• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

ইবিতে নিয়োগ বাণিজ্য, অডিও ফাঁস

প্রকাশ:  ২১ জুলাই ২০১৮, ১৪:৩৩ | আপডেট : ২১ জুলাই ২০১৮, ১৪:৪৬
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি

২০১৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িয়েছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. মাহবুবর রহমান। এ সংক্রান্ত একটি অডিও ফাঁস হয়েছিল। যাতে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের নিয়োগ নিয়ে কথা বলা হয়েছে। কথা বলা হয়েছে ওই বিভাগের তৎকালীন সভাপতি সহযোগী অধ্যাপক রুহুল আমিনের সঙ্গে।

সেখানে নিয়োগ বোর্ডের মৌখিক পরীক্ষা শেষে হালিম নামের এক প্রার্থীকে ধরে আনার নির্দেশ দেন প্রক্টর মাহবুবর রহমান। হালিমকে ব্রেনওয়াশ না করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে বলেও রুহুল আমিনকে সতর্ক করেন প্রক্টর। এ নিয়োগ নিয়ে এর আগে ২ এপ্রিল একটি অডিও ফাঁস হয়। যাতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের তৎকালীন সভাপতি সহযোগী অধ্যাপক রুহুল আমিন নিয়োগ প্রত্যাশী খুঁজতে তার বন্ধু এশিয়ান ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক আবদুল হাকিমকে অনুরোধ জানান।

তখন অডিওতে নিয়োগ বোর্ডে মৌখিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরে প্রক্টর প্রফেসর ড. মাহবুবর রহমান তার শিষ্য ফিন্যান্স বিভাগের সাবেক সভাপতি রুহুল আমিনকে নিয়োগ প্রত্যাশী হালিমকে ধরে আনতে নির্দেশ দেন। হালিম চালাকি করছে বলেও প্রক্টর অভিযোগ করেন রুহুল আমিনের কাছে। হালিম ওই নিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে শিক্ষক হিসেবে চূড়ান্ত হয়ে এখন ফিন্যান্স বিভাগের প্রভাষক হিসেবে কমর্রত আছেন।

অভিযোগ রয়েছে, রুহুল আমিন নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থী খোঁজার দায়িত্বে থাকতেন এবং প্রক্টর মাহবুবর রহমান কৌশলে বিভিন্ন মাধ্যমে নিয়োগ সম্পন্ন করতেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রক্টর প্রফেসর ড. মাহবুবর রহমান তার নিজের নামে নিবন্ধনকৃত গ্রামীণ ফোনের সেভেন অন ফাইভ সিরিজের নম্বর থেকে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের তৎকালীন সভাপতি সহকারী অধ্যাপক রুহুল আমিনের সঙ্গে নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে কথা বলেন। কথোপকথনটি তুলে ধরা হল-

রুহুল : হ্যালো।

মাহবুব : তোমার মোবাইল বন্ধ? ধরতেছো না যে মোবাইল?

রুহুল : মোবাইল ভুলে অফিসে রেখে আসছি স্যার, বলেন স্যার।

মাহবুব : মোবাইল অফিসে রাখলে তো মুশকিল! হালিম, আমি কিন্তু তোমাকে চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি ও চালাকি করতেছে।

রুহুল : কেন স্যার?

মাহবুব : ও চালাকি করতেছে তুমি যদি এখন আমার সঙ্গে (তুমিসহ) দেখা করতে না আস, ওর যদি ব্রেইন ওয়াশ করে না দেই, তাহলে কিন্তু সর্বনাশ হয়ে যাবে। ও মানে চালাকি করতেছে, মানে কী? হানড্রেড পারসেন্ট চালাকি করছে এবং পালানোর চেষ্টা করছে। সব কিছু ও (হালিম) জানে। জানে, হয়ে গেছে। এখন পালানোর চেষ্টা করছে। আমি তোমাকে বললাম, আমার জাস্ট অভিজ্ঞতা দিয়ে বললাম, তুমি কাজটা কর। কিছুই না, ওকে নিয়ে আস ব্রেনওয়াশ করি; তার পরে সে যাক। ও বলছে (হালিম), স্যার খুব ভালো ভাইভা দিয়েছি স্যার, খুব ভালো হয়েছে স্যার, একদম স্যার সব উত্তর দিয়েছি। ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে বাড়ি চলে যাই স্যার, বাসায় গিয়ে শুনি স্যার। তার প্রতিটি কথার মধ্যে আমার সন্দেহ হয়।

রুহুল : না না স্যার, আপনি টেনশন করবেন না স্যার।

মাহবুব : তুমি কী তাকে আনতে চাচ্ছ না?

