রঙের মানুষ
আমরা সব সময় যা দেখি তাই সত্যি নয়। অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে সবার সব দোষ গুণ আমাদের অ্যান্টিনায় ধরা পরবে সাধ্য কি ! কিন্তু দোষ-গুণ মিলিয়েই তো মানুষ। আমরা কেউই এই সব দোষ কিংবা গুণ গুলোর ঊর্ধ্বে নয়। যে যেমনই হোক যাই করুক দিনশেষে একজনের কাছে বিশ্বস্ত হতে চায়, ভালোবাসা চায়, নির্ভরতা চায়। প্রমাণ করতে চায়, '' আমিই শ্রেষ্ঠ'' !
১) পৃথিবীতে কত রঙের মানুষ। বেশিরভাগ মানুষ আত্মপ্রেমে মগ্ন। অর্থাৎ আমি ভালো, আমি জ্ঞানী, আমি সুন্দরী, আমি কর্মঠ ইত্যাদি ইত্যাদি। এরা হচ্ছে আমিত্ববাদী মানুষ, দিনমান নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করাতে ব্যস্ত। এরা কোনভাবেই অন্যের প্রশংসা সহ্য করতে পারে না। কিছুতেই বুঝে না আমিত্ব কেবল বোঝা নয়, এক ধরণের ব্যাধিও।
সম্পর্কিত খবর
২) দ্বিতীয় প্রকার মানুষ সারাক্ষণ প্রমাণ করতে ব্যস্ত তুমি খারাপ, তুমি বোকা, তুমি অকর্মণ্য। অর্থাৎ অন্যের গীবত, নিন্দা এবং সমালোচনা মুখর । এরা মূলত বেকার, হাতে কোন কাজ নেই।
৩) কিছু মানুষ পছন্দ করে কষ্টে আছি বলতে, কিছু মানুষ পছন্দ করে অন্যরা কষ্টে আছে বলতে। এরা সহানুভূতি চায় ।
৪) কিছু মানুষ কষ্ট দিতে পছন্দ করে, কিছু মানুষ কষ্ট পেতে পছন্দ করে । এরা উভয়েই স্যাডিস্ট ।
৫) কিছু মানুষ বিনা কারণে দাম্ভিক, এরা আবার হিংসুটে এবং অহংকারীও । ঈর্ষাকাতর মানুষ বিন্দুমাত্র স্বস্তি পায় না। এরা সমাজ বিচ্ছিন্ন মানুষ।
৬) কিছু কিছু মানুষ ঝগড়াটে। সুযোগ খুঁজে, ঝগড়ার বিষয় খুঁজে। অন্য কারো নিশ্চুপ বা নির্লিপ্ততায় ক্ষোভে ফেটে পরে । এরা নিজেরাই নিজেদের মনগড়া অশান্তি ডেকে আনতে পছন্দ করে।
৭) কিছু মানুষের কোন কাজ নেই, একটাই কাজ অন্যের পেছনে লেগে থাকা, অন্যের কাজের দোষ ধরা, অন্যকে বিরক্ত করা। সারাক্ষণ একটাই চিন্তা কি করলে অন্য একজন জ্বলবে, কষ্ট পাবে, বিরক্ত হবে, অসহায় বোধ করবে। সার্বক্ষণিক মনের অশান্তি ওদের পীড়া দেয় ।
৮) নিজের সমস্ত অসহায়ত্ব অপারগতা, পরাজয়ের দায়ভার অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে স্বস্তি পাওয়া । মনের অগোচরে এক ধরনের অনিশ্চয়তা, হীনমন্যতা এদের তাড়া করে।
৯) কিছু মানুষ কাজ পাগল, পৃথিবীর সমস্ত কিছুর বাইরে কাজকেই বেশি ভালোবাসে, আপন মনে করে। এদেরকে বলে ওয়ার্কোহলিক । এরা মূলত একাকীত্ব বা লোনলিনেসে ভুগে। অন্যের উপর নির্ভর করতে পারে না কোন কিছুতেই ।
১০) কিছু মানুষ বড় আবেগী। এরা শূন্যে স্বপ্ন বুনে, সাজায় যা বাস্তবের সাথে কখনো মিলে না। অবশেষে স্বপ্নভঙ্গ হয়, হতাশা এসে গ্রাস করে।
