• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

টাকার জন্য শৈশবের বন্ধুকে ৫ টুকরা করল বন্ধু

প্রকাশ:  ১১ জুলাই ২০১৮, ১০:৫৪
নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি

‘কথায় আছে ‘অর্থই অনর্থের মূল’। তাই বলে এই অর্থই যে শৈশবের প্রিয় বন্ধুকে এমন ভয়ঙ্কর ঘাতকে পরিণত করবে এমনটা হয়তো ভুল করেও ভাবেননি প্রবীর চন্দ্র ঘোষ। ভেবে থাকলে হয়তো কোনদিনও বন্ধুত্বের মুখোশে এই নরপিশাচকে সুখে দুঃখে বুকে আগলে রাখতেন না প্রবীর।

পিন্টু যতবার অসুস্থ হয়েছে, যতবার প্রয়োজন হয়েছে ততবারই প্রবীরকে পাশে পেয়েছে সে। অথচ সেই পিন্টুই শৈশবের বন্ধুকে হত্যাশেষে টুকরো টুকরো করে লাশ ফেলে রেখেছে সেপটিক ট্যাংকে।

তাদের বন্ধুত্ব পারিবারিক। প্রবীরের বাবা ভোলানাথ ঘোষ ও পিন্টুর বাবা সতীশ দেবনাথও ছিলেন বন্ধু। সে থেকেই একসাথে চলা শুরু তাদের। শৈশব পেরিয়ে কৈশোর এমনকি ব্যবসায়িক জীবনে এসেও ভাঙ্গেনি সেই বন্ধুত্ব। বরং বিভিন্ন অর্থনৈতিক লেনদেনের মধ্য দিয়ে তারা একে অপরের আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।

জানা যায়, বালুমাঠের বাসিন্দা ভোলানাথ ঘোষ’র একান্নবর্তী পরিবার। পারিবারিক ব্যবসা ‘ভোলানাথ জুয়েলার্স’ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন প্রবীর চন্দ্র ঘোষ। বাবার অসুস্থতার ফলে হয়ে উঠেছিলেন পরিবারের অভিভাবক। প্রবীরের ছোট ভাই ইটালি প্রবাসী সৌমিক ঘোষ তার কাছেই নিজের উপার্জিত অর্থ পাঠিয়ে দিতেন। সেই অর্থেই প্রবীর ও পিন্টু ব্যবসা পরিচালনা করতেন। এর মধ্যেই সৌমিকের দেশে ফিরে আসার কথা চলতে থাকে। সৌমিক দেশে ফিরলে তাকে টাকার হিসাব দিতে হবে সে জন্যই পিন্টুকে তার ব্যবসায়ে খাটানো অর্থ ফেরত দেওয়ার চাপ দিতে থাকেন প্রবীর। আর সেই অর্থের জন্যই প্রবীরকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করছেন প্রবীরের ব্যবসায়িক বন্ধু ও প্রতিবেশীরা।

১৮ জুন রাত সাড়ে ৯টায় একটি ফোন পেয়ে নিজ বাসা থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হন স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রবীর চন্দ্র ঘোষ। তারপর থেকে প্রবীরের ব্যবহৃত ফোনে বার বার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। সেদিন রাত সোয়া একটাই প্রবীরের বন্ধু গোপী নাথের ফোন রিসিভ হলেও অপর প্রান্ত থেকে কথা হয়নি কোন। তারপর থেকেই বন্ধ পাওয়া যায় প্রবীরের ফোন। পরদিন ১৯ জুন সদর মডেল থানায় নিখোঁজের জিডি করা হয় পরিবারের পক্ষ থেকে।

প্রবীরকে উদ্ধারের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে কালির বাজারে সোনা ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। ১৮ জুন রাতের কালির বাজারের কয়েকটি সিসি টিভি ফুটেজে দেখা যায় রাত ৯টা ২৫মিনিটে প্রবীর কালির বাজারের দিকে যাচ্ছে। আরেকটি সিসি টিভি ফুটেজে তাকে পিন্টু ঘোষের সঙ্গে হেটে যেতেও দেখা যায় । এরই মধ্যে ২১ জুন প্রবীরের মোবাইল নাম্বার থেকে তার ছোটভাই বিপ্লব চন্দ্র ঘোষের ফোনে ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে পরিবারের কাছে ১ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। তার পরেই পরিবারের পক্ষ থেকে ঘটনায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের হয় সদর মডেল থানায়। তারপর থেকেই বিভিন্ন সময়ে পিন্টুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। তবে গ্রেফতারের আগে তাকে কখনোই পুলিশের সন্দেহ হয়নি বলে জানায় পুলিশ।

ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ প্রবীর ঘোষের মোবাইল ফোন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে জানতে পারে কুমিল্লার ভারত সীমান্তে শিবের বাজার এলাকায় ব্যবহার করা হয়েছে প্রবীরের সিমকার্ড। পরবর্তীতে ফিরতি ম্যাসেজে মুক্তিপণ দিতে রাজি হলেও আর কোনভাবে যোগাযোগ করা যায়নি প্রবীরের নাম্বারে।

