্ব হারানো গোলাম আযম পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়েই বাংলাদেশের বাইরে সব মিথ্যা প্রচারণার নেতৃত্ব দেন এবং সেই পাসপোর্টেই বাংলাদেশের ভিসা নিয়ে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে আসেন, জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করেন (তত দিনে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া হয়। রহিত করা হয় কলাবরেটর আইন) এবং হাইকোর্টের রায়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পুনরায় লাভ করেন।

কয়েকটি ঘটনা-দুর্ঘটনায় বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে কালিমা লেপনের অপচেষ্টা আজও বিদ্যমান। বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে আহত হন। সত্যের অপলাপ আর কাকে বলে! ১৯৭৪ সালের শেষদিকে সর্বহারা পার্টি ও জাসদের অ্যাডভেঞ্চারিস্ট রাজনীতিতে দেশে একটি অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির শঙ্কা দানা বাঁধে। থানা আক্রমণ আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনা চলতে থাকে। গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে আসন্ন বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বরে ঢাকায় বড় ধরনের নাশকতা ঘটানো হবে। ১৫ ডিসেম্বরের রাতে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সেনাবাহিনীর সদস্য প্রাণবন্ত দেশপ্রেমিক শেখ কামাল সর্বহারা পার্টির একটি আক্রমণকারী দল মনে করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি গাড়িকে তাড়া করেন। হয় গোলাগুলি। মতিঝিলের ব্যাংকপাড়ায় শেখ কামাল আহত হন। চিকিৎসার জন্য তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার স্পষ্টভাষী বীর সেনানী অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রম লিখলেন, "এদিকে স্বাধীনতাবিরোধী ও আওয়ামী লীগবিরোধীরা এ ঘটনাকে ভিন্নরূপে প্রচার করে। 'ব্যাংক ডাকাতি' করতে গিয়ে কামাল পুলিশের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে তারা প্রচারণা চালায় এবং দেশ-বিদেশে ভুল তথ্য ছড়াতে থাকে। যদিও এসব প্রচারণায় সত্যের লেশমাত্র ছিল না।" (এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য, পৃষ্ঠা ৬৬)

সর্বহারা পার্টির নেতা কমরেড সিরাজ শিকদারের হত্যাকাণ্ড নিয়েও বঙ্গবন্ধুকে দায়ী করা হয়ে থাকে। ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি প্রত্যুষে সিরাজ শিকদার পুলিশের হেফাজত থেকে পালাতে গিয়ে নিহত হয়েছেন, এ হেন খবরটি শোনার পর বঙ্গবন্ধুর তাৎক্ষণিক স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া ছিল, 'লোকটাকে তোরা মেরে ফেললি, কী অন্যায়।' সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকার সময় আইনশৃঙ্খলা বিনষ্টকারী একজন বিপ্লবীর মৃত্যুর ঘটনায় সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর বর্তালেও এ বিষয়ে তাঁর পূর্বসম্মতি বা ধারণা ছিল না।

মধ্যবিত্ত অধ্যুষিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে নরম পন্থা ও সমঝোতাপূর্ণ মনোভাবে বিশ্বাসী ছিলেন জাতির জনক। জাসদ ও সর্বহারা পার্টির হটকারিতাপূর্ণ আক্রমণাত্মক পদক্ষেপে তিনি মনোকষ্ট পেতেন। সে জন্যই ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) মনসুর আলীর বাসভবনে জাসদের আক্রমণ ও অগি্নসংযোগের ঘটনার তিনি তীব্র সমালোচনা করেন। মনস্তাপে জর্জরিত হয়ে মধ্যবিত্তের গঠনমূলক রাজনীতিতে মনোনিবেশ করার পরামর্শ দিতে তিনি জাতীয় সংসদে সিরাজ শিকদারের করুণভাবে নিহত হওয়ার ঘটনারও উল্লেখ করেন। শামীম শিকদার অতিশয় যত্নের সঙ্গে জাতির জনকের একটি আবক্ষ ভাস্কর্য নির্মাণ করেন; তিনি ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায়, সিরাজ শিকদারের মৃত্যুর জন্য তাঁরা মোটেও বঙ্গবন্ধুর কোনো দায় বা সায় ছিল বলে মনে করেন না।

নিজ হাতে গড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের প্রতি বঙ্গবন্ধুর একটি সহজাত দুর্বলতা থাকা স্বাভাবিক ছিল বৈকি। কিন্তু সর্বোপরি দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে আপন করে নিয়েই তিনি একটি ক্ষুধা, দারিদ্র্য, আশ্রয়হীনতা ও রোগশোকমুক্ত শোষণহীন সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন। আর তারই একটি কৌশল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)। এতে তিনি সব দল, মত ও পথের সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন; ব্যবস্থাটিকে তিনি একদলীয় শাসন বলে মনে করেননি। হয়তো তিনি ভুল করেছিলেন। কৃষি খাতে সব জমির সংযুক্তি করে সমবায়ের অধীনে উন্নত চাষাবাদে বিপুল উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদন বৃদ্ধি করে যে আর্থসামাজিক উত্থান বঙ্গবন্ধু ঘটাতে চেয়েছিলেন, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের উভয় শিবির এটিকে কমিউন সিস্টেম অথবা কালেক্টিভাইজেশন মনে করে সুদৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করে। তবে সময় পেলে এর সফল বাস্তবায়ন বাংলাদেশকে অবশ্যই নতুন দিগন্তে নিয়ে যেত।

সমসাময়িক বিশ্বের সব বড় নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাই তো তিনি অতি সহজেই পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণে জাপানিদের সহায়তার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি আদায় করতে পেরেছিলেন। জাতিসংঘের সদস্য হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোর বিরোধী হেনরি কিসিঞ্জারও বঙ্গবন্ধু দর্শনের পর বলেছিলেন, 'আমি অনেক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সাক্ষাৎ পাই, কিন্তু আজই প্রথম একজন রাষ্ট্রনির্মাতার দেখা পেলাম।' এহেন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি, আত্মত্যাগ, আদর্শ ও স্বদেশ-স্বজাতি প্রেমের কথা স্মরণ করে কি আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সর্বশক্তি নিয়োগ করে বিশ্বের দরবারে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির মর্যাদা আরো বৃদ্ধি করতে পারি না? কেন পারব না বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের আধুনিক, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রযুক্তিনির্ভর কল্যাণ রাষ্ট্রকে অচিরেই বাস্তবে রূপ দিতে?

লেখক: ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ছিলেন।​

আগস্ট,শেখ মুজিব,মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close