১১) কিছু কিছু মানুষ ভীষণ অসৎ, তাদের একটাই লক্ষ্য যে করে হোক সম্পদের মালিক হওয়া । টাকাই তাদের কাছে একমাত্র ভগবান। এরা সর্বগ্রাসী, ভয়ঙ্কর মানুষ। নিজের স্বার্থের জন্য যেকোন হীন কাজ অনায়াসেই করতে পারে।
১২) কোন কোন মানুষ আবার ক্ষমতা এবং শ্রেষ্ঠত্বের মোহে আত্মহারা। এদের বোকার স্বর্গে বসবাস। সার্বক্ষণিক চাটুকার দ্বারা পরিবেষ্টিত, কিন্তু কেউ এদের আপন হয় না। এরা মূলত নিঃসঙ্গ ।
১৩) কিছু কিছু মানুষ চায় অন্যরা তাঁকে ঈর্ষা করুক, তাঁকে দেখে জ্বলুক । এরা আসলে মানসিক ভাবে বিকারগ্রস্থ, সদা সর্বদা এক ধরনের কমপ্লেক্সে ভুগে।
১৪) কিছু কিছু ভদ্র বেশেই মানুষ। ভদ্রতার অন্তরালে অসভ্য, নিতান্তই স্বার্থপর। অন্যকে বোকা বানাতে এবং ভাবতে পছন্দ করে । এরা অন্যের অপকার করে এবং নিজেদের চালাক মনে করে। মূলত এতে করে নিজের কোন লাভ হয় না অযথাই নিজের শান্তি এবং মূল্যবান সময়ের অপচয়।
১৫) কেউ আবার কেবল শ্রদ্ধা আর মানুষের ভালোবাসা চায়। মানুষ হিসেবে প্রাপ্য সম্মান টুকুর জন্য সবকিছু নির্দ্বিধায় বলী চড়ায়। এরা নির্লোভ ত্যাগী মানুষ। এদের সারাজীবন ভীষণ কষ্টের হয় ।
১৬) কো্নো কোনো মানুষ আবার বিনা করণে লোভী, অন্যের সবকিছুর প্রতি তাদের লোভ। এরা ভীষণ ঈর্ষা কাতরতায় ভুগে। অন্যদের সুখ বা কোন প্রকার পাওয়া এদের অসুস্থ এবং অসুখী করে।
১৭) কিছু কিছু মানুষ ময়ূরপুচ্ছধারি কাকের মতো, এরা নিজেকে আড়াল করার জন্য অনর্গল মিথ্যা বলে । মুখে ভালোত্বের মুখোশ এঁটে রাখে, ভাবে অন্যকে বোকা বানাতে পেরেছে কিন্তু জানে না মিথ্যা এক ধরনের অসুস্ততা যা সার্বক্ষণিক পীড়া দেয়। এরা কখনো কারো সম্মান এবং ভালোবাসা পায় না।
১৮) কেউ কেউ ভীষণ অলস, অলসতার জন্য কেবল অজুহাত খুঁজে ফিরে এবং ভাগ্যকে দোষারোপ করে।
১৯) কোনো কোনো মানুষ মনে করে যেমন আছি ভালো আছি, এরাই মূলত সুখী। কারণ বাস্তবতার সাথে চাহিদাকে সীমাবদ্ধ করতে পেরেছে।
২০) কিছু কিছু মানুষ মনে করে তারা জনম দুঃখী। দিনমান আহাজারি নেই নেই আর নেই। কিংবা পেলাম না, হলো না ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যিকারেই এদের দুঃখ কষ্ট কখনো শেষ হবার নয় । কারণ অনন্ত চাওয়ার কোন সীমা পরিসীমা থাকে না ।
২১) কিছু লোক নিজেকে ত্যাগী কিংবা সর্বংসহা ভাবতে পছন্দ করে। এরা কারো কাছে কিছু প্রত্যাশা করে না, কেবলই বিলিয়ে যায়। এদের জীবনে অনেক না পাওয়া থাকে বলে স্বাভাবিক আচরণ বাধাগ্রস্থ হয়।