এর মধ্যে তীব্র হতে থাকে প্রবীরকে উদ্ধারের আন্দোলন। উদ্ধারের দাবিতে স্মারকলিপি দেয়া হয় পুলিশ সুপার ও জেলা প্রসাশক বরাবর। পুলিশ মামলার রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হলে ৫ জুলাই নারায়ণগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)র কাছে হস্তান্তর করা হয় মামলাটি। তারপর থেকেই ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূরে আলম’র তত্বাবধায়নে তদন্তকারী অফিসার এসআই মফিজুল ইসলাম (পিপিএম) এ নিয়ে কাজ শুরু করেন।

তদন্ত করতে গিয়ে ৭ জুলাই প্রবীরের মোবাইল ফোনে অন্য একটি সিমকার্ড ব্যবহারের বিষয়টি জানতে পারে গোয়েন্দা পুলিশ। মোবাইল ফোন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে গ্রেফতার করা হয় মোবাইল ব্যবহারকারী বাপন ভৌমিককে। তারপর থেকেই খুলতে থাকে মামলার জট। কুমিল্লা দাউদকান্দির ঠেটালিয়া এলাকার কুমদ ভৌমিকের সন্তান বাপন। সে হত্যাকারী পিন্টু দেবনাথের কর্মচারী বলে পরিচয় জানতে পারে পুলিশ।

বাপন কোথা থেকে এই ফোন পেয়েছে জানতে চাইলে পিন্টু তাকে এই ফোন দিয়েছে বলে যানায় সে। কথা ছিলো ফোনটি ভারত সীমান্তের কোথাও ফেলে আসবে সে। তবে বাপন তা না করে নিজের কাছেই রেখে দেয় ফোনটি। আর পিন্টুকে জানায়, সে কুমিল্লা নিজ বাড়ীতে যাওয়ার পথে নদীতে ফেলে দিয়েছে ফোন। অবশেষে গোপনে সে এই ফোনে নিজের সিমকার্ড ব্যবহার করে।

বাপনের দেয়া তথ্যমতে পিন্টু দেবনাথকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সোমবার সারাদিনের জিজ্ঞাসাবাদের পিন্টু পুলিশকে জানায় প্রবীর ভারতের মাদ্রাজে আছেন। তবে আরো জিজ্ঞাসাবাদে প্রবীরকে হত্যার কথা স্বীকার করে পিন্টু দেবনাথ। পরবর্তীতে রাত ১১টায় তাকে নিয়েই আমলাপাড়ার ১৫, কে সি নাগ রোডের পিন্টুর ভাড়া বাড়ির সেপটিক ট্যাংকে অভিযান চালায় পুলিশ। সেখান থেকেই একে একে বের করা হয় তিনটি বস্তায় মোড়ানো প্রবীর ঘোষের পাঁচ টুকরো লাশ। তবে উদ্ধার করা যায়নি তার পায়ের হাটুর নিম্নাংশ।

প্রবীর ঘোষের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশ সুপারের সংবাদ সম্মেলন ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক পুলিশ কর্তকর্তা থেকে এমনি সব তথ্য উঠে আসে। পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে মঙ্গলবার (১০ জুলাই) সকালে সংবাদ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মঈনুল হক প্রবীর ঘোষের হত্যা ও দুজন আসামিকে গ্রেফতারের বিষয়টি গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেন। সোমবার রাতে প্রবীরের লাশ উদ্ধারের খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পরলে আমলাপাড়ায় ভীড় জমে তার কাছের জনসহ উৎসুক জনতার।

পিন্টু ও বাপনের ৫ দিনের রিমান্ড: এদিকে প্রবীর ঘোষ’র হত্যাকারী পিন্টু দেবনাথ ও বাপন ভৌমিকের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। প্রবীর হত্যার রহস্য উন্মোচনে পুলিশের পক্ষ থেকে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আফতাবুজ্জামানের আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করলে আদালত ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।

পা ছাড়াই প্রবীরের শেষকৃত্য: ময়নাতদন্ত শেষে পা ছাড়াই শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে প্রবীর ঘোষের। মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে চারটায় নগরীর মাসদাইর শ্মশানে প্রবীরের পাঁচ টুকরো লাশের শেষ কৃত্যানুষ্ঠান হয়। এসময় পরিবারের সদস্যদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠে শ্মশান এলাকা।

তার আগে বিকেল সাড়ে তিনটায় নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে নিজ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান কালির বাজারের ভোলানাথ জুয়েলার্স’র সামনে নিয়ে আসা হয় প্রবীরের লাশ। সেখানে কিছুক্ষণের জন্য রেখে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় মাসদাইর শ্মশানের উদ্দেশ্যে। এসময় হত্যাকারী পিন্টু দেবনাথ ও বাপন ভোমিক’র ফাঁসির দাবিতে শ্লোগান মূখর হয়ে উঠে কালির বাজার এলাকা।