রুহুল : স্যার, আমি দেখছি স্যার, আমি ফোন দিচ্ছি স্যার, কোথায় আছে?

মাহবুব : এখন চলে যাবে। তিনটি ক্যান্ডিডেটের সঙ্গে যদি একটু কথা বলা যেত না, সবচেয়ে ভালো হতো।

রুহুল : দেখি আমি কথা বলছি স্যার।

মাহবুব : দেখ তো একটু।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। অভিযুক্তরা প্রভাবশালী হওয়ায় স্বাক্ষীদের স্বাক্ষ্য গ্রহণ করে বিষয়টি সেখানেই শেষ করা হয়। দেশের বহুল প্রচারিত একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর নড়ে চড়ে বসে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় সে সময় ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল অন্যান্য শিক্ষকদের মাঝে।

এবার ২০১৮ সালের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) আবারো শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। এর সাথে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ শিক্ষকের নাম উঠে এসেছে ফাঁস হওয়া অডিওতে। ২০ লাখ টাকায় প্রার্থীকে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিলেও, চাকরি দিতে না পারায় টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে শিক্ষক ও প্রার্থীর কথোপকথনের অডিও ফাঁস হয়েছে।

ফাঁস হওয়া অডিওতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের নামে এক প্রার্থীর সঙ্গে নিয়োগ বাণিজ্য হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর এর নামও উঠে এসেছে।

ওই নিয়োগ বাণিজ্যে সহযোগী হিসেবে টাকা লেনদেনের চুক্তি করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক। তারা হলেন- বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. বাকী বিল্লাহ বিকুল এবং ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদ। প্রার্থী ফারজানা ও তার স্বামী মামুনের সঙ্গে টাকা লেনদেনের চারটি রেকর্ড ফাঁস হয়েছে।

অডিওতে নগদ ১০ লাখ টাকা প্রদান এবং বাকি ১০ লাখ টাকার চেক প্রদান করা হয়েছে। তবে ওই প্রার্থীর নিয়োগ নিশ্চিত না করতে পারায় টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। ১৩ জুলাই রাতে ওই প্রার্থীর স্বামীকে ফোনে ডেকে নিয়ে টাকা ফেরত দিয়েছেন বলে অডিওতে বলা হয়েছে।

এ ঘটনায় ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমানকে আহবায়ক করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠনসহ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের অডিও ফাঁসের ঘটনায় জড়িত দুই শিক্ষককে প্রশানিক পদ থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

এদিকে ফাঁস হওয়া রেকর্ড থেকে স্পষ্টভাবে জানা গেছে, এই নিয়োগ বাণিজ্যর মূল হোতা অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন। অথচ একটি পক্ষ অডিও রেকর্ডকে পুঁজি করে অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেনকে বাইরে রাখার চেষ্টা করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাকুরী প্রত্যাশী ফারজানা শহরের হরিশংকরপুর এলাকার আনিচুর রহমান আনিচের মেয়ে। তার স্বামী শাহরিয়ার আল মামুন রাজা মূলত এই চাকুরীর অর্থ লেনদেনকারী।

তাদের ভাষ্যমতে, তারা চাকুরীর জন্য যোগাযোগ করেছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেনের সাথে। অডিও রেকর্ডে ফাঁস হওয়া যে স্যারের সাথে কথোপকথনের কথা ভাইরাল হয়েছে মূলত তারা তাদেরকে চেনেন না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্যর ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। কিন্তু তারা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এবারের নিয়োগ বাণিজ্য অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়েছে কিন্তু এবারও ধরা ছোয়ার বাইরে থাকতে পারেন রাঘব বোয়ালরা। কারণ বারবার অডিও ক্লিপের কথোপকথন নিয়ে গবেষণা হচ্ছে অথচ যিনি এই কর্মকাণ্ডের নায়ক তার নাম অডিওতে উল্লেখ থাকলেও তার কথা বলা হচ্ছে না। এটাও একটা কুটচাল। এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেনের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মো: হারুন-উর-রশিদ আসকারী পূর্বপশ্চিমকে জানান, তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১৫ কার্য দিবসের ভিতর রির্পোট দেয়া হলে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আগের বছরের নিয়োগ বাণিজ্যের ব্যাপারে তিনি বলেন, সে সময় ও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। স্বাক্ষীদের স্বাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু আগেরটার চেয়ে এবারের অপরাধটা আরো গুরুত্বর। ঘটনা প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা।

/পি.এস

কুষ্টিয়া,ইবি,নিয়োগ বাণিজ্য
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close