২২) কিছু কিছু মানুষ জাগতিক সমস্ত চাওয়া- পাওয়ার বাইরে আধ্মাতিকতায় নিজেদের নিয়োজিত রাখে। এরা মনে করে প্রতিটি চাওয়াই মূলত পাপ কিংবা অভিশাপ যা মানুষকে শান্তি দেয় না । চাওয়াটাতে রাশ টানতে পারলেই কেবল সুখ আর সুখ। শান্তি আর শান্তি। এরা মূলত সাধু সন্ত শ্রেণীর মানুষ সকলের নমস্য এবং শ্রদ্ধার পাত্র। কারণ তাঁরা বস্তুগত চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে নিজে জয়ী হতে পেরেছে। এদের একমাত্র সুখ অন্যের কল্যাণ সাধন।
২৩) যে নিজে অসৎ কিংবা অবিশ্বস্ত সে কোন দিন কারো উপর নির্ভর কিংবা কারো উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে না। আর অনিশ্চয়তায় বিপদ সঙ্কুল পথ কখনো তাঁর পিছু ছাড়ে না ।
২৪) যারা অল্পে রেগে যায় তাঁরা মূলত দুর্বলচিত্তের ভীতু ধরনের মানুষ। আবার এক শ্রেণীর মানুষ ক্রোধের অন্তরালে নিজের দুর্বলতাকে আড়াল করে। তারা উভয়েই নিজের ব্যাপারে সন্দিহান অর্থাৎ কোথাও না কোথাও আত্মবিশ্বাসে চির আছে ।
২৫) কিছু মানুষ অতিরিক্ত কৌতূহলী অন্যের ব্যাপারে অতি মাত্রায় আগ্রহী। এই ধরনের লোক মূলত ছিদ্রান্বেষী, অন্যের দোষ বা দুর্বলতায় কাঁচা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার মত করে কাঁদা ছোঁড়াছুড়িতে সিদ্ধ হস্ত। কেবলই সুযোগের অপেক্ষা।
২৬) কেউ কেউ একটু মুখ চোরা লাজুক প্রকৃতির । এদের বুক ফাটে তো মুখ ফুটে না অবস্থা। সহজে মনের কথা মুখে এনে বলতে পারে না, '' পিছে লোকে কিছু বলে'' । এরা অতীব মাত্রায় স্বপ্ন বিলাসী এবং রোম্যান্টিক মনের মানুষ। জীবনের বাস্তবতায় কষ্ট পায় বেশী।
২৭) কিছু কিছু মানুষ যে কোন অবস্থাতেই তা যত সহজ বা কঠিনই হোক মানিয়ে নিতে পারে। এরা মূলত সুখী হওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়েই পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করেছে । কোন প্রতিকূলতা, সংগ্রাম, দুঃখ কষ্ট ওদের গতিকে পরাস্থ করতে পারে না। এরা প্রচণ্ড পরিশ্রমী, কষ্ট সহিষ্ণু, আত্মবিশ্বাসী এবং দৃঢ় চিত্তের অধিকারী হয়। সাধারনত অন্যের জন্য সাহায্যকারীর ভূমিকা পালন করে থাকে।
২৮) কোন কোন মানুষ প্রচণ্ড নিয়ন্ত্রণকারী। এরা সর্বেসর্বা, জ্ঞানী। আশেপাশের সবার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় । ভুলে যায় মানুষের ব্যক্তি সত্ত্বা আছে এবং প্রতিটি মানুষ আলাদা। এরা পাশের মানুষটির জীবন নরকে পরিণত করে ছাড়ে। তবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। অনেকে এদের ভয় করে, বিরক্ত হয়, এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে।
২৯) কিছু মানুষ প্রচণ্ড রকম কৌসুলি । ছলে বলে কৌশলে নিজের স্বার্থটুকু আদায় করতে সিদ্ধহস্ত । এরা মূলত স্বার্থপর। নিজেকে ছাড়া অন্যকে বুঝে না। সরলতা এদের কাছে দুরহ ব্যাপার ।
৩০) বিনা কারণে কিছু কিছু মানুষ প্রচণ্ড কৃপণ। নিজে কষ্ট করে সম্পদের পাহাড় গড়ে। কৃপণ ব্যক্তিদের মনও ভীষণ ছোট থাকে, অন্য কাউকে সহজ ভাবে দেখতে বা নিতে পারে না।
৩১) কিছু কিছু মানুষ ভীষণ জটিল। সহজ সরল ব্যাপারগুলোর মাঝেও অনুসন্ধিৎসু চোখে ষড়যন্ত্র খুঁজে ফিরে। এরা শান্তিময় জীবনে অশান্তির সৃষ্টি করে। ।
৩২) কিছু মানুষের তাবৎ পৃথিবীর সাথে কোন লেনদেন নেই। সে তাঁর ছোট্ট পরিসরে একা একা নিজেকে নিয়ে সুখী হতে চায়। অন্যদের সাথে সহজে মিশতে পারে না বলে অজানা তে চলতি পথে বার বারই হোঁচট খায় । এদের জগত ভীষণ ছোট এবং একার ।
৩৩) সবচেয়ে মারাত্মক বন্ধু বেশে শত্রু। আপনার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আপনার সাথে থেকে নির্দয় প্রতারণা করে চলছে । এই ছলচাতুরে বন্ধুদের থেকে সাবধান কারণ এরাই এই পৃথিবীতে নরকের কীট। আপনার শক্তি এবং দুর্বলতা গুলো জেনে নিয়ে যে কোন মুহূর্তে আপনাকে কঠিন বিপদে ফেলতে পারে।
৩৪) কিছু মানুষ অন্যের দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, পরাজয়ের মাঝে নিজের সুখ আর আনন্দ খুঁজে ফিরে । এরা সাধারনত অকর্মণ্য মানুষ। নিজের করার ক্ষমতা নেই বলে অন্যের পরাজয়ে খুশী হয়, সুখ খুঁজে। অন্যকে ছোট করার মাধ্যমে নিজে বড় হতে চায়। এদের আত্মবিশ্বাস, নিজের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সম্মান বোধ নাই বললেই চলে।
৩৫) সবার প্রতিবাদ করার সাহস বা শক্তি থাকে না । অন্যায় এবং অসামঞ্জস্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং প্রতিবাদ করে প্রতিরোধ গড়তে পারা মানুষরাই হয় নেতৃস্থানীয়। এদের জীবন ভীষণ ঝুঁকি পূর্ণ এবং চলার পথ খানিকটা বন্ধুর, কারণ সঙ্গত কারণেই অন্যদের বিরাগ ভাজন হতে হয়।
৩৬) কিছু কিছু মানুষ অন্যদের ধার ধারে না কথা বলে কম কাজ করে বেশী। আবার কিছু মানুষ অন্যকে নিয়েই বেশী ব্যস্ত । অন্যের আলোচনা সমালোচনায় আড্ডার টেবিলে মশা মাছি মেরে সময় নষ্ট করে। এরা কথা বলে বেশী কাজ করে কম ।
আমরা সব সময় যা দেখি তাই সত্যি নয়। অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে সবার সব দোষ গুণ আমাদের অ্যান্টিনায় ধরা পরবে সাধ্য কি ! কিন্তু দোষ-গুণ মিলিয়েই তো মানুষ। আমরা কেউই এই সব দোষ কিংবা গুণ গুলোর ঊর্ধ্বে নয়। যে যেমনই হোক যাই করুক দিনশেষে একজনের কাছে বিশ্বস্ত হতে চায়, ভালোবাসা চায়, নির্ভরতা চায়। প্রমাণ করতে চায়, '' আমিই শ্রেষ্ঠ'' !
লেখক: সম্পাদক, পূর্বপশ্চিম বিডি