প্রবীর নিখোঁজের পর যেমন ছিলো হত্যাকারী পিন্টুর আচরণ: পিন্টুর প্রতিবেশী ও কালিবাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রবীর চন্দ্র ঘোষ নিখোঁজের পর বেশ স্বাভাবিক ছিলো হত্যাকারী পিন্টু দেবনাথ’র আচরণ। পরদিন থেকেই খুব স্বাভাবিকভাবে মিশেছেন ব্যবসায়ী বন্ধুদের সঙ্গে। সক্রীয় ছিলেন প্রবীরকে উদ্ধারের দাবিতে হওয়া আন্দোলনেও। নিয়মিত ব্যবসায় কার্যক্রম চালিয়েছেন তার প্রতিষ্ঠান ‘পিন্টু স্বর্ণ শিল্পালয়’ এ বসে। মনযোগী ছিলেন ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে।

পুলিশ জানায়, নিখোঁজের পর প্রতিবাদ সভায় প্রবীরকে উদ্ধারে পুলিশের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্নতুলে বক্তব্যও রাখে সে। প্রতিবেশী, ব্যবসায়ী বন্ধু ও পুলিশের কাছে বারবার শুনিয়েছেন একই গল্প। ‘ঘটনার দিন প্রবীর ঘোষ তার কাছে অপর বন্ধু গোপী ও উত্তম’র খবর জানতে চান। তাছাড়াও তার কাছে পাওনা সাড়ে সাত হাজার টাকা চাইতে এসেছিলেন প্রবীর। তারপর থেকে আর কোন যোগাযোগ হয়নি প্রবীরের সঙ্গে।’

তবে প্রতিবার পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের পরপরই পিন্টু অনেক বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়তো বলে জানায় পুলিশ ও তার প্রতিবেশীরা। যে বাড়িতে থেকে উদ্ধার করা হয় প্রবীরকে: আমলাপাড়ার ১৫ কে.সি নাগ রোডের রাশেদুল ইসলাম’র (ঠান্ডু মিয়া) চারতলা বাড়ি। বাড়িতে মোট ১০টি পরিবারের বসবাস। দুটি পরিবার ছাড়া বাকি ৮টি পরিবারের কেউ জুয়েলারী ব্যবসায়ী কেউবা কর্মচারী। সে বাড়ির দোতলার একটি ফ্ল্যাটে ৬৪০০ টাকায় দুই রুমের একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন পিন্টু দেবনাথ। প্রায় ২২ বছর যাবৎ এই বাড়িতেই পিন্টুর বসবাস।

প্রতিবেশীরা বলছে, পিন্টুর বসবাসরত বাসাটিতে এক সময় ভাড়া থাকতেন পিন্টুর ওস্তাদ অপু রায় (মৃত)। অপুরায়’র পরিবারের সঙ্গেই থাকতেন পিন্টু। প্রায় পনের বছর পূর্বে অপু রায় পরলোক গমন করলেও সে বাড়িতেই অপু রায়ের স্ত্রী সন্তানদের সঙ্গে থেকে যায় পিন্টু। অপু রায়ের ছোট ছেলে ক্যান্সারে মৃত্যু বরণ করলে প্রায় পাঁচ বছর আগে বিক্রমপুরের গ্রামের বাড়ি চলে যায় অপু রায়ের পরিবার। তবে বাসায় একাই থেকে যান পিন্টু। সে হিসেবে প্রায় ২২ বছর যাবৎ একই বাসায় পিন্টু ভাড়া থাকতো। এই কয়েক বছরে মাঝে মধ্যেই পিন্টুর বাসায় প্রবীর ঘোষসহ অন্যান্য বন্ধুদের আনাগোনা ছিলো বলেও জানা যায়।

১৮ জুন রাত নিয়ে যা বলছেন পিন্টুর প্রতিবেশীরা: পিন্টু বাসায় একা থাকলেও দোতলায় তার প্রতিবেশী অখিল মন্ডল ও রতন দত্ত থাকেন পরিবারসহ। প্রবীর নিখোঁজ হওয়ার দিন বাসায়ই ছিলেন অখিল ও তার পরিবার। কথা হয় পেশায় কর্মকার প্রতিবেশী অখিল মন্ডলের সঙ্গে। বলেন, অন্যসব দিনের মতো ঐদিনও আমরা খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমাই পড়ি। বাড়ির পরিবেশ স্বাভাবিকই মনে হইছে। রাতে কোন আওয়াজও কানে আসে নাই। তাছাড়া ওনারা মালিক মানুষ ভিআইপিভাবে চলে তাই আমাদের সঙ্গে তেমন কথাবার্তা হইতো না।

প্রবীর ঘোষ’র মৃত্যুতে সোমবার বন্ধ থাকবে কালির বাজার স্বর্ণ মার্কেট। এদিকে ব্যবসায়ী প্রবীর ঘোষের মৃত্যুতে শোকার্ত স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা স্বতস্ফুর্তভাবেই বন্ধ রেখেছে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি দোকানে কালো কাপড় ঝুলিয়ে শোক প্রকাশ করা হচ্ছে। আগামী সোমবার (১৬ জুলাই) প্রবীর ঘোষের মৃত্যুতে অর্ধবেলা মার্কেট বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে দোকান মালিক সমিতি।

/পি.এস

নারায়ণগঞ্জ,বন্ধু